গানের জগতে তিনি ছিলেন আকাশ তারা ধরা যায়না
দক্ষিণ মুম্বাইয়ের "আকাশগঙ্গা" অ্যাপার্টমেন্টের সাত তলায় তিনি থাকতেন। ১৩ই অক্টোবর, ২০১৮ সালের আগে অবধি, তাঁর প্রতিবেশীরা প্রায় কেউই তাঁর সম্মন্ধে বিশেষ কিছু জানতেন না। এমনকি, তেমন কেউ তাঁকে কখনও চোখেও দেখেননি। তারা শুধু এইটুকু জানতেন যে তাঁর ফ্ল্যাটের আশেপাশে সবসময় একটা অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ বিরাজ করে। শুধুমাত্র গভীর রাতের অন্ধকারেই সেখানকার থমথমে নিস্তব্ধতার মধ্যে কিছু অনুরণন অনুভব করা যায়। গভীর রাত্রে মাঝে মাঝে শোনা যায় গুরু গম্ভীর সব যান্ত্রিক স্বর, কিছু সম্মোহনী শব্দ। মনে হয় কে যেন অন্ধকার রাত্রির উপাসনা করছে। কোনো কোনো পূর্ণিমার রাত্রে মনে হয় কেউ বুঝি জ্যোৎস্নার সুরে কথা বলছে। সেই ফ্ল্যাটের দরজায় বিশেষ বিজ্ঞপ্তি স্বরূপ লেখা রয়েছে - "সোমবার ও শুক্রবার দরজা খোলা হয় না। শুধুমাত্র তিনবার door bell বাজাবেন, যদি ভিতর থেকে কেউ দরজা না খোলে, তাহলে দয়া করে নিজের নাম ও ঠিকানা লিখে রেখে যান । আপনার অসুবিধার জন্য দুঃখিত। সহযোগীতার জন্য ধন্যবাদ।"
The Indian Express- এর পক্ষ থেকে, সুয়াংসু খুরানা (Suanshu Khurana) একবার এই মানুষটির সাথে দেখা করার অসম্ভব চেষ্টাটি করেছিলেন। আর যোগাযোগ করতে গিয়েই জানতে পারলেন, এই মানুষটির কোনো email address নেই, কোনো fax নম্বর নেই, এমনকি তিনি ফোনও তোলেন না। অগত্যা, তিনি সেই ঠিকানায় নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিতে এও লিখলেন যে তিনি সাহানা গুপ্তা-র পরিচিতা। সাহানা গুপ্তা এই আত্ম প্রচার বিমুখ মানুষটির নিকট আত্মীয়া। হয়ত সেই কারণের জন্যই, সপ্তাহ তিনেক বাদে, তিনি রঞ্জন ভাথিয়াথ (Ranjan Vathiyath) নামের একজন মানুষের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। যে চিঠিতে সেই অধরা মানুষটির সমন্ধে লেখা ছিল, 'তিনি একজন অত্যন্ত একাকিত্ব প্রিয় মানুষ। কারোর সাথে দেখা করা বা কোনো রকম সাক্ষাৎকারের জন্য তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহী নন। যেহেতু আপনি মিস গুপ্তার পরিচিতা, তাই তিনি শুধুমাত্র চিঠির মাধ্যমে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবেন।' এর পরেই সুয়াংসু খুরানা, কিছু প্রশ্ন সমেত তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। প্রায় দেড়মাস বাদে, একটি হলুদ খামের ভিতর, পরিচ্ছন্ন ভাবে টাইপ করা ছয় পাতার একটি উত্তরপত্র আসে। যার letterhead- এ পরিষ্কার লেখা রয়েছে -
"পদ্মভূষণ ড: অন্নপূর্ণা দেবী"।
'মা অন্নপূর্ণা' - তাঁকে এই নামেই ডাকতেন তাঁর ছাত্ররা।
১৩ই অক্টোবর, ২০১৮ সালে, মুম্বাইয়ের Breach Candy হসপিটালে, ৯২ বছর বয়সে অন্নপূর্ণা দেবী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগের দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতক তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে ছিলেন। এই অনন্য প্রতিভাময়ী মানুষটি ছিলেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরবাহার শিল্পী, বাবা আলাউদ্দিনের আদরের ছোট মেয়ে ও পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রথমা স্ত্রী। জীবনের একটা সময়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে আর কোনদিনও প্রকাশ্য মঞ্চে তিনি তাঁর যন্ত্র সঙ্গীত পরিবেশন করবেন না - বাকি সমস্ত জীবন অক্ষরে অক্ষরে সে প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন মা অন্নপূর্ণা। নিজের বেছে নেওয়া এই দীর্ঘ নির্বাসনের জীবনে, তিনি বিনামূল্যে তাঁর ছাত্রদের শিক্ষা দান করেছেন এবং শুধুমাত্র গভীর রাত্রে, সকলের অনুপস্থিতিতে সুরবাহারে নিজেকে প্রসারিত করেছেন রেওয়াজে।
তিনি কখনও তাঁর বাজনার কোনো রেকর্ডিং করেননি। তাই স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে তাঁর কোনো একটি বা দুটি অনুষ্ঠানে বাজানোর অস্পষ্ট কিছু রেকর্ডিং। এমনকি ছাত্রদের শেখানোর সময়ও তিনি কখনও কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতেন না বলে জানা যায়।
তাঁর সম্মন্ধে যা কিছু জানা যায়, তা তাঁর দেওয়া হাতে গোনা কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও তাঁর স্বনামধন্য ছাত্রদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন - পণ্ডিত নিখিল বন্দোপাধ্যায়, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, নিত্যানন্দ হলদীপুর, বিনয় ভারত রাম, রসিকুমার পান্দেয়া, বাহাদুর খান, হিরেন রায়, আশিস খান, ধ্যানেশ খান, বসন্ত কাব্রা, অমিত ভট্টাচার্য, অতুল মার্চেন্ট, সুরেশ ব্যাস, প্রদীপ কুমার বারোট, দক্ষিণা মোহন ঠাকুর প্রমুখ আরো অনেকে।
বাড়ির নাম 'মদিনা ভবন'। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের চৈতি পূর্ণিমা তিথিতে (16th April, 1927) মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের কাছে, মাইহার প্রদেশের সেই বাড়িতেই, মা মদন্মঞ্জরি দেবী ও বাবা আলাউদ্দিন খানের ঘরে জন্ম নিলেন রোশনারা খান। পরে, মাইহার এস্টেটের রাজা বৃজনাথ সিং তাঁর নাম রাখেন অন্নপূর্ণা। বাবা আলাউদ্দিন সেসময়ের মার্গসংগীতের দিকপাল সাধক ও পথপ্রদর্শকই শুধু ছিলেননা, তিনি মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ও মাইহার রাজসভার সভাগায়কও ছিলেন।
বিশুদ্ধ সাংগীতিক চিন্তা ও সঙ্গীত সাধনার পরিবেশের মধ্যে বড়ো হয়ে উঠতে থাকেন অন্নপূর্ণা। অথচ তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয় অনেক দেরীতে। তার কারণ বাবা আলাউদ্দিন, ছোটো মেয়ের সঙ্গীত শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা হয়তো দ্বিধা বোধ করেছিলেন। বড় মেয়ে জাহানারাকে প্রাণ ঢেলে গান শিখিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িতে তাঁর সঙ্গীতচর্চা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমনকি তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার কারণে তাঁকে সেখানে অনেক অশান্তিও ভোগ করতে হয়। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাই হয়ত বাবার দ্বিধার কারণ ছিল। কিন্তু বাবা তাঁর ছাত্রদের যা কিছু শেখান, তা মনোযোগ দিয়ে শুনে, সযত্নে মনে রেখে দিতেন অন্নপূর্ণা। একদিন, দাদা আলি আকবর রোজকার মতো তাঁর অনুশীলন অভ্যাস করছেন। অন্নপূর্ণা নিজের মতো খেলছিলেন, কিন্তু কান ছিলো দাদার বাজনার দিকে। হঠাৎ তাঁর কানে ধরা পড়লো যে দাদা একটু ভুল বাজাচ্ছেন। খেলা থামিয়ে, দাদার কাছে এসে মুখে মুখে সুর করে বোঝাতে থাকলেন, বাবা ঠিক কি বাজাতে বলেছিলেন। দাদাকে বোঝাতে এতই মগ্ন ছিলেন তিনি যে লক্ষ্যই করেননি কখন বাবা এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন। বাবার সাথে চোখাচোখি হতেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন অন্নপূর্ণা, এই বুঝি বাবা বকা দিলেন। কিন্তু বাবা তাঁকে কিছুই বললেন না, কারণ তিনি তাঁর ছোটো মেয়ের মধ্যে, সঙ্গীতের প্রতি সত্যিকারের আগ্রহ খুঁজে পেলেন। নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে একটি তানপুরা দিলেন। সেই থেকে শুরু হলো মা অন্নপূর্ণার তালিম।
ধ্রুপদী কণ্ঠ সঙ্গীত দিয়ে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। তারপর কিছু বছর বাবার কাছে সেতার শিখেছিলেন অন্নপূর্ণা। একদিন বাবা একটি নতুন যন্ত্রের সাথে তাঁর পরিচয় করালেন-যার নাম সুরবাহার। সুরবাহার সেতারের মতো ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে যাওয়া সুরের ঝর্ণা নয়। গম্ভীর, করুণ ও ধ্যানমগ্ন শান্ত রসের এক অনবদ্য মিশ্রণ হল সুরবাহার।
বাবা আলাউদ্দিনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে তাঁর গুরুর থেকে পাওয়া, সঙ্গীতের অমূল্য উপহার, স্বযত্নে আদৃত হবে অন্নপূর্ণার কাছে। কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন যে তাঁর মেয়ের মধ্যে রয়েছে সঙ্গীতের প্রতি এক অমোঘ ও নির্লোভ ভালোবাসা। সুরবাহার শিক্ষা শুরু করার আগে, মেয়েকে বলেছিলেন যে যদি তিনি সুরবাহার বাজাতে চান, তবে তাঁকে সেতার বাজানো ছাড়তে হবে, এবং আরও বলেছিলেন, "সেতার, সমঝদার ও সাধারণ শ্রোতা, উভয়েরই প্রিয়। কিন্তু সুরবাহার সবার জন্য নয়। সঙ্গীতের বিষয় যাদের প্রগাঢ় জ্ঞান, শুধুমাত্র সেই সমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তিরাই সুরবাহারের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবেন এবং তার রসস্বাদন করতে পারবেন।"
পরবর্তী কালে মা অন্নপূর্ণা বলেছিলেন, "এখন যখনই সুরবাহার বাজাই, সমর্পণ ও প্রশান্তি মিশ্রিত একটি মোহিত করা অনুভূতি অনুভব করি।"
বাবার কাছে কিছু বছর ধরে সুরবাহারের তালিম নিয়ে, অন্নপূর্ণা হয়ে উঠছিলেন একজন যথাযথ শিল্পী। মাইহারের রাজার দরবারে সুরবাহার বাজিয়ে, তাঁকে মুগ্ধ করেছিলেন। রাজামশাই পুরস্কার স্বরূপ দিয়েছিলেন কয়েক বিঘা জমি।
এই সময়েই, ১৯৩৮ সাল নাগাদ, রবীন্দ্র শংকর চৌধুরী নামের এক যুবক বেনারস থেকে মাইহারে আসেন, বাবা আলাউদ্দিনের কাছে সেতার শেখার জন্য। পরবর্তীকালে, সারা বিশ্ব যাঁকে চিনেছিল পণ্ডিত রবিশঙ্কর নামে। দাদা উদয় শঙ্কর ছিলেন বাবা আলাউদ্দিনের গুণমুগ্ধ ও কাছের মানুষ। উজ্জ্বল ও প্রতিভাময়ী অন্নপূর্ণা দেবীকে দেখে, উদয় শঙ্কর-ই প্রথম তাঁকে তাঁর ভাতৃবধু হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। বাবা আলাউদ্দিন সানন্দে মেনেও নেন সেই প্রস্তাব। নিজে মুসলমান হলেও, ব্যক্তিগতভাবে বাবা আলাউদ্দিন ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার মানসিকতার মানুষ। নিজে মা সরস্বতীর পূজা করতেন আবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তেন।
১৯৪১ সালের ১৫ই মে, সকালে, অন্নপূর্ণা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেন। এবং সেদিন বিকেলে হিন্দু মতে বিয়ে হল অন্নপূর্ণা ও রবিশঙ্করের। অন্নপূর্ণা তখন চোদ্দো-পনেরো বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে এবং রবিশঙ্কর তখন একুশ বছরের প্রদীপ্ত যুবক।
[# হৃশিকেস মুখার্জীর পরিচালিত, অমিতাভ ও জয়া বচ্চন অভিনীত, ' অভিমান ' ছায়াছবির চিত্রনাট্য যেন সেদিন থেকেই লেখা শুরু হল।#]
১৯৪২ সালে, বিয়ের এক বছরের মাথায়, পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা দেবীর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। তাঁর নাম ছিল সুভেন্দ্র শঙ্কর (শুভ)।
১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, স্বামী পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও মা অন্নপূর্ণা একসাথে বেশ কিছু মঞ্চে যন্ত্রসংগীত পরিবেশনা করেন। কখনও,কোনও মঞ্চে, মা অন্নপূর্ণা একক সঙ্গীত পরিবেশনা করেছেন- এমনটা শোনা যায়নি কখনও। প্রকাশ্য মঞ্চে খুব কম অনুষ্ঠান পরিবেশন করলেও, সেই অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়েছেন ভূয়সী প্রশংসা ও অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত। সত্যিকারের সঙ্গীত বোদ্ধা ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা অনুভব করেছিলেন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও ওস্তাদ আলি আকবরের তুলনায় অনেক বেশি সঙ্গীত প্রতিভার অতুল ঐশ্বর্য্য নিয়ে জন্মেছিলেন মা অন্নপূর্ণা। ওস্তাদ আলি আকবর নিজে এই ভাবনাকে সমর্থন করে বলেছেন, 'যদি দাড়িপাল্লা একদিকে রবিশঙ্কর, পান্নালাল (ঘোষ), আর আমাকে রাখো, অন্যদিকে শুধু অন্নপূর্ণা- তবে তাঁর দিকটাই ভারী হবে।'
[# সেই সুবর্ণ যুগে, গুণী মানুষরা একে অপরের প্রাণ খুলে প্রশংসা করতে পারতেন। কোনো কৃপণতা দেখাতেন না। যেমন, শঙ্কর-জয়কিসান একবার এমনই এক উপমা দিয়ে বলেছিলেন- 'যদি আমাদের সৃষ্টি করা সমস্ত গান দাড়িপাল্লা একদিকে রাখা হয়,আর একদিকে শ্রী মদনমোহন-এর "লগ যা গলে, কে ফির ইয়ে হসিন রাত হো না হো..." গানটি রাখা হয়, তাহলে তাঁর ঐ একটি গান, আমাদের সমস্ত গানের তুলনায় পাল্লায় ভারী প্রমাণিত হবে।'#]
ওস্তাদ আমীর খাঁ সাহেব বলেছিলেন, "অন্নপূর্ণা দেবী, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের আশি শতাংশ পেয়েছেন, আলি আকবর সত্তর এবং রবিশঙ্কর চল্লিশ।"
পণ্ডিত রবিশঙ্করের এক ছাত্র, শ্রী মদনলাল ভ্যাস (Madanlal Vyas) যিনি দীর্ঘদিন The Navbharat Times-এর সঙ্গীত সমালোচকও ছিলেন তিনি লিখেছিলেন,"প্রতিটি যুগলবন্দী অনুষ্ঠানের পর, অন্নপূর্ণা দেবীকে ঘিরে ধরতেন উচ্ছ্বসিত শ্রোতারা। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেটা মেনে নিতে বেশ অসুবিধাই হত। অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন একজন অভূতপূর্ব প্রতিভাময়ী শিল্পী। তাঁর সঙ্গীত এই পৃথিবী থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।"
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও মা অন্নপূর্ণার সঙ্গীত প্রতিভার এই বিস্তর ব্যবধান ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁদের ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনেও। একসময় এই ব্যবধান বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হয়। বলা হয়, নিজের সংসার বাঁচাতেই, বাবা আলাউদ্দিন ও মা সরস্বতীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অন্নপূর্ণা দেবী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আর কোনদিনও প্রকাশ্য মঞ্চে তিনি তাঁর সঙ্গীত পরিবেশনা করবেন না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন। প্রকাশ্য মঞ্চ শুধু নয়, কোনদিনও অন্য কোনো মানুষের সামনেও তিনি তাঁর সুরবাহার বাজান নি।
এতকিছুর পরও, শেষ রক্ষা হল না....
[# 'অভিমান' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের সাথে বাস্তবের ঐটুকু অমিল রয়ে গেল।#]
১৯৫৬ সাল নাগাদ, পণ্ডিত রবিশঙ্করের সাথে সাময়িক সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে, মা অন্নপূর্ণা শুভকে নিয়ে মাইহার চলে যান। পরে অবশ্য ফিরেও আসেন। ১৯৬২ সালে (মতান্তর ১৯৮২) আইনত বিবাহ বিচ্ছেদের পর, মা অন্নপূর্ণা শুভকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে মুম্বাইতে চলে আসেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর বাকি জীবন কাটান।
অপরপক্ষে, পণ্ডিত রবিশঙ্কর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমাদের বিয়ে হওয়া অবধি, আমি একরকম জোর করে অন্নপূর্ণা-কে আমার সাথে বাজাতে নিয়ে বসতাম। আমার সাথে ছাড়া অন্নপূর্ণা কখনই একা বাজাতে চাইতোনা। আর আমাদের বিচ্ছেদের পর, সে পাকাপাকি ভাবে ঠিক করে যে আর কখনই অনুষ্ঠান করবে না। হয়ত ও ভিড় অপছন্দ করে বা বেশি মানুষ দেখলে ঘাবড়ে যায়। কারণ যাই-ই হোক, সে স্বেচ্ছায় বাজানো বন্ধ করেছে। তাঁর মতো একজন গুণী শিল্পীর সঙ্গীত পরিবেশন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা, সত্যিই অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।"
পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "অন্নপূর্ণা আমাকে সবসময় সন্দেহ করতো। আর আমিও তখন সমস্ত কিছু বোঝার অবস্থায় ছিলাম না। সে সত্যিই একজন অত্যন্ত প্রতিভাময়ী শিল্পী। কিন্তু তার বাবার মতো, সেও প্রচন্ড রাগী মানুষ। আর সেসময় আমিও ভীষণ রাগী ছিলাম। তাই সম্পর্কের বিচ্ছেদ হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী।"
[# মা অন্নপূর্ণা, তাঁর সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞার ব্যতিক্রম জীবনে শুধুমাত্র একবারই করেছিলেন। একজন বিশেষ মানুষকে তিনি তাঁর গভীর রাতের রেওয়াজের সময়, সেই ঘরে উপস্থিত থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন - আরেকজন ততোধিক বিশেষ মানুষের অনুরোধে। সেই অত্যন্ত সৌভাগ্যবান 'বিশেষ' মানুষটির নাম George Harrison। সেই আর সেই 'ততোধিক বিশেষ' মানুষটির কথা আগামী পর্বে লিখবো #]
পৃথিবীর বিস্মৃতপ্রায় এই শিল্পী নিজের জীবনের শেষের দিকের একটি সাক্ষাৎকারের উত্তরপত্রে লিখেছিলেন, "আমার কাছে সঙ্গীত হল ঈশ্বরকে অঞ্জলি দেওয়া, তাঁর কাছে সমর্পণ করা। তাই, প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করা বা রেকর্ড করার কথা কখনও মনে হয়নি....."
"আমার মনে হয়না আমি আমার শ্রোতাদের, আমার সঙ্গীতের থেকে বঞ্চিত রেখেছি। আমার বাবার থেকে আমি যত টুকু শিখেছি, আমার ছাত্রদের আমি তাইই শিখিয়েছি। ওরা রইলো, ওরাই সঙ্গীতের এই অনন্ত প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যাবে....."
"যখন আমি আমার ছাত্রদের সঙ্গীত শেখাই, তখন মনেহয় আমি খুব শান্তিতে আছি। পশ্চিমের বারান্দায়, পায়রাদের খাওয়ানোর সময়, রাত্রে রেওয়াজ করতে বসে মনেহয়, আমি খুব ভালো আছি....."
তিনি তাঁর ছাত্রদের সেতার, সরোদ, বাঁশি ও কণ্ঠসঙ্গীত শিখিয়েছেন, কিন্তু সুরবাহার কখনও কাউকে শেখাননি। হয়ত ঐটুকুই ছিল মধ্যরাত্রির একান্তে, ঈশ্বরকে অর্পণ করা ওনার অঞ্জলি। যে সময় তাঁর পেলব আঙ্গুলের ছোঁয়ায়, ধ্যানমগ্ন সুরবাহার করুণ সুরে কেঁদে উঠত আর সেই সমর্পিত সুরধারা আঁচলা ভরা ফুল হয়ে ঝড়ে পড়ত মা সরস্বতীর পদপদ্মে, বাবা আলাউদ্দিনের চারণকমলে।।
ক্রমশ....
কৈফিয়ত ১ # মা অন্নপূর্ণার জন্ম তারিখ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। কোথাও বলা আছে ১৫ই এপ্রিল, কোথাও ২৩ সে এপ্রিল। তাঁর ছাত্ররা চৈতি পূর্ণিমা তিথিকেই তাঁর জন্মদিন হিসেবে উদযাপন করতেন এবং আমার বিশ্বাস করেন। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের চৈতি পূর্ণিমা তিথি ছিল ১৬ই April, ১৯২৭।
কৈফিয়ত ২ # বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখিত সালের মধ্যে গরমিল থাকায়, পারতপক্ষে সেই সাল গুলো উহ্য রেখে ঘটনাগুলো বর্ণনা করার চেষ্টা করলাম।
পুনশ্চ ১:- মা অন্নপূর্ণার বিষয়ে লেখা এই পর্বে, বেশ কিছু ঘটনা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখলাম। তাঁর সম্মন্ধে আরও অনেক কথা বলা বাকি রয়ে গেল।
চেষ্টা করবো পরবর্তী তথা শেষ পর্বে তা যতটা সম্ভব স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলার।
পুনশ্চ ২:- সুভেন্দ্র শঙ্করের কথা লেখা বাকি রইলো। সূর্যের মত একজন নক্ষত্র, যিনি এই পৃথিবীকে বেশিদিন আলোকিত করতে পারলেন না।
ঋণস্বীকার :-
তার ছিঁড়ে গেছে কবে - স্বপনকুমার বন্দোপাধ্যায়।
আলাউদ্দিন - আলপনা রায়।
My Music My Life - পণ্ডিত রবিশঙ্কর
Raga Mala - পণ্ডিত রবিশঙ্কর
শুভ দা (আমার Wikipedia)
কোন মন্তব্য নেই