পহেলগাঁও থেকে বেঁচে ফিরে শিলচরে দেবাশীষ ভট্টার্যের প্রতিবেদন
দেবাশিস ভট্টাচাৰ্য, শিলচরের এক
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান 👇
পহেলগাঁও ও শ্ৰীনগর
আমার মাথার পেছনে স্টেনগানটি ঠেকিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ‘কিসকি নাম লে রহে হো?’ গাছের আড়ালে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছি আমরা৷ মৃত্যুকে এত কাছ থেকে কোনও দিন দেখব দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি৷ অথচ মৃত্যু তখন আমার সামনে ঝুঁকে পড়েছে, মাথার পেছনে ঠেকে রয়েছে মৃত্যুর শীতল স্পৰ্শ৷
ততক্ষণে শুনলাম, কয়েকজন বিড়বিড় করে বলছেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’৷ শুয়ে থেকেই বুঝতে পারলাম ছেলেটি আমাকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে আমার পাশের জনের দিকে৷
আমার শরীর ঠেকে রয়েছিল যাঁর শরীরের ওপর, তাকিয়ে দেখি, সেই ভদ্ৰলোকের ওপর ধপাস করে পড়ল আরও একজনের রক্তাক্ত লাশ৷ কপালে গুলি লেগেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে লোকটির৷ আমার পাশের ভদ্ৰলোকটির শরীরে ছিটকে পড়েছে তাজা রক্ত৷ তাকিয়ে দেখি, আমার জ্যাকেটেও লেপ্টে রয়েছে সেই অজানা পৰ্যটকের রক্তের দাগ৷ তখনও তাজা৷
ততক্ষণে মৃত্যু উপত্যকায় পাল্টে গেছে ভূস্বৰ্গের ‘মিনি সুইজারল্যান্ড', বৈসরন ভ্যালি৷
অথচ আজ বেলা সাড়ে এগারোটায় যখন পহেলগাঁও পৌঁছই, বা এদিক-সেদিক ঘুরে দুপুর দেড়টায় যখন টিকিট কেটে বৈসরন ভ্যালিতে আসি, তখনও কাশ্মীরের সেরা এই টুরিস্ট স্পটে শুধুই পৰ্যটকদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস৷ কম করেও শ’ পাঁচেক পৰ্যটক ভিড় করে রয়েছেন বৈসরন ভ্যালিতে৷ আনন্দ করছেন, ফটো তুলছেন৷ আনন্দ করারই কথা, প্ৰকৃতি এখানে দু’হাত উজাড় করে দিয়ে বৈসরন ভ্যালিকে সাজিয়েছে৷ ৮০০ মিটারের গোলাকৃতি একটি স্পট, সবুজ ঘাসের গালিচা, চারপাশে বরফে ঢাকা পাহাড়৷ পুরো স্পটটি ফেন্সিং দিয়ে ঘেরা৷ এখানে পা দিলে সত্যিই মনে হয়, স্বৰ্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তা হলে এখানেই রয়েছে৷ তখনও কি জানি, আর কিছুক্ষণের মধ্যে এই জায়গাটাই হয়ে উঠবে এক বধ্যভূমি? তখনও কি জানি, আর কিছুক্ষণ পর এখানেই এত এত লাশ চোখের সামনে পড়তে দেখব!
গতকাল শ্ৰীনগর পৌঁছেছি৷ রাতে শিকারায় ছিলাম৷ আজ সকাল সকাল পহেলগাঁও রওনা হয়েছি৷ পথে বিএসএফ ও অন্য বাহিনীর ছাউনি দেখেছি কিছুক্ষণ পরপরই৷ কিন্তু রাস্তায় সেভাবে বন্দুকধারী জওয়ানের টহল দেখিনি৷ শুনলাম, এই সময় পহেলগাঁওয়ে ভিড় জমান সারা দেশের পৰ্যটকরা৷ আর উগ্ৰবাদীরা কখনওই নাকি টুরিস্টদের আক্রমণ করে না৷ ফলে বৈসরন ভ্যালিতে কোনও নিরাপত্তা রক্ষী সেভাবে চোখে পড়েনি৷
পহেলগাঁও পৌঁছই বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ৷ সেখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের ওপর এই বৈসরন ভ্যালিতে পৌঁছেছি দুপুর দেড়টায়৷ সামনের দিকের গেটগুলোতে পৰ্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে, তাই আমাদের গাড়ির চালক আমাদের পেছনের চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে বলে দিয়েছিলেন৷ টিকিট কেটে ফেন্সিঙে ঘেরা চার নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেছি৷ তখনও গেট থেকে পঞ্চাশ মিটারের মধ্যেই ছিলাম আমরা৷ আমি, আমার স্ত্ৰী মধুমিতা দাস ভট্টাচাৰ্য ও ছেলে৷ আমার স্ত্ৰীকে একজন স্থানীয় ফেরিওয়ালা চাদর দেখাচ্ছেন৷ আমি ব্যস্ত ফটো তোলায়৷ ঠিক তখনই শুনলাম শব্দটি৷ গুলির শব্দ না?
ফেরিওয়ালা বললেন, না সাহাব, এখানে বড় বাঁদরের উপদ্ৰব, ট্যুরিস্টদের বড় জ্বালায়, তাই ফরেস্টের লোকেরা মাঝেমধ্যে খেলনা বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ে বাঁদর তাড়ায়৷ ঠিক তক্ষুণি আমার ছেলের চোখে পড়ল, এক দম্পতির পাশে দাঁড়িয়ে একটি যুবক স্টেনগান থেকে সরাসরি গুলি ছুড়ল৷ লোকটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে৷ তখনও বুঝিনি কী ঘটতে চলেছে৷ ফেন্সিং ডিঙিয়ে ঢুকে পড়েছে কয়েকটি ছেলে৷ বাইরে দাঁড়িয়ে আরও জনাকয়েক৷ সবমিলিয়ে সাত-আটজন৷ কারোর মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা নয়৷ হাতে স্টেনগান৷ কিন্তু টানা গুলি চালাচ্ছে না, লোক দেখে এক এক করে ট্ৰিগারে চাপ দিচ্ছে৷
এরপরই গোটা দৃশ্য মুহূৰ্তে পাল্টে গেল৷ চারদিক থেকে অন্তত পনেরো-কুড়িটি গুলির শব্দ পরপর শোনা গেল৷ না, একটানা নয়, থেমে থেমে৷ তাকিয়ে দেখি, টুপটাপ লুটিয়ে পড়ছে মানুষ৷ আনন্দ-উল্লাস ততক্ষণে পাল্টে গেছে আৰ্তচিৎকারে৷ শুনলাম, কেউ চিৎকার করে বলছেন, বাসের নিচে লুকিয়ে পডুন৷
আমরা তিনজন প্ৰাণপণে ছুটে গিয়ে গাছের আড়ালে শুয়ে পড়ি৷ মুহূৰ্তে ভরে যায় গাছের পুরো নিচের অংশটা৷ সেখান থেকে শুয়ে দেখি, এক ভদ্ৰলোক বাসের সামনে দৌড়ে এসেছেন, কোনদিক থেকে নিচে ঢুকবেন, সেটা খুঁজে বের করতে পারছেন না৷ কয়েক সেকেন্ডের দোনামোনা, বিলম্ব৷ এরপরই গুলির শব্দ৷ আমার চোখের সামনে লুটিয়ে পড়লেন মানুষটি৷
এভাবে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর যখন বুঝলাম ছেলেগুলো অন্যদিকে সরে গেছে, আমরা প্ৰচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে ওই চার নম্বর গেট দিয়ে ফেন্সিং ডিঙিয়ে সোজা নিচে নামতে শুরু করলাম৷
নামছি আর নামছি৷ চড়াই আর উতরাই৷ তখনও অন্তত ১০ মিনিট ধরে গুলির আওয়াজ শুনেছি৷
আমার কোলে এক পৰ্যটকের একটি শিশু৷ সঙ্গে রয়েছেন উত্তরাখণ্ডের এক মহিলা ও তাঁর শিশু সন্তান, এবং আর কয়েকজন৷ আমাদের পরনের কাপড় ছিঁড়ে যাচ্ছে কাঁটাগাছের খোঁচায়৷ আমার জ্যাকেটে লেগে থাকা সেই অপরিচিত লোকটির রক্তের দাগ আস্তে আস্তে শুকিয়ে কালো হয়ে উঠছে৷
এভাবে প্ৰায় দু ঘণ্টা ধরে আমরা ভূস্বৰ্গের সেই ঐশ্বরিক পাহাড় থেকে মৃত্যুকে মাথায় নিয়ে নেমে আসার পর দেখা পেলাম এক মহিলার৷ তখনও পাহাড় থেকে রাস্তা আরও বেশ খানিকটা বাকি৷ গ্ৰামের ওই মহিলার হাতে গোবর মাখা৷ সেই মহিলাই আমার মোবাইল থেকে ড্ৰাইভারকে ফোন করলেন, স্থানীয় ভাষায় আমরা কোথায় রয়েছি, সেটা বুঝিয়ে বললেন৷ ভাগ্যিস যাঁর ঘোড়ায় চেপে আমরা বৈসরন ভ্যালিতে উঠেছিলাম, সেই লোকটিকেও পেয়ে গেলাম৷
মুশকিল হল, আমাদের সঙ্গে ছত্তিশগড়ের যে মহিলা নেমে এসেছেন, তাঁকে এভাবে একা ফেলে আমরা যাবো কী করে৷ ভাগ্য ভালো ওই মহিলার গাড়ির চালককেও ফোনে পাওয়া গেল, তিনি আশ্বাস দিলেন, নিরাপদে পৌছে দেবেন মহিলা ও তাঁর শিশু সন্তানকে৷
অবশেষে আমাদের ফেরার যাত্ৰা শুরু হল৷ ততক্ষণে পাল্টে গেছে ভূস্বৰ্গের চিত্ৰ৷ সকালেও যেখানে দেখেছি শান্তি আর শান্তি, সন্ধেয় ফেরার সময় সেই শান্তি খানখান করে বেজে চলেছে পাগলা-সাইরেন৷
গাড়িতে আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছি৷ কিছুই যেন আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না৷ ড্ৰাইভারের কাছ থেকেই শুনলাম, অন্তত তিনজন ঘোড়াচালকও মারা গেছেন৷ এবং তাঁরা স্থানীয় মুসলিম৷
আটটা নাগাদ শ্ৰীনগরের হোটেলে পৌছে টিভিতে দেখলাম, বাইসাং ভ্যালিতে উগ্ৰপন্থ হামলায় নিহত ২৭৷
জ্যাকেটটা খুলতে গিয়ে দেখি, রক্তের দাগ তখন গাঢ় কালো হয়ে উঠেছে৷
(দেবাশিস ভট্টাচাৰ্য আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক৷ টেলিফোনে তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়ে অনুলিখন করেছেন অরিজিৎ আদিত্য)৷
কোন মন্তব্য নেই