রাজ্যে তিন মূখ্যমন্ত্রী ও তিন পুলিশ কমিশনার
তিন মুখ্যমন্ত্রী ও তিন পুলিশ কমিশনার
দেবদূত ঘোষঠাকুর, সংবাদিক
সতেরো বছর আগের সেই রবিবারটার কথা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। কারণ ওই ঘটনার সাক্ষী, প্রায় ফাঁকা লালবাজারে বসে গুটিকয়েক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার একটি মন্তব্য করেছিলেন। আর তা নিয়ে গোলমাল পুরোপুরি পেকে ওঠার আগেই, কয়েক ঘণ্টার নোটিশে বদলি হয়ে গেলেন ওই পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়।
মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ সংস্থার প্রশিক্ষক রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গোটা রাজ্য তখন তোলপাড়। বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছেন। দফায় দফায় মিছিল, বিক্ষোভ। পরিস্থিতি সামলাতে নিজের ইগো বিসর্জন দিয়ে, খোদ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হাজির হতে হয়েছিল ব্রড স্ট্রিটের ওই সংখ্যালঘু এলাকার এক চিলতে ঘরে। এক সন্তান হারানো মায়ের কাছে।
সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত রয়েছি গত ৪০ বছর। 'বিচার চেয়ে' অনেক প্রতিবাদী আন্দোলন দেখেছি এই চার দশকে। কিন্তু আর জি করের ঘটনার পরে প্রতিবাদের অভিঘাত সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেলেও, পুলিশের উপরতলার বিরুদ্ধে যেমন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তেমনই একবারের জন্যও মুখ্যমন্ত্রীকে সন্তানহারা পরিবারের মধ্যে সে ভাবে পাওয়া গেল না। তাঁর দীর্ঘদিনের এক প্রাক্তন সঙ্গীকেও তা অবাক করেছে। ওই প্রবীণের মন্তব্য ,মন্তব্য, 'এ যেন এক 'অচেনা' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই চার দশকে দু'বার কলকাতা পুলিশের সর্বাধিনায়ককে সময় শেষের আগেই সরিয়ে দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে। ১৯৯২ সালে একবার। ২০০৭ সালে আর একবার। ২০০৭ সালে কেন প্রসূন মুখার্জিকে সরতে হয়েছিল, সেই ঘটনাটা দিয়েই এই প্রতিবেদন শুরু করেছিলাম। সে বার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
তারও ১৫ বছরের আগের একটি ঘটনায় বদলে দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বীরেন (বিকে) সাহাকে। বীরেন সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা আর দুষ্কৃতীদের সঙ্গে 'দহরম মহরম'। দ্বিতীয় ঘটনাটিই অবশ্য মূল কারণ। প্রয়াত চিত্র পরিচালকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে অভব্যতা করেছিল শ্রীধর এবং শ্মশান স্বপন নামের স্থানীয় দুই 'মাস্তান' (তখন সমাজবিরোধীর থেকে মাস্তান কথাটাই বেশি ব্যবহৃত হত)। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে সেই সময় উপস্থিত ছিলেন দেশ বিদেশের ভিভিআইপি। অভিযোগ, পরিস্থিতি সামাল দিতে যাওয়া তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকে ভিড়ের মধ্য থেকে 'সাহাদা' বলে ডেকে উঠেছিল ওই শ্রীধর। সত্যজিৎ রায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো গম্ভীর পরিস্থিতিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ওই ঘটনা। দেশ বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে সমালোচনার ঢেউ উঠেছিল। রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল বলে
মনে করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও। তার জেরে গদিচ্যুত হয়েছিলেন বিকে সাহা। মনে রাখতে হবে সেই সময়টা কিন্তু টিভি চ্যানেলের রমরমা ছিল না। কিন্তু ওই ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল বলে মনে করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
রিজওয়ানুরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছিল, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার। সেখানে কলকাতা পুলিশের দুই কর্তার নামও ছিল। সেই ঘটনাতেও সিবিআই তদন্ত হয়েছিল। শুধু পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ই নন, বদলি করা হয়েছিল কলকাতা পুলিশের তদানীন্তন ডেপুটি কমিশনার (সদর) অজয় কুমার ও গোয়েন্দা প্রধান জ্ঞানবন্ত সিংহকেও।
রিজওয়ানুরের ঘটনার সঙ্গে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঘটনার মিলের থেকে অমিল অনেক বেশি। মিল একটাই। সেটা হল দুটি তরুণ-তরুণীর অকালমৃত্যু।
রিজওয়ানুরের ঘটনা অনেকটাই স্পষ্ট। প্রথমত, ঘটনাটি আত্মহত্যার। দ্বিতীয়ত, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কেবলমাত্র ষড়যন্ত্র এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার। সেখানে কিন্তু চার্জশিট দেওয়ার আগেই, সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের বদলি করে দিয়েছিলেন পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল স্পষ্ট।
আর জি করের ঘটনাতেও তাই। এখন বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যম, অনলাইন চ্যানেল, ইউটিউবারদের ছড়াছড়ি। তাই মানুষের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে অনেক ধোঁয়াশা। তাই অনেকেই মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত ছিল। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।
মনে রাখতে হবে, আর জি করের ঘটনাটি খুন, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক অত্যাচারের। সঙ্গে রয়েছে একরাশ দুর্নীতির অভিযোগ। রিজওয়ানুরের ঘটনায় রাজ্য প্রশাসনের তরফে যে সংবেদনশীল, ইতিবাচক, সময়োচিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, আর জি করের ঘটনায় সেটা না হওয়াটাই এত মানুষকে রোজ পথে নামতে বাধ্য করেছে। এই ভাবে একমাস ধরে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি। আসলে মানুষ সব বুঝতে পারছে। প্রথমে প্রথমে শাসক দলের পক্ষ থেকে হুমকি শুরু হয়েছিল। তারপরে পাল্টা মিছিল। কিন্তু ১৪ আগস্ট সারা রাত মহিলারা যে ভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন, তার মোকাবিলায় শাসক দলের কোনও অস্ত্রই কাজে লাগেনি।
রাজ্য সরকারের একাধিক অবসরপ্রাপ্ত আমলার সঙ্গে গত এক মাসে কথা বলেছি। তাঁদের বেশিরভাগেরই মনে হয়েছে, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঘটনায় প্রথম থেকেই রাজ্য প্রশাসন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। বিশেষ করে, কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে।
তবে সব থেকে বেশি আলোচিত হয়েছে পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের ভূমিকা। একটি বিতর্কিত মন্তব্য করায় যদি প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বদলি করে দিতে পারেন, তাহলে বিনীত গোয়েলের তো কেবল বদলি নয়, সাসপেন্ড করা উচিত ছিল বলে মনে করছেন প্রাক্তন ওই আমলারা।
কেন একথা বলছেন ওই অবসরপ্রাপ্ত আমলারা? যে সব যুক্তি তাঁরা দিয়েছেন সেগুলি একবার পর পর সাজিয়ে দেখা যাক-
১) তরুণীর মৃত জেনেও এফআইআর করতে অযথা দেরি।
২) মৃতদেহ থাকা অবস্থাতেই ঘটনাস্থলে একাধিক বহিরাগতের ভিড়।
৩) মৃতার বাবা-মায়ের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা, অসহযোগিতা করা।
৪) মৃতদেহের চটজলদি ময়নাতদন্ত ও সৎকার করা।
৫) সেমিনার হলের পাশে শৌচাগারের দেওয়াল ভাঙা।
৬) আর জি কর হাসপাতালে ১৪ আগস্ট রাতের হামলা পুলিশ কমিশনার ঠেকাতে পারেননি।
৭) ঘটনাস্থলে হাজির থেকেও ঠেকাতে পারেননি নিজের বাহিনীর আক্রান্ত হওয়াও।
৮) আরজি হাসপাতালের ঘটনায় ডিসি নর্থের বদলে ডিসি সেন্ট্রাল দিয়ে প্রেস কনফারেন্স করানো।
আর জি করে হামলার ঘটনায় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সহ কয়েক জন নিচু তলার অফিসারকে সাসপেন্ড করা ছাড়া, আর কোনও ব্যবস্থাই লালাবাজার নেয়নি। প্রতিটি বিষয়ে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছেন বিনীত গোয়েল।
শুধু তাই নয়, মেয়েদের রাতে কাজ করা সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশিকা নিয়েও পুলিশের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ওই নির্দেশিকা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, মহিলাদের রাতের সুরক্ষা দিতে অপারগ পুলিশ প্রশাসন।
নবান্নও কার্যত চোখ বন্ধ করেই থেকেছে। তারা খোঁজও নেয়নি এই ঘটনায় সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ বাহিনীকে কতটা হেয় হতে হচ্ছে। বাহিনীর নিজস্ব মনোবল কতটা ভাঙল। এর পরেও বাহিনীর প্রধান, নিজের কাজের সাফাই গেয়ে গিয়েছেন। তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নবান্ন মানুষের সেই দাবিকে আমল দেয়নি। ১৯৯২ এবং ২০০৭ সালে মহাকরণ কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে কালক্ষেপ করেনি। তাই বিকে সাহা, প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে চলে যেতে হয়েছিল।
জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা পেরেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা পারলেন না।
(উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ১০/০৯/২০২৪)
কোন মন্তব্য নেই