১৯৩০ সালে ৮ডিসেম্বর সকাল ৯ টা কেউ মনে রাখেনি চার বিপ্লবীর কথা
কেউ মনে রাখেনি...... 🍂🍂
আটই ডিসেম্বর ১৯৩০, সকাল নটা। মেটিয়াবুরুজের এক গৃহস্থ বাড়িতে চলছে বিদায় লগ্নের প্রস্তুতি। স্নানটান সেরে খাবার টেবিলে বসেছে বছর বাইশের এক যুবক। সামনে মাছ মাংস পোলাও ইত্যাদি ষোড়শপচার উপকরণ দিয়ে সাজানো থালা। দেখেই চমকে উঠলো সে, করেছেন কি বৌদি, এতো কখনো মানুষ খেতে পারে ?
খাও ভাই, মহিলার চোখে আসন্ন বর্ষণের ইঙ্গিত। তুমি না খেলে সে দুঃখ আমার জীবনেও যাবেনা !
আচ্ছা ঠিক আছে তবে এতো খেলে আসল কাজটা করবো কি করে? ধীরে ধীরে খাওয়ায় মন দেয় যুবক। খাওয়া শেষ হলো একসময় এবার সাজবার পালা। দামী স্যুট টাই টুপিতে সেজে উঠলো সে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না মহিলা, আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
একি! নিমেষে কঠিন হয়ে উঠলো যুবক। তুমি না একজন বিপ্লবী, এ দুর্বলতা তো তোমার সাজে না! নিজেকে সংযত করে মহিলা এবার ধীরে পায়ে এগিয়ে যান সদর দরজার দিকে। তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গিয়ে অপেক্ষমান ট্যাক্সিতে ওঠেন সেদিনের যুবক বিনয় বসু, একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকালেন না ।একটু পরেই গাড়িটি মিলিয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে পড়েন তিনি। কান্না দেখলে প্রতিবেশীরা আবার কি ভাববে?
বিনয় বসুর সাথে কোন রক্তের সম্পর্ক ছিল না এই বৌদির। গত তিনমাস ধরে মায়ের মতো আগলে রেখেছিলেন ঢাকার এই ডাক্তারির ছাত্রটিকে, লোম্যান হত্যার জন্য পাগলা কুকুরের মতো যাকে খুঁজছিল বৃটিশ পুলিশ। আর এরকম ছেলেকে ভালো না বেসে কি পারা যায় ? নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যখন বিপ্লবী হরিদাস দত্ত তাঁর ইতালির টিকিট অব্দি কেটে ফেলেছেন , তখন সে নিজেই বেঁকে বসলো। আমি পরের অভিযানেও যাবো...... তারপর তো সবটাই ইতিহাস!
কাহিনী কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এলো ১৯৩১ সাল। পেডি হত্যার নায়ক বিমল দাশগুপ্ত পালিয়ে এসে উঠলেন ঐ বাড়িতেই। তাঁকেও ভ্রাতৃস্নেহে আগলে রাখলেন বৌদি সরযু দেবী। কিন্তু হাজার স্নেহ মমতা দিয়েও সেদিন ধরে রাখা যায়নি বাংলা মায়ের এই দামাল ছেলেদের। আবার একদিন ঐ বাড়ি থেকে ভয়ডরহীন বিমল বেরিয়ে পড়লেন দ্বিতীয় আ্যকশনে...... এবার গিলান্ডার্স হাউস, ভিলিয়ার্স হত্যার কঠিন ব্রত নিয়ে !
তারপর এলো ১৯৩৪ সাল। নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ গ্রামে এক ভিলেজ গার্ডকে মেরে ফেরার হয়েছেন বিভি'র সুকুমার ঘোষ , তিনিও এসে উঠলেন এবাড়িতে। সব ঠিক ছিল কিন্তু দার্জিলিংয়ে এন্ডারসন হত্যার চেষ্টার পর কি করে যেন এই আশ্রয়ের খোঁজ পেয়ে যায় পুলিশ। তারপর যা হয়, এক নিশুতি রাতে বাড়ি ঘিরে ফেলে গ্রেফতার করলো সুকুমার ও গৃহস্বামী রাজেন্দ্র কুমার গুহকে। কিশোর পুত্র গিরীন ও রেহাই পেলোনা। বহু চেষ্টা করেও এন্ডারসন হত্যা মামলায় পিতা পুত্রকে ফাঁসাতে না পেরে একসময় তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। তবে সাহেব কোম্পানির বড়বাবুর চাকরিটি হারান গুহ মশাই।
সেদিন শুধু এই বৌদিটিই নন, এমন কতো বৌদি, কতো মা, কতো স্নেহময়ী দিদি যে বাংলার এই দামাল ছেলেগুলো কে ভালোবাসা দিয়ে সহানুভূতি দিয়ে সবরকম বিপদ থেকে আগলে রেখেছিলেন তার বোধহয় আদি-অন্ত নেই। বিনিময়ে কি পেলেন তাঁরা? লাঞ্ছনা আর নির্যাতন। দুঃখ আর দারিদ্র্য।দেশ স্বাধীন হবার পর কোন স্বীকৃতিই পাননি তাঁরা। হে পাঠক, ওদের তোমরা স্মরণ করো, শ্রদ্ধা করো। নইলে অকৃতজ্ঞ বলে ইতিহাসে তোমরা মসীলিপ্ত হয়ে থাকবে চিরদিন........! যে স্বাধীনতা তোমরা পেয়েছো তা ওদেরই সমাধির ওপর প্রতিষ্ঠিত।🌹
উপসংহার: এনাদের বাড়ি নিত্য পুজো হতো বিনয় বাদল দীনেশের। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন প্রতি বছর আটই ডিসেম্বর মহাকরণের সামনে গিয়ে তাঁদের স্মৃতিসৌধে মালা পরিয়েছেন।🌺
🌲 সংকলনে ✍🏻 স্বপন
কোন মন্তব্য নেই