শিয়ালদহ স্টেশন শ্যামা প্রসাদের নামে হবে ,১৯৫০ সালের দুঃখের স্মৃতি
শিয়ালদহ স্টেশনের নাম ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে করা হতে চলেছে। এই দাবি দীর্ঘদিন ধরেই আমরা করে আসছি। শিয়ালদহ স্টেশনে জড়িয়ে আছে পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা শরণার্থী হিন্দুদের দীর্ঘশ্বাস ও ক্রন্দন। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্যই পশ্চিমবঙ্গ তথা শিয়ালদহ স্টেশন গন্তব্য হতে পেরেছিল আক্রান্ত হিন্দুদের।
শিয়ালদহ স্টেশনের একটা ইতিহাস শুনুন।
২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০, শিয়ালদহ স্টেশন।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঢাকা-কলকাতা মেল শিয়ালদহ স্টেশনে ঢুকছে। ট্রেনটা বড্ড দেরীতে এল। সেই সকাল ৭টায় আসার কথা ছিল।
শিয়ালদহ স্টেশনে সকাল থেকেই ভীড়। পূর্ব বঙ্গে শোনা যাচ্ছে হিন্দুদের উপর খুব অত্যাচার হচ্ছে। তাই প্রাণ, ধর্ম বাঁচাতে দলে দলে হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদেরই একটা বড় দলের ঐ ট্রেনে কলকাতা আসার কথা। তাই অগনিত মানুষ আত্মীয় স্বজনদের আসার অপেক্ষায় শিয়ালদহ স্টেশনে এসেছে। সেই ভোররাত থেকে তারা অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য।
ট্রেন থামল। কিন্তু কেউ নামল না ট্রেন থেকে।
কি ব্যাপার! ট্রেনে কোনো যাত্রী নেই! অথচ সব বগিতে ছড়িয়ে আছে অজস্র ব্যাগ, পুঁটলি, তোরঙ্গ, ভাঙ্গা খেলনা... আর অজস্র ভাঙ্গা শাঁখা... আর রক্ত।
চলুন ট্রেন ছাড়ার সময় ফিরে চলি।
২৫শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা বেলা। ঢাকায় গ ণ হ ত্যা শুরু হতেই সেখান থেকে অজস্র হিন্দু স্টীমারে করে গোয়ালন্দ এসেছে। এই আসাটাও অবশ্য সহজ হয়নি। মু স ল মা ন মাঝি, কুলি সবাই হিন্দুদের থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা নিয়েছে। আর পদে পদে অপমান। যাইহোক, ট্রেনে ওঠা গেল। ট্রেন ছাড়ার সময় রাত ১০:১৫ হলেও ছাড়ল রাত ১২টায়।
রাত একটায় রাজবাড়ী। রাজবাড়ী ছাড়িয়ে ট্রেন চলল কলকাতার দিকে। মিনিট ২০ পরে সূর্যনগরে এক মাঠের মধ্যে ট্রেন থেমে গেল। কি ব্যাপার! যাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই মহিলা, তাদের মধ্যে নতুনভাবে আতঙ্ক। নিশুতি রাতের নিঃশব্দতা ভেদ করে কাদের যেন কোলাহল শোনা গেল। কোলাহল এগিয়ে আসছে। যাত্রীরা ভারী তোরঙ্গ দিয়ে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করল। পুরুষরা লুঙ্গি পরে নিল, মাথায় দিল ফেজ। মেয়েরা বোরখা পরে নিল। সিঁদুর মুছে শাঁখা ভেঙ্গে নিল স্বামীর সামনেই।
সব বৃথা। পাশের জঙ্গলে অপেক্ষা করা দলে দলে মু স ল মা ন ট্রেন আক্রমণ করল তরবারি পাথর দা কুড়ুল নিয়ে। দরজা ভেঙ্গে ট্রেনে ঢুকে যাকে সামনে পেল তাকেই মারল। কিশোরী ও যৌবনবতী মেয়েদের নামিয়ে নিল। বয়স্কদের মেরে ফেলল।
ট্রেন থামল কি করে?
ঐ ট্রেনে বেশ কিছু মু স ল মা ন হিন্দুদের সঙ্গেই উঠেছিল গোয়ালন্দ থেকে। তারা নির্দিষ্ট জায়গা আসতেই চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে দেয়।
আধঘণ্টা পর ট্রেন ছাড়ল। কিন্তু দুই মিনিট পর আবার থেমে গেল। আবার চলল হত্যা লুঠ। পাঁচ মিনিট পর ট্রেন আবার ছাড়ল।
স্টেশন কালুখালী। রাত দুটো বাজে।
ট্রেনের চালক গার্ড ও নিরাপত্তারক্ষীদের দেখা পাওয়া গেল। নিরাপত্তারক্ষীদের সবাই বাংলাভাষী মু স ল মা ন। তারা বলল, ট্রেনে ডাকাত পড়েছিল। কিছু মালপত্র লুঠ হয়েছে, আর কিছু হয়নি।
সকাল ছটা অবধি ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকল কালুখালী স্টেশনে। সকাল হতেই আশেপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা হিন্দুরা ট্রেনে উঠতে এল।
বেলা বারোটায় ট্রেন দর্শনা পৌঁছাল। ওপারেই ভারতের গেদে। সেখানে পৌঁছে গেলে আর আর চিন্তা নেই। ভারত ভারত........ পিছনে রইবে পড়ে জন্মভূমি, আগে তো ধর্ম আর প্রাণ।
কিন্তু দর্শনা থেকে ট্রেন আর ছাড়ে না। রেলের মু স ল মা ন কর্মীরা বলল কলকাতা-আসাম মেল নিরাপদে দর্শনা না এলে এই ট্রেনকেও কলকাতা যেতে দেওয়া হবে না। ওরা তল্লাশীর নাম করে ট্রেনে উঠল। যে সব হিন্দু খুন হয়েছিল বা পালিয়েছিল তাদের মালপত্র মালিকহীন হওয়ায় নামিয়ে নেওয়া হল। চলল সরকারি লুঠতরাজ। যাত্রীদের মধ্যে আবার আতঙ্ক। তবে তার পরিমাণ খুব বেশী নয়। যাত্রীইতো প্রায় নেই! আতঙ্কিত হবে কে?
দুপুর তিনটের সময় আসাম মেল দর্শনা পৌঁছাল। ঢাকা মেলও কলকাতা যাওয়ার অনুমতি পেল। কিন্তু তখন ট্রেনে কোনো যাত্রী নেই। যারা দর্শনা এসে পৌঁছেছিল তারাও নতুন আতঙ্কে পালিয়েছে। বাকি সবাই মৃত বা অপহৃত।
সন্ধ্যা বেলা ট্রেন ভর্তি মালপত্র, ভাঙ্গা খেলনা, ভাঙ্গা শাঁখা আর দীর্ঘশ্বাস পৌঁছে গেল শিয়ালদহ স্টেশনে।
পুনশ্চ: যারা ট্রেন আক্রমণ করেছিল তারা সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলত। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু মেয়ে ও সম্পত্তি। সাধারণ মু স ল মা ন, রেলকর্মী, মাঝি, কুলি, সরকারি কর্মী, নিরাপত্তারক্ষী, পুলিশ সবাই একযোগে কাজে নেমেছিল।
তথ্যসূত্র: ১৯৫০ : রক্তরঞ্জিত ঢাকা বরিশাল এবং...
ডঃ দীনেশচন্দ্র সিংহ
কোন মন্তব্য নেই