Header Ads

মূল্যবান মনুষ্য জীবনে মহালয়া

ওঁ নমঃ শ্রী ভগবতে প্রণবায় ...।
*মূল্যবান মনুষ্য জীবনে মহালয়া*
স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)

মহালয়া হলো পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ। এর মাধ্যমে দুর্গাপূজা উৎসবের সূচনা হয়। দেবী দুর্গা এই দিন পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত এই পনেরো দিন পিতৃপক্ষ। আশ্বিনের কৃষ্ণ পক্ষের অমাবস্যা তিথিকে বলা হয় মহালয়া। মহালয়া কথাটি এসেছে 'মহত্‍ আলয়' থেকে। হিন্দু ধর্মে মনে করা হয় যে পিতৃপুরুষেরা এই সময়ে পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিণ্ডলাভের আশায়। এই সময়ে প্রয়াত পিতৃপুরুষদের জল-পিণ্ড প্রদান করে তাঁদের 'তৃপ্ত' করা হয়। *এই বছরে 02.10.2024.বাংলা ১৫ই আশ্বিন বুধবার অমাবস্যা তিথি মহালয়া।* সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্নাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া, পিতৃপক্ষের ও শেষদিন এটি ।

মহালয় প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, যে ক্ষণে পরমাত্মায় অর্থাৎ পরব্রহ্মে লয় প্রাপ্তি ঘটে সেটিই হল মহালয়। কেননা, পরমাত্মাই হল পরব্রহ্ম। আর নিরাকার ব্রহ্মের আশ্রয়ই হল মহালয়। তবে শ্রী শ্রী চণ্ডিতে মহালয় হচ্ছে পুজো বা উৎসবের আলয়। এখানে আলয় শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে আশ্রয়। চণ্ডিতে তাই 'মহালয়' বলতে 'পিতৃলোককে' বোঝানো হয়েছে। পিতৃলোককে স্মরণের ক্ষণকেই বলা হয়েছে মহালয়া। কৃষ্ণপক্ষে কালিমার ক্রমশ লয় হতে হতে অমাবস্যা তিথিতে সে লয় পূর্ণতা পায়। তাই একে বলে মহালয়া। ‘মহালয়া’ শব্দের সন্ধি বিশ্লেষণ করলে যেমন আরেকরকম অর্থ পাওয়া যায়, তেমনই অভিধান থেকে জানা যায়, ‘মহ’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে। এক, ‘মহ’ বলতে বোঝায় পুজো বা উৎসব। তা থেকে ব্যুৎপত্তি করলে হয়  মহ+আলয় = মহালয় অর্থাৎ পুজো বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। আবার ‘মহ’ শব্দের আরেক অর্থ 'প্রেত'। অর্থাৎ প্রেতের আলয় (আশ্রয়)।  সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। সেই মহালয় থেকে মহালয়া।
সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্র্রয়াত পূর্বরা, যাদের পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলিপ্রদান করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন । সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে, পূর্বপূরুষের আত্নার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্নার শান্তির জন্য, তাহারা শুধু পূর্বদের নয় , পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন। যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা - অর্থাৎ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু ও, যারা জন্ম জন্মাত্নরে আমার আত্নীয় বন্ধু ছিলেন, তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্য ও অঞ্জলী প্রদান করতে হয়। যেযাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু - অর্থাৎ যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাদের আত্না তৃপ্তিলাভ করুক।

প্রসঙ্গতঃ যে শ্রাবণ থেকে পৌষ ছয় মাস দক্ষিণায়ন, দক্ষিণায়ন দেবতাদের ঘুমের কাল। তাই বোধন অবশ্যই প্রয়োজন, আরও বলা দরকার যে মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয় সে সময়ও সংকল্প করে দুর্গা পূজা করা যায়। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবিকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য, আসল দূর্গা পূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তি পূজা বলা হয়। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবির অকাল-বোধন বলা হয়। বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর দেবীপক্ষের (শুক্লপক্ষের) প্রতিপদে ঘট বসিয়ে শারদীয়া দুর্গা পুজার সূচনা করা হয়। 

মহাভারত অনুযায়ী, প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয় । আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পনেরো দিন কর্ণের ছিল দ্বিতীয় দফার মর্ত্য বাস। আর এই পনেরটি দিনই হিন্দু শাস্ত্রে পিতৃপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত। কর্ণ স্বর্গ ফিরে আসেন যে অমাবস্যা তিথিতে- সেটিই অভিহিত মহালয় বা মহালয়া নামে।
এ দিন তর্পন করলে পিতৃপুরুষেরা আমাদের আশীর্বাদ করেন। এ ছাড়াও এদিনে দেবী দুর্গার বোধন করা হয়, বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর দেবীপক্ষের (শুক্লপক্ষের) প্রতিপদে ঘট বসিয়ে শারদীয়া দুর্গা পুজার সূচনা করা হয়। আর,"শুভ মহালয়া" বলতে নেই। আমার  প্রিয়জনের  শ্রাদ্ধের দিন কেউ যদি আমাকে *শুভ শ্রাদ্ধ* বলে, আমার কেমন লাগবে? মহালয়া আর তার পরের সপ্তাহেই দূর্গা পুজো, বাঙালীর জীবনের সব চেয়ে আনন্দের সময়। যার জন্য সবাই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু, এই বছর সব যেন কেমন বিষণ্ণ, মলিন, কোথাও যেন প্রাণের ছোঁয়া নেই। আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আর মা দূর্গার মর্ত্যে অবতরণ সকল মর্ত্যবাসীর জন্য সুসংবাদ ও আনন্দ নিয়ে আসুক, জগৎ গুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক... এই প্রার্থনা করি...!

মাতৃ প্রনাম মন্ত্র -  
ভূমেগরীয়সী মাতা স্বাগাৎ উচ্চতর পিতা ।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বগাদগি গরিয়সী।।                                                         গর্ভ ধারণ্যং পোষ্যভাং পিতুমাতা বিশ্বস্তে।               সর্বদেব সরুপায় স্তন্মৈমাএ নমঃ নমঃ।।   

 পিতৃ প্রনাম মন্ত্র - 
পিতাস্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতাহিপরমংতপঃ।                                                                                                       পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।।
নমঃ পিতৃ চরনেভ্য নমঃ।।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.