Header Ads

কলকাতার হাজার কটির দুর্গা পুজো জমজমাট

কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে 


দেবদূত ঘোষঠাকুর


সেটা নয়ের  দশকের শেষ দিকের কথা।‌ সদ্য আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ছেলেটি অগ্রজ এক শিল্পীর সঙ্গে মিলে দক্ষিণ ককাতায় একটি থিম পুজোয় আবির্ভুত হয়ে‌ চমকে দিয়েছিলেন। তখন ওই পুজোর সব খরচখরচা ধরে বাজেট ছিল মেরেকেটে পাঁচ লক্ষ টাকা। ওই পুজোটি ছিল ওই যুবক শিল্পীর ধ্যানজ্ঞান। যা পেত তাতেই সন্তুষ্ট থাকত ছেলেটি। 
সেদিনের সেই ছেলেটি এখন কলকাতার দুর্গা পুজার অন্যতম প্রধান মুখ। নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান।  দক্ষিণ কলাপাতার যে পুজোর হাত ধরে তার পরিচিতি, তারা চেয়েছিল বছর ওই শিল্পী তাদের কাজটা করুন। এর মধ্যে কেটে গিয়েছে কুড়ি বছর। শিল্পী মানে ওই ছেলেটা সবাইকে সাদরে বসালেন। বেশ কিছুক্ষণ গল্পগাছা। এর পর ওই শিল্পী জানিয়ে দিলেন, 'আমাকে দিয়ে কাজ করাতে গেলে ৯৫ লক্ষ টাকার সংস্থান করতে হবে। 
পুজো কর্তারা প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এলেন, ৯৫ নব্বই লাখ! বলে কি লোকটা! ওই টাকাটা শুধু মন্ডপ সজ্জা, প্রতিমা তৈরি আর শিল্পীর পারিশ্রমিক। এর পরে আছে আলো। পুজোর আনুসঙ্গিক খরচ খরচা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে পুজোর বাজেট এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। উদ্যোক্তারা রণে ভঙ্গ দিলেন। করোনারি গ্রাস ছাড়িয়ে তখন হবে হাত পা ছড়াতে শুরু করেছে শহর কলকাতা। তাঁদের মন্ডপে পূর্ণতা পাওয়া ওই ছেলেটির এখন মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল।  বিশাল নাম ডাক। বেশ লাগছিল ওই পুজোর উদ্যোক্তাদের। পাশাপাশি কগজকলম নিয়ে তাঁরা হিসেব করছিলেন, ওই শিল্পীকে পুজোয় নিলে বাজেট কোথায় গিয়ে ঠেকবে। চটপট একটা আনুমানিক হিসেব তৈরি হয়ে গেল: শিল্পী ৯৫ লক্ষ, আলো ৫ লক্ষ+ ডেকোরেটর ৫ লক্ষ+  ঢাকি ৫০ হাজার+  পুজো ৪ লক্ষ+ ভোগ  ৩ লক্ষ +  ভাসান ১ লক্ষ + সিকিওরিটি। (৭ দিন x  ২৪ ঘন্টা) ৫ লক্ষ +  অতিথি আপ্যায়ন ১ লক্ষ টাকা + আনুসঙ্গিক খরচ ৫ লক্ষ=  ১ কোটি  ২৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বড় একজন শিল্পীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে একটা থিমের মন্ডপ করতে এখন এক কোটির বেশি পুঁজি হাতে থাকা দরকার। 
কিন্তু কলকাতা শহরে থিম পুজো যখন পাকাপাকি ভাবে শুরু হয়, তখন ৮০ হাজার টাকার মধ্যে সব কিছু হয়ে যেত। সালটা ১৯৮৯ হবে। তখনও ইস্টার্ন বাইপাস দিয়ে পুরোদমে যানবাহন চলাচল শুরু হয়নি। তৈরি হতে থাকা বাইপাস সংলগ্ন একটি পুজো কমিটির কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন নির্মীয়মান বাইপাসের সুযোগ এবার তাঁরা নেবেন। পাড়ায় কয়েকটি যুবক আর্ট কলেজে পড়েন। তাঁরা এগিয়ে এলেন।‌ মন্ডপ, প্রতিমা, আলো এমনকী আবহ সঙ্গীতের দায়িত্ব ভাগ করে নিলেন ওই নবীন শিল্পীরা। কলকাতার পুজোয় এক নতুন ধারা সংযোজিত হল। 'থিম'। 
পাড়ার ছেলেরা নিজেরা হাত লাগিয়ে যে থিম গড়ে তুললেন তার দেখতে মানুষের ঢল নামল ওই এলাকায়।বিখ্যাত হয়ে গেল সুনীল নগর সর্বজনীনের অখ্যাত পুজোটি। সাকুল্যে সেবার খরচ হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা। ওই সময়ে টাকার এই অঙ্কটি নেহাত কম নয়। আগে ডেকোরেটর নিজের মতো করে মন্ডপ তৈরি করতেন। আলো দিতেন অন্য একজন। রেকর্ড প্লেয়ারে তিনিই গান বাজাতেন। বাজেট ৬০-৭০ হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করত। এখনও ওই ক্লাবে থিম পুজো হয়। কিন্তু ৮০ লক্ষ, ৯০ লক্ষ , এক কোটি বাজেটের পুজো পাশে দাঁড়াতে পারেনা সুনীল নগর। টেনেটুনে চার লক্ষ টাকা জোগাতেই তাদের হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। জৌলুস হারিয়েছে থিম পুজোর ভগীরথ। তবে দাম পুজোর সঙ্গে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়নি। উদ্যোক্তারা বলছেন,  সাবেক পুজোয় খরচ কিন্তু কমবে না, বরং কিছুটা বাড়বে। 
পিকনিক গার্ডেনের থিমের ঐতিহ্য মেনে পুজো শুরু করা কলকাতার অন্তত পাঁচটি পুজোর বাজেট এখন কোটি টাকা পেরিয়েছে। বাকি অন্তত ৬০ টি পুজোর বাজেট ৬০ থেকে ৯০ লক্ষের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। ৩০-  থেকে ৫০ লক্ষ টাকার বাজেট  আরও অন্তত  ৬০ টি ক্লাবের। কলকাতার বাইরে আসানসোল, পুরুলিয়া, হলদিয়া, কল্যানী তেও এক কোটি বাজেটের পুজো রয়েছে। ২০১৯ সালে হলদিয়ার একটি পুজোর বাজেট ছিল ৫৪ লক্ষ টাকা।

আগে রাজারা জমিদারেরা নিজেদের ওজন বোঝাতে দুর্গাপুজোয় দেদার খরচ করতেন। এক জমিদারের সঙ্গে অন্য জমিদারের রেষারেষিতে কোষাগার থেকে হু হু করে বেরিয়ে যেত মুদ্রা। সে সময় তো কর্পোরেট, প্রোমোটার, ঠিকাদার সমিতি- এসব কিছু ছিল না, তাই পুজোর ক'দিন খাওয়াদাওয়া, যাত্রা-কবিগানে মেতে থাকলেও, পরে রাজকোষের ঘাটতি মেটাতে হত প্রজাদেরই। এখন জমিদাররাজ গিয়েছে এসেছে দাদারাজ। তাঁদের 'আবদার' মেটাতে ল্যাজে গোবরে কর্পোরেট সংস্থা, প্রোমোটার, ঠিকাদার সমিতি, স্থানীয় শপিং মল এবং আবাসনগুলির ব্যবসায়ী আর মোটা বেতনের চাকুরেরা।  
 দুর্গাপুজোটা আটের দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত কিন্তু প্রকৃত অর্থেই সার্বজনীন ছিল। কালী পুজোটা ছিল দাদাদের পুজোর। সেখানে ক্ষমতার আস্ফালন চলত। ফাটাকেষ্টর পুজো, গোপাল পাঁঠার পুজো, ছোড়দা, সোমেন মিত্রের পুজো, শ্মশান স্বপনের পুজো- এই নামেই পরিচিত ছিল পুজোগুলি। এর পরে দাদাদের দাপট শুরু হল দুর্গাপুজোতেও। এ ব্যাপারে তিন দাদা অবশ্য পথিকৃৎ। সুব্রত মুখোপাধ্যায় (একডালিয়া এভারগ্রিন), প্রদীপ ঘোষ ( শিয়ালদহ, রেল প্রদীপ) আর প্রদীপ ঘোষ ( লেবুতলা পার্ক, নীলু)। সিপিএমের আমলেই এদের উত্থান আর রমরমা। এদের পরেপরেই উত্থান নিউ আলিপুরের অরূপ বিশ্বাস আর দমদমের সুজিত বসুর। সিপিএমের জাঁদরেল মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ডানহাত সুজিত ছিলেন শাসক দলের উঠতি নেতা। অরূপ বিরোধী দলের। দুজনেরই রাজনীতিতে পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাওয়ার মাধ্যম ছিল পুজো সংগঠন। পরবর্তীতে এই পথ অনুসরণ করে অত্যন্ত সফল দেবাশিস কুমার, অতীন ঘোষ, রতন দে, সুশান্তর ঘোষরা।
 আর দাদাদের পুজোগুলি রমরমা যত বেড়েছে, ধাঁই ধাঁই করে বেড়েছে বাজেট। ওই পুজো গুলি নিজেদের মধ্যে বৈভবের লড়াইয়ে নামতেই আমাদের ছোটবেলার বিখ্যাত  পুজো গুলি ছোট হতে হতে হয় এখন হারিয়ে যাওয়ার মুখে। সঙ্ঘশ্রী, সহযাত্রী, সঙ্ঘমিত্র, মুক্তদলের মতো পুজোগুলি এখন স্রেফ অতীতের স্মৃতি নিয়ে টিঁকে আছে। জৌলুশ হারিয়েছে ম্যাডক্স স্কোয়্যার, সিমলা ব্যয়াম সমিতি, রবীন্দ্রকাননের মতো পুরনো পুজো গুলি। আবার নেতার ছোঁয়ায় হাজরা এলাকার একেবারে সাদামাঠা একটি পুজোর বাজেট ২৫ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। 
 কিন্তু সেটা সবাই বুঝলে তবে তো! পুজোর আনুসঙ্গিক কাজকর্ম যাঁরা করেন, অর্থাৎ বর্ধমানের আদিসপ্তগ্রাম বা কাটোয়ার কাঠ শিল্পী, দক্ষিণ দিনাজপুরের মুখোশ শিল্পী, পূর্ব মেদিনীপুরের পিংলার পটশিল্পী, পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি- তমলুকের মাদুর শিল্পী, বাঁকুড়ার পোড়া মাটির কারিগর, পুরুলিয়ার মুখোশ শিল্পী, বীরভূমের শোলা শিল্পী, নদিয়ার মৃৎশিল্পী, চন্দন‌নগরের আলোক শিল্পী, ঢাকী, পুরোহিত, বাজারের ফুলওয়ালা, প্রতিমা বহনকারী মুটে, ডোমপাড়ার কারিগরদের আর্থিক উন্নতি কতটা হয়েছে তা সমীক্ষা সাপেক্ষ।  কাছে মাথা বিক্রি করে উদ্যোক্তারা পুজোর বাজেট যে 
 যে টাকাটা শিল্পের উৎকর্ষের নামে, গ্রামের প্রান্তিক শিল্পী এবং পুজোর অন্য কারিগরদের কল্যাণের জন্য ব্যয় করার কথা বলা হয় তার কতটা বাস্তব তা ভেবে দেখার সময় বোধহয় এসেছে। কম বাজেটে কত ভালো পুজো করা যায় তা বেশ কয়েকটি কম বাজেটের (৪-৬ লক্ষ টাকা) পুজো গত দু' বছরে দেখিয়েছে। 
 কলকাতার ব্রিটিশ কাউন্সিল রাজ্যের পর্যটন দফতরের সঙ্গে মিলে কয়েকবছর আগে রাজ্যের পুজো অর্থনীতি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেখানে বেশ কয়েকটি পরিসংখ্যান উঠে এসেছিল তার ভবিষ্যতের পুজো গবেষকদের কাছে অনেকটা সোনার খনির মতো। ওই সমীক্ষা বলছে, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে ৩২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার উপরে লেনদেন হয়। যা পশ্চিমবঙ্গের মোট জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। 
  এখন দেখার কথা এই কোটি কোটি টাকা যথাযথ ভাবে বন্টন করা হয় কি? কার কপালেই কত জোটে? আসল লাভবান কারা? 


উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ১৫/৯/২০২৪

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.