Header Ads

চট্টগ্রামের বৃদ্ধ বিনোদ বিহারী এই বয়সেও বন্দুক হাতে লড়াই করতে চ্য়েছিলেন

১০৩-এও বন্দুক ধরতে তৈরি চট্টগ্রামের বিনোদবিহারী
         
    ✍️ প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত

ময়দানে ফুটবল খেলা দেখে ফিরছিল ছেলে। গাড়ির ধাক্কায় সাত দিন কোমায়। তার পর শেষ।

সেটা ১৯৮২-র কথা। এ বছর দশমীর দিনে আবার পুত্রবিয়োগ। এ বার ছোট ছেলে। ফুসফুসে ক্যানসার।

বারাসতে সেই ছেলের বাড়িতেই মৎস্যমুখের পরদিন যখন আপ্যায়ন করছেন বাবা, তখন অদ্ভুত এক প্রশান্তি তাঁর মুখে!

১০৩ বছরের বৃদ্ধ বিনোদবিহারী চৌধুরী।

মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। জীবনের লড়াই আজও থামেনি। এর মধ্যেই দেখে নেওয়ার ইচ্ছে বেদব্রত পাইনের ছবি ‘চিটাগং’। ছবির চরিত্রদের মধ্যে একমাত্র জীবিত সৈনিক, বিনোদবিহারী।

ফ্রেমে বাঁধানো ছেলের ছবির উপরে রজনীগন্ধার মালাটা তখনও শুকোয়নি। ছেলের সদ্য মৃত্যুর কথা বলেই চলে গেলেন মাস্টারদার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের স্মৃতিতে।

চট্টগ্রামের অভয় মিত্র শ্মশানে তখন রাত প্রায় আটটা। হঠাৎ পিছন থেকে একটা হাত পিঠে। চমকে যেতেই মাস্টারদা বললেন, কী গো চমকে উঠলে কেন? ভূত, প্রেত, সাপ আছে। মাস্টারদা বললেন, ভূত প্রেত বলে কিছু হয় না। সাপের ভয় থাকতে পারে। মাস্টারদা বলেছিলেন, ‘তোমাকে দলে নেব না।’ বিনোদের উত্তর ছিল, ‘দলে তো আমি এসেই গিয়েছি। আপনি নেওয়ার কে?’ মাস্টারদা বললেন ‘আমি দলের নেতা।’ ‘তাই বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

বিনোদবিহারী মেধাবী ছাত্র। মাস্টারদার যুক্তি, পড়াশোনা করে সে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারবে। আবার দেখা হল কিছু দিন পরে। চট্টেশ্বরী মন্দিরে। এ বার বিনোদ বললেন, “আপনি যদি আমাকে দলে না নেন, আমি অন্য দলে যোগ দেব। দল কি আর নেই?” তখন মাস্টারদা বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাস্টারদাকে ‘থ্রেট’ করতে ভয় হয়নি? “না। ভয় হল মনের একটা দুর্বলতা। প্রথম দিন যখন হাতে বন্দুক তুললাম, সে দিনও ভয় পাইনি। আজও বন্দুক চালাতে পারব।”

জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে একের পর এক সঙ্গীরা প্রাণ হারাচ্ছেন। মারা যাওয়ার আগে বলে যাচ্ছেন, আমি চললাম। তোমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করবে। বিনোদের গলার বাঁ দিকে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল স্প্লিনটার। আধ ঘণ্টা জ্ঞান ছিল না। সতীর্থরা আলোচনা করছিলেন, কম কষ্টে মরতে দিতে হলে বিনোদকে গুলি করে দেওয়া উচিত। “লোকাদা (লোকনাথ বল) বলেছিলেন, বিনোদকে কেউ মারবে না। তাই বেঁচে গিয়েছিলাম।”

পাহাড় থেকে নেমে একটা শনের খেতে কোনও মতে রাত কাটল। স্প্লিনটার-বিদ্ধ গলাটা এক টুকরো কাপড়ে জড়ানো। পরের দিন সঙ্গীদের এগিয়ে যেতে বললেন বিনোদ। নিজে হেঁটে হেঁটে প্রায় দু’টো রেলস্টেশন পেরিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ি পৌঁছলেন কুমিরাতে। কুড়ি দিন ছিলেন সেখানে। তার পর একদিন পুলিশ আসবে টের পেতেই ঘোমটা দিয়ে মহিলার ছদ্মবেশে পালালেন।

কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে আসে। “মামণি, একটা কাঁথা দাও তো,” পুত্রবধূকে বলেন বিনোদবিহারী। কাঁথাটা জড়িয়ে দিতে দিতে পুত্রবধূ বলেন, “আমাদের ভয় ছিল, কী ভাবে উনি এই শোকটা মেনে নেবেন। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পরেও চট্টগ্রামে খবর দিইনি। কিন্তু রোজ সকালের ডিমটা না দেওয়াতেই বুঝতে পেরেছিলেন।”

এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে বিনোদ বলতে থাকেন, “গা ঢাকা দিয়েছিলাম সিন্ধওয়ারা জেলার দাতলা কয়লাখনিতে। ওখানে মাসিক তিরিশ টাকার চাকরি পেলাম। সেখানেও পুলিশ ধাওয়া করল।”

বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করেছেন। জামশেদপুর... ঢাকা... সিঙ্গাপুর। শেষে নিজেই ধরা দেন। জেলের মধ্যে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, আলো জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতেন বিনোদবিহারী। জেল থেকে বেরিয়ে ইংরেজিতে এমএ আর আইন পরীক্ষা দিলেন।

কিন্তু চাকরি করেননি কখনও। প্রাইভেট টিউশনি করে গিয়েছেন সারা জীবন। চট্টগ্রামের ভিটে ছেড়ে কোথাও নড়েননি। সবাইকে বলে রেখেছেন, কলকাতায় এসে যদি কোনও অঘটন ঘটে, ওঁর দেহ যেন চট্টগ্রামেই পাঠানো হয়।

মন দিয়ে ক্রিকেট দেখেন। “আমরা সুপুরি দিয়ে বল তৈরি করে জেলের ভেতরে ক্রিকেট খেলতাম। বিরাট কোহলির খেলায় একটা মাধুর্য আছে। যুবরাজের কামব্যাকটা অসাধারণ..!” টর্চ জালিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজ পড়েন রোজ। বললেন, “অনেকেই বলেন চট্টগ্রাম ‘লুণ্ঠন’। আমরা ‘লুণ্ঠন’ করিনি। ওটা আমাদের অধিকার ছিল।” বেদব্রত পাইনের ছবিটা দেখা হয়নি এখনও। “বেদব্রতবাবু বলেছেন, ছবিটা দেখাবেন। বাংলাদেশ ফিরে যাওয়ার আগে ‘চিটাগং’ দেখে যেতে চাই।”

মৃত্যুভয় শব্দটা বিনোদবিহারীর অভিধানে নেই। মনে রাখেন জন ডানের একটা কবিতার লাইন ওয়ান শর্ট স্লিপ পাস্ট, উই ওয়েক ইটারনালি। অ্যান্ড ডেথ শ্যাল বি নো মোর। ডেথ, দাও শ্যাল্ট ডাই।

( This article was written in  2013 a few days before Benod Behari Choudhury died )(  নয়া ঠাহর সম্পাদক অমল গুপ্তের  
  সংযোজন : মেরুদণ্ডহীন বাঙালিদের  পোস্ট টি পড়ে শিক্ষা  নেওয়া উচিত  )


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.