সেই বাঙালি কি হারিয়ে গেল ?মেরুদণ্ডহীন , শিরদাঁড়া হীন হিন্দু বাঙালিদের ঘর পুড়ছে বাংলার মাটিতে
মার্কিন মুলুকে ইউরোপীয়দের নাকে ঝামা ঘষে বিশ্ব কুস্তির আখড়ায় ভারতের জয়ধ্বজা উড়িয়েছিলেন ছ’ফুট দু’ ইঞ্চি লম্বা, একশো বত্রিশ কিলো ওজন, আটচল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতিসম্পন্ন এক বিশ্বজয়ী বাঙালি..🌻
রাত দু- দফায় খেতেন তিন সের দুধ৷ খেতেন বাতাসার শরবত,তেমন খেতেন কাগজি বাদামের শরবতও৷ দুপুরে মাছ,ভাত সঙ্গে আধ সের দুধের ক্ষীর। রাতে আবশ্য খেতেন বিশেষ একটা খাবার যার নাম আখনি৷ কয়েক সের (২থেকে ৫সের পর্যন্ত) খাসি বা মুরগির মাংস,দেড় সের বাটা বাদাম ও এক সের খাঁটি ঘি দিয়ে তৈরি হত ৷ হাঁড়ি করে কাঠের জ্বালের উনুনে চাপানো হত সকাল সাড়ে সাতটায়৷ হাঁড়ি নামত বিকেল পাঁচটায়৷ ঘন্টা দশেক ফোটার পর শক্ত মাংস গলে জল হয়ে যেত৷ জল মরে মরে ব্যঞ্জনটি এতটুকু হয়ে যেত৷ সেইটুকু ছিল আহার্য৷ বিশেষ খাবার তাঁকে খেতে হত কারণ তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন,নিজের বাহুবলে বাঙালির দুর্নাম ঘুচিয়েছেন..💪
চলুন ফ্ল্যাশ ব্যাকে, বাঙালি নিশ্চিত ভাবে মনে রেখেছে ১৯২১ সালের ৩০ অগস্ট দিনটি। এক ঘণ্টা তিন মিনিটের সেই লড়াই মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী। সেই লড়াই আজও লোকগাথার মত ভারতীয়দের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। সান ফ্রানসিস্কোয় লাইট হেভিওয়েট ফ্রিস্টাইল বিভাগের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্যান্টেলকে হারিয়ে তাঁর শিরোপা নিজের দখলে করে নিয়েছিলেন এক সাহসী শক্তিশালী বঙ্গসন্তান। শুধু শক্তি নয়, উপস্থিত বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা এবং কৌশল— মল্লযুদ্ধের প্রতিটি বিভাগেই স্যান্টেলকে পরাস্ত করে বঙ্গসন্তন গোবর গোহ হয়েছিলেন নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। স্যান্টেলের মত গোবরের কাছে হেরেছেন জো স্ট্রেচার,জিবিস্কো,স্ট্র্যাংলার লুইসের মত প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন৷ বাঙালির চিরকালীন কুস্তি-আইকন, বিশ্বজয়ী গোবর গোহ,আসল নাম যতীন্দ্রচরণ গুহ
বাঙালির চিরকালীন কুস্তি-আইকন। ১৯১৩-১৯১৫ সালে দ্বিতীয় ইউরোপ সফরে স্কটল্যান্ডের সর্বোচ্চ র্যাঙ্কিংপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগির জিমি ক্যাম্পবেল, জিমি এসেনের মতো মল্লবীরদের হারিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন গোবর গোহ।
কুস্তি ছিল তাঁর ধ্যান আর প্রাণ৷ কতজনকে তিনি হাতে পিঠে গড়ে মানুষ করেছেন,তালিম দিয়ে কুস্তিগির বানিয়েছেন তাঁর ঠিকানা পাটিগণিতে মেলাতে গেলে সংখ্যাটা কমপক্ষে কয়েকশো ছাড়িয়ে যাবে৷কালে-কালে তাদের অনেকে ভারতশ্রেষ্ঠ অপেশাদার কুস্তিগির হয়েছেন,তেমন পেশাদারি লড়াইয়ে সুনাম অর্জন করেছেন৷ কুস্তিগির গোবর সংস্কৃতিমনস্ক রুচিশীল বাঙালি যিনি রীতিমত সাহিত্য ও সংগীত চর্চা করতেন। ভারতীয় রাগসংগীতের তালিম নিতেন, বাজাতেন সেতারও। প্রিয় লেখক জর্জ বার্নাড শ এবং অস্কার ওয়াইল্ড। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মান্না দে'র ছোটকাকা কিংবদন্তি কৃষ্ণচন্দ্র দে'র বিশিষ্ট বন্ধু।🌷
স্বনামধন্য কুস্তিগির যতীন্দ্রচরণ গুহ কে সবাই একডাকে গোবরবাবু নামে জানতেন। ১৯, গোয়াবাগান স্ট্রিটে গোবরবাবুর আখড়া, বলতেন নিয়মিত ব্যায়াম না করলে সে আবার পুরুষ মানুষ নাকি।আখড়ায় বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল না,দুঃসহ গ্রীষ্মে ওই হাতের পাখা ভরসা৷ কুস্তির আখড়ার কঠোর প্রশিক্ষক গোবরবাবু। মেজোছেলে মানিক All India heavy weight গ্ৰুপে একবার সেরা কুস্তিগিরের শিরোপা জিতেছেন, লেখাপড়ায় খুব মেধাবী ছাত্র। কাস্টমসের বড় অফিসার হয়েছেন। তবে মানিকের পিতা শুধু ভারত নয় সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয় ,সম্মানীয় যিনি নিজের বাহুবলের পরিচয়ে বাঙালির দুর্নাম ঘুচিয়েছেন৷ বিশ্ব কুস্তির আখড়ায় ভারতের জয়ধ্বজা উড়িয়েছিলেন। মজার কথা গোবরের কুস্তির প্রস্তুতির জন্য যখন পিতৃদেব রামচরণ প্রয়োজনে ভিনদেশি প্রশিক্ষক আনাচ্ছেন তখন তাঁর মাতুল চারুচন্দ্র মল্লিক প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন মাসে হাজার টাকা খরচ করে রাম ছেলেটাকে গুণ্ডা বানাচ্ছে! না সেই ছেলে গুণ্ডা হননি বরং বিশ্বজয়ী হয়েছেন। একমাত্র ভারতীয় যিনি স্বীকৃত মতে সেই সময় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির হতে পেরেছিলেন৷ পালোয়ানি ঐতিহ্য ও পদ্ধতি মূলধন করে ভরা যৌবনে ইউরোপ-আমেকিরা চষে বেড়িয়েছেন, লড়েছেন অসংখ্য বিদেশির সঙ্গে, সেই আমলে আর কোনও মল্লবীর তাঁর মত অসংখ্য বিদেশীর সাথে মোকাবিলার সুযোগ পান নি৷
জালিওয়ানালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন, তখন তিনি লন্ডনে। সেখানেই প্রকাশ্যে রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন জানিয়ে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রকাশ করেন। উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান স্ট্রিটের নাম পরিবর্তন করে এখন গোবর গোহ সরণি।💛
মান্না দে একসময়ে ভেবেছিলেন কুস্তিগির হবেন। গোবর গোহ তাঁর প্রশিক্ষক। All Bengal wrestling competition - এ প্রাথমিক রাউন্ড গুলো জিতে ফাইনালে রাউন্ডে পৌঁছেও গেলেও মান্না আর সেই লড়াই লড়েননি। অবশ্য গোবরবাবুর তিন ছেলে প্রতিষ্ঠিত কুস্তিগির হয়েছিলেন। মেজো ছেলে ভারত সেরা আর তাঁর পিতৃদেব বিশ্বসেরা।
বিশ্বজয়ী বাঙালি মল্লবীর গোবর গোহের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনি প্রমাণ করে দিয়েছেন বাঙালির বাহুবল কম নয়,
বাঙালি দূর্বল নয়, বাঙালি ভীরু নয়...🔥
সংকলনে ✒️ অরুণাভ সেন
♦তথ্যসূত্রঃ ফিরে ফিরে চাই,অজয় বসু, জীবনের জলসাঘর মান্না দে,আনন্দবাজার পত্রিকায় গৌতম ভট্টাচার্যের নিবন্ধ।
ছবি ও তথ্য সংগৃহীত।
© এক যে ছিলো নেতা
কোন মন্তব্য নেই