Header Ads

ভু ভারতে প্রথম দুর্গা পুজো

বাংলা তথা ভূ-ভারতের প্রথম দুর্গাপূজা —

শ্রীশ্রী চণ্ডী এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে মেধস মুনির আশ্রমেই মর্ত্যলোকে প্রথম দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়েছিল। এটি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলাধীন দুর্গাপুর মহকুমার নিকটবর্তী সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকে অবস্থিত কাঁকসার গড় জঙ্গলের অভ্যন্তরে শ্রীশ্রী গড়চণ্ডী ধাম সংলগ্ন 'মেধস মুনির আশ্রম'। কোলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সোজা পানাগড় হয়ে দার্জিলিং মোড়। সেখান থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা পথ। সেখান থেকে বাঁদিকের রাস্তায় এগিয়ে ইছাই ঘোষের দেউল। সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে ২-৩ কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে 'মেধস মুনির আশ্রম'।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরত্বে গড় জঙ্গলে মেধস মুনির আশ্রমে বাংলা তথা ভূ-ভারতের প্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপুর মহকুমার সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকে অবস্থিত কাঁকসার গড় জঙ্গলে মেধস মুনির আশ্রম বা গড়চণ্ডী ধামে আনুমানিক ৭০০-৮০০ সালের মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে মেধস মুনির আদেশে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ‍্য বসন্তকালে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজার সূচনা করেন। আর তারপর থেকেই বাংলা তথা ভূ-ভারতে দুর্গাপূজার প্রচলন।

স্বর্গের দেবতা এবং আর্য ঋষিগণ আদিশক্তির উৎসরূপিণী দেবীদুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য তাঁর আরাধনা করতেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে প্রথমবার দুর্গাপূজা করেন শ্রীকৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার স্বয়ং ব্রহ্মা, তৃতীয়বার মহাদেব এবং চতুর্থবার দুর্গাপূজার আয়োজন করেন দেবরাজ ইন্দ্র। দেবী-ভাগবত পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু ক্ষীরোদ সাগরের তীরে দেবীদুর্গার আরাধনা করে বর লাভ করেছিলেন। মূল বাল্মীকি-রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজার উল্লেখ নেই। কিন্ত কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ণে কালিকাপুরাণের ঘটনার অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, রাজা সুরথ মর্ত্যে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, শ্রীশ্রী চণ্ডীর দেবীমাহাত্ম্যম্ এবং দেবী-ভাগবত পুরাণ অনুসারে দেবীদুর্গা মর্ত্যলোকে মেধস মুনির আশ্রমে সর্বপ্রথম অবতীর্ণা হন। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে কথিত রয়েছে যে, রাজ্যহারা রাজা সুরথ ও স্বজনহারা সমাধি বৈশ্য মেধস মুনির আশ্রমে তাঁর নিকট থেকে দেবীমাহাত্ম্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন এবং এই স্থানেই বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেন। পরে দেবীদুর্গার অনুগ্রহে রাজা সুরথ তাঁর রাজ্যপাট ফিরে পান।

সুরথ রাজার রাজধানী ছিল বীরভূম জেলার বোলপুরের সুপুর। রাজা সুরথ সুশাসক ও যোদ্ধা হিসাবে বেশ সুখ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশের। জীবনে কোনো যুদ্ধে তিনি পরাজিত হননি। কিন্তু সুরথ রাজার প্রতিবেশীরাজ্য (যবন রাজ্য) তার প্রতি হিংসাত্মক মনোভাবসম্পন্ন ছিল। যবন রাজ্য একদিন সুরথ রাজার রাজ্যকে আক্রমণ করে এবং তাদের কাছে সুরথ রাজের পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তার (সুরথ) রাজসভার মন্ত্রী, ও অন্য সদস্যরা সব ধনসম্পত্তি লুঠ করে। কাছের লোকেদের এমন আচরণ দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। অবশেষে সর্বহারা হয়ে বনে আশ্রয় নেন।

বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি নিরাপদে বসবাস করার জন্য সুপুর থেকে ৩৯ কিমি পশ্চিমে অজয় নদের দক্ষিণ প্রান্তে শাল, সেগুন, মহুয়ার গভীর জঙ্গলে মেধস মুনির আশ্রমে হাজির হন। মেধস মুনি রাজার সমাদর করে তার আশ্রমে থাকতে বলেন। আশ্রমে থেকেও রাজার মনে কোনো শান্তি ছিল না। তিনি সবসময় হারানো রাজ্য ও তার প্রজাদের ভালো-মন্দের কথা চিন্তা করে অস্থির হতেন।

অন্যদিকে সমাধি বৈশ‍্য সংসার ত্যাগ করেন৷ বনের মধ্যে একদিন সুরথ রাজার সমাধির সাথে দেখা হয়। তার সাথে কথা বলে সুরথ জানতে পারেন সমাধির বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তার স্ত্রী ও ছেলে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সমাধিও তারই মতো স্বজন প্রতারিত ও সর্বহারা। কিন্তু তিনিও সবসময় তার স্ত্রী ও ছেলের ভালোমন্দের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হন। তারা ভাবলেন যারা তাদের সর্বহারা করেছে কেন তাদের কল্যাণের কথাই সবসময় মনে হয়। তারা মেধস মুনিকে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেন এই সবই মহামায়ার ইচ্ছায়। এরপর তিনি সুরথ ও সমাধিকে দেবী মহামায়ার কথা স-বিস্তারে বর্ণনা করেন।

সুরথ রাজা মেধস মুনিকে জিজ্ঞাসা করিলেন — যাঁহাকে আপনি মহামায়া বলিতেছেন — তিনি কে ?

মেধস মুনি বলিলেন, মহামায়া পরমা জননী অর্থাৎ আদিমাতা। যখন এই জগৎ ছিল না, তখন তিনি ছিলেন। যখন সূর্য্য ছিল না, চন্দ্র ছিল না, তারা নক্ষত্র এই পৃথিবী কিছুই ছিল না, তখন তিনি ছিলেন। তাঁহা হইতেই এই জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে৷ তিনি এই জগৎকে মোহিত করিয়া রাখিয়াছেন বলিয়া তাঁহার নাম মহামায়া। জগৎকে তিনি সৃষ্টি করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জগৎকে ধরিয়া আছেন, এই জন্য তাঁহার আর এক নাম জগদ্ধাত্রী। তিনি ধারণ করিয়া না থাকিলে উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই এ জগতের- লয় হইয়া যাইত।

পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, তিনি নিত্যা – অর্থাৎ সর্ব্বদাই তিনি বর্তমান আছেন। এই জন্য তাঁহার আর এক নাম সনাতনী। তিনি এই জগতের রাণী। মনুষ্য হইতে আরম্ভ করিয়া এই পৃথিবীতে যত জীব আছে, ইহাদের ত কথাই নাই, এ জগতে স্বর্গে মর্ত্যে পাতালে যেখানে যত জীব আছে —দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ সমস্তই তাঁহার প্রজা। এইজন্য তাঁহার আর এক নাম ঈশ্বরী।

ভক্ত ! আশ্বস্ত হও। সেই সৰ্ব্বেন্দ্রিয় প্রকাশিকা আদ্যাশক্তিই জগতের আদি জননী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবেরও ঈশ্বরী। সময়ে সময়ে এই জগতোদ্ধারের নিমিত্ত তিনি আবির্ভূতা হন।

তাঁহার রচিত সংসারটাকে নষ্ট করিবার জন্য মাঝে মাঝে এই পৃথিবীতে দানবের উৎপাত হয়। তখন ধর্ম্মের ক্ষয়, আর অধর্ম্মের বৃদ্ধি হয়। বৃদ্ধি পাইতে পাইতে যখন অধর্ম্মের ভার এত অধিক হয় যে, মা ধরিত্রী আর তাহা সহ্য করিতে পারেন না, তখন তিনি কাঁপিতে থাকেন ও কাঁদিতে থাকেন। সেই রোদনের সঙ্গে সঙ্গে সারা গগন ব্যাপিয়া, সমস্ত দেব-হৃদয় কাঁপাইয়া মায়ের মধুর নামের ধ্বনি উঠে। ধরিত্রীর সঙ্গে সঙ্গে দেবতারা যখন সমস্বরে মাকে আবাহন করিতে থাকেন, তখন জগজ্জননী আর স্থির থাকিতে পারেন না। তখন সাধুদের পরিত্রাণের জন্য, অসাধুদের ধ্বংসের জন্য সনাতন ধর্ম রক্ষা করিবার জন্য সনাতনী মা আমাদের মধ্যে আসিয়া অবতীর্ণা হন।

শক্তিরূপা সনাতনী আপনার বিশ্ব বিমোহিনী মায়া দ্বারা আপনাকে আচ্ছাদিত করিয়া নানারূপে আমাদের মধ্যে লীলা করিতে আসেন। তখন তিনি পিতা মাতার কাছে নন্দিনী, ভ্রাতার কাছে ভগিনী, পতির কাছে জায়া, পুত্র কন্যার কাছে জননী। তখন তিনি দীনের কাছে দয়া; তৃষিতের কাছে জল, রোগীর কাছে সেবা, ক্ষুধিতের কাছে ফল। তখন কত মূর্তিতে যে মা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হন তাহা আর কি বলিব ?

তাঁহার গুণ বর্ণনা করিয়া শেষ করিতে পারে, এমন শক্তি এ জগতে কার আছে ? তিনি আসিলেই জীবের সকল দুর্গতির অবসান হয়। এইজন্য তাঁহার আর এক নাম দুর্গা। দুর্গতিনাশিনী শ্রীদুর্গাই ভুবনমোহিনী ত্রিজগৎপ্রসবিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া।

তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম্। 
আরাধিতা সৈব নৃণাং ভোগস্বৰ্গাপবৰ্গদা॥

হে মহারাজ, তুমি সেই পরমেশ্বরী মহামায়ারই শরণাগত হও। তাঁহাকে ভক্তিপূর্বক আরাধনা করিলে তিনিই ইহলোকে অভ্যুদয় এবং পরলোকে স্বর্গসুখ এমনকি মুক্তিপ্রদান করিবেন।

এরপর মেধস মুনির পরামর্শে রাজা সুরথ নদীর তীরে কঠিন তপস্যা করেন। পরে মেধস মুনি আদেশ করেন রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ‍্যকে মৃন্ময়ী দুর্গামূর্তি নির্মাণ করতে হবে। তাঁরা তাই করেন ও শুরু করেন দুর্গাপূজা। মহামায়ার উদ্দেশ্যে বসন্তকালে, চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করেছিলেন। এরপরই রাজা সুরথ রাজ্য লাভ করেন এবং সমাধি বৈশ‍্য আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হন।

মেধস মুনির আশ্রমে রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্যর আয়োজিত সেই পূজা আজও হয়ে আসছে। এখানে গভীর জঙ্গলের লাল মাটির রাস্তা ধরে দর্শনার্থীরা আসেন। তবে এখানের পূজায় কিছু বিশেষত্ব আছে। এখানে মা দুর্গার পূজা শেষে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ইংরেজ আমলে এখানে দেবী চৌধুরানী সহ অনেক বিপ্লবীই এই মন্দিরের দেবীকে দেশমাতা রূপে পূজা করত। সেই থেকেই পূজার সময়ে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দেওয়ার রীতি চলে আসছে।

১৯৯২ সালে যোগীরাজ ব্রহ্মানন্দগিরি মহারাজ গড় জঙ্গলের এই তীর্থভূমি পুনঃ উদ্ধার করেন। যোগীরাজ ব্রহ্মানন্দগিরি মহারাজ ১৯৯১ সালে বোলপুরে থাকাকালীন জঙ্গলের খুব গভীরে এক মন্দিরের কথা শোনেন এবং গড়জঙ্গলের বর্তমান স্থানে পৌঁছান যেখানে উইঢিপি ঢাকা প্রাচীন মন্দির, অশ্বত্থ, পাকুড় গাছ দেখতে পান। গড়জঙ্গলের গভীর অরণ্যে অশ্বত্থ ও পাকুড় গাছ বেষ্টিত বল্মীক আবৃত প্রাচীন এই মন্দিরটিকে তিনি 'মেধস মুনির আশ্রম' বলে চিহ্নিত করেন। পরবর্তীকালে যোগীরাজ ব্রহ্মানন্দগিরি মহারাজের নির্দেশে এইস্থানে খনন করে প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও মৃন্ময়ী দুর্গাপ্রতিমার অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করা হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণের শ্লোক অনুযায়ী এখানকার মন্দির ও এখানে প্রাপ্ত মাটির দুর্গাকেই সুরথ রাজার পূজা করা প্রথম দুর্গা বলে মনে করা হয় এবং মন্দির ও তার সংলগ্ন আশ্রমকে মেধস মুনির আশ্রম বলে মনে করা হয়।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, মেধস মুনির আশ্রমের অবস্থান নিয়ে মতান্তর রয়েছে। মতান্তরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলাধীন বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড়ের উপরে 'মেধস আশ্রম' অবস্থিত। ১৯৯২ সালে যোগীরাজ ব্রহ্মানন্দগিরি মহারাজ গড়জঙ্গলের এই তীর্থভূমি পুনঃ উদ্ধারের পূর্বে মনে করা হতো মেধস মুনির আশ্রম বাংলাদেশের চট্টগ্রামের  বোয়ালখালী উপজেলায় করলডেঙ্গা পাহাড়ে অবস্থিত। তবে বর্তমানে শ্রীশ্রী গড়চণ্ডীধামের এই আশ্রমটিকেই প্রাচীন সেই 'মেধস মুনির আশ্রম' বলে মনে করা হয়।

মেধস মুনির আশ্রম বা গড়চণ্ডী ধামের ঠিক উল্টো দিকে, অর্থাৎ অজয় নদের অপর পাড়ে বীরভূম জেলার কেঁদুলি গ্রাম। বোলপুর মহকুমার ইলামবাজার ব্লকের জয়দেব পঞ্চায়েতে অজয় নদের পাড়ে কেঁদুলি গ্রাম কবি জয়দেবের জন্মস্থান। যেখানে প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে জয়দেব মেলা বসে।

.

জয় মা 

.

 (সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.