পনেরো বছর বয়সে ধর্ষিত সুনিতা র জীবন অনেক বার্তা দিচ্ছে
মাত্র পনেরো বছর বয়সে আটজন মিলে ধর্ষণ করেছিল সুনীতা কৃষ্ণনকে, জীবনে প্রায় চোদ্দ বার শারীরিক নিগ্রহের শিকার হতে হয় সুনীতাকে.....
সুনীতা কৃষ্ণনের ছোটবেলা থেকে শুরু করা যাক, সকলেই একটু মন দিয়ে পড়ুন প্লিজ....
সুনীতা কৃষ্ণণ যখন আট বছরের কিশোরী, তখন থেকেই তাঁর মন কাঁদতো অন্যের জন্য। সুনীতা নিজে নাচ শিখতে শিখতে, সেই বয়েসেই নাচ শেখাতে শুরু করেছিল মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের.....
বয়স যখন মাত্র ১২ বছর তখনই বস্তির হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য আস্ত একটা স্কুলই করে ফেলেছিল সুনীতা.....
সমাজে বড় বেশি মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে পুঁচকে একটা মেয়ে, অতএব এমন শিক্ষা দাও, যাতে সারা জীবন ঘরে মুখ লুকিয়ে থাকে....
তাই আটজন পুরুষ মিলে একদিন ধর্ষণ করল স্বাধীনচেতা একরত্তি মেয়েটিকে, ভয়ঙ্কর ভাবে মারধর করে জখম করলো সুনীতাকে, সেই আঘাতে তিনি আজও প্রায় বধির।
কিন্তু সেই ঘটনাই সুনীতার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, ঘরের কোনে মুখ লুকিয়ে না বেঁচে থেকে, সমাজের দেওয়া কলঙ্কের মুখে চুনকালি মাখিয়ে সুনীতা একাই রাস্তায় নামলেন। তাঁর উচ্চতার সামনে এবার মুখ লুকিয়ে ফেললো ধর্ষকরা....
ব্যাঙ্গালোরের সেন্ট যোসেফ কলেজ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতক ও ম্যাঙ্গালোর থেকে MSW (medical & psychiatric) করলেন। তারপর একাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীদের ওপর যৌন শোষণ ও নারীপাচার রুখতে, বিনিময়ে সুনীতাকে হারাতে হয়েছে অনেক কিছুই....
১৯৯৬ সালে, ব্যাঙ্গালোরে মিস ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশন হতে বাধা দিয়েছিলেন সুনীতা, নারীকে পন্য হতে দেবেন না তিনি, সেই কারণেই সুনীতা বাধা সৃষ্টি করেন মিস ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশনে....
সেই অপরাধে সুনীতাকে জেলে যেতে হলো, দু’মাসের জেল খেটে বেরিয়ে দেখেন নিজের বাড়ির দরজা তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। সুনীতার বাবা মা সুনীতার জীবনযাত্রা পছন্দ করছেন না এবং তাঁদের সামাজিক মর্যাদাহানি হচ্ছে সুনীতার জন্য, নিপীড়িতা মেয়েগুলির মতোই সুনীতার জীবন থেকে হারিয়ে গেল তাঁর পরিবার.....
সুনীতা একা চলে এলেন হায়দ্রাবাদ, সেই সময় হায়দ্রাবাদের "মেহবুব কি মেহেন্দি" নামের এক কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লী থেকে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করে। সেই নিষিদ্ধপল্লীর ঘরেই যৌনকর্মীদের সন্তানদের জন্য স্কুল এবং পেশা হারানো যৌনকর্মীদের জন্য হাতের কাজ শেখানোর ব্যবস্থা করলেন সুনীতা.....
সমাজকে নগ্ন করতে লাগলেন নিজের ব্লগের পাতায় পাতায়, শুরু করলেন ব্লগ, "Sunitha Krishnan: Anti - Trafficking Crusader”.....
কত শত মেয়ের যন্ত্রণা উঠে এসেছে সুনীতার কলমে, সেখানে আছে একটি ৪ বছরের মেয়ের কথা, যাকে ধর্ষণ করেছে তারই বাবা, কাকা, দাদা, খুড়তুতো ভাই ও প্রতিবেশীরা।
ব্লগের মাধ্যমে সুনীতা জানিয়েছেন, কিভাবে নারী পাচারের নিত্যনতুন পদ্ধতি বার করছে পাচারকারীরা, ক্রীতদাসের চেয়েও খারাপ অবস্থায় রাখা হয় পাচার করে আনা মেয়েদের। সঙ্গে চলে নিয়মিত যৌনশোষণ ও মারধোর, যতক্ষণ না মেয়েটি স্বেচ্ছায় গ্রাহকদের দেহ দিতে বাধ্য হয়....
কিভাবে দিনের পর দিন অত্যাচার সয়ে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে চুড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় নিপীড়িতা মেয়েগুলি। বেশিরভাগ মেয়ের জীবন শেষ হয় এইডস দিয়ে, কুকুরের মৃত্যু জোটে তাদের, কোনও কানাগলির এঁদো নর্দমার পাশে শুয়ে....
সুনীতা নিজের কাছে থাকা সবকিছু বিক্রি করে তিনি তৈরি করলেন তাঁর স্বপ্নের সংস্থা ‘প্রজ্জ্বলা‘...
পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করা মেয়েদের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা শুরু করলেন তাঁর সংস্থা প্রজ্জ্বলা‘র মাধ্যমে। হাতের কাজ শিখিয়ে পাচারকারী নারীদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত নিপীড়িত মহিলাদের পাশে রইলেন সুনীতা.....
পেশায় যৌনকর্মীদের জন্য এবং অসহায় মেয়েদের জন্য সুনীতা বানালেন আবাসন ও তারপর কারখানা, যেখানে কার্পেন্ট্রি, ওয়েল্ডিং প্রিন্টিং, ম্যাসোনারি, হাউসকিপিং সহ আরও অনেক ট্রেনিং দেওয়া হয়, করা হয় চাকরির ব্যবস্থাও।
এইডস আক্রান্তদের চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়, অসহায় ও শোষিত মেয়েদের আইনি সহায়তাও দেওয়া হয়, এমনকি এই সব অসহায় মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থাও করে ‘প্রজ্জ্বলা’.....
আর একটি কাজ করে ‘প্রজ্জ্বলা‘, এইডস বা শারীরিক নিগ্রহের কারণে মৃত্যু পথযাত্রী মেয়েদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে এই সংস্থা। অসহায় মেয়েদের জীবনের শেষ মুহূর্তেও পাশে থাকেন সুনীতা.....
আজ "প্রজ্জ্বলা" পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অ্যান্টি-ট্রাফিকিং শেল্টার।
সংস্থাটিতে প্রায় ২০০জন কর্মী আছেন, সবাই বেতন পান, একমাত্র সুনীতা কৃষ্ণন ছাড়া.....
ছোট্টবেলার মতো এখনও তিনি পূর্ণ সময়ের স্বেচ্ছাসেবক এবং সংস্থার অবৈতনিক কর্মী,
চিত্র পরিচালক স্বামী রাজেশ টাচরিভারের অর্থও সুনীতা নেন না.....
বই লিখে, নারী পাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য পেশ করে যেটুকু অর্থ মেলে, তার থেকে সামান্য পারিশ্রমিক নিয়ে বাকিটা তাঁর সংস্থায় দান করে দেন।
এসবেরই ফাঁকে, নারী পাচারের বিরুদ্ধে এক চমকপ্রদ স্লোগান দিয়ে পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছেন সুনীতা। স্লোগানটি হলো, “Real Men Don’t Buy Sex”....
সারা পৃথিবীতে ১০৮ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে স্লোগানটি।
সুনীতা পেয়েছেন পদ্মশ্রী (২০১৬) সহ প্রচুর দেশি এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারও.....
বিভিন্ন বয়েসের প্রায় ১২০০০ নারীকে, পাচারকারীদের কবল থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধার করেছেন সুনীতা কৃষ্ণণ। তাঁর চেষ্টায় কয়েক হাজার নারী পাচারকারীকে আজ জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে। তবুও আজ সমাজের বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে।
এখনও অবধি মোট ১৪ বার শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন সুনীতা, আজও ফোনে আসে খুনের হুমকি, গাড়ি চাপা দিয়ে সুনীতাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে....
তাঁর দিকে অ্যাসিডও ছোঁড়া হয়েছে, তবে সুনীতা জানেন তাঁর পথ কঠিন। যে সমাজে ধর্ষণকারী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর ধর্ষিতা ঘরে মুখ লুকিয়ে থাকে, অন্তত সেই সমাজে তাঁর জন্য কেউ লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখবে না.....
কিন্তু, অন্যায় অনেক সময় আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের মতোই বের করে আনে ক্ষোভের লাভা, শুরু হয় প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ...
কণ্ঠরোধ করতে এগিয়ে আসে কয়েকশো হাত। তবুও, সুনীতার শক্ত মেরুদন্ড আর নিষ্পলক ঠান্ডা চাউনি তাঁকে জিতিয়ে দেয় প্রতিটি যুদ্ধ....
#collected
কোন মন্তব্য নেই