Header Ads

আমার ছোট্ট বেলা লিখেছেন শীর্ষেন্দু মুখার্জী

আমার ছোট্ট বেলার ময়মনসিংহ, 
--শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আমরা তখন পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে খুব ছোট। এক ছোকরা বাঙাল মাস্টারমশাই বহাল হলেন আমাদের পড়ানোর জন্য........

আমার আর দিদির স্কুল-টুলে পড়ার তেমন সুযোগ ছিল না। বাবা বারবার বদলি হতেন, সব জায়গায় স্কুল ছিলও না, আর ভর্তি হলেও বছর ঘুরবার আগেই হয়তো তল্পিতল্পা গুটিয়ে আর এক জায়গায় চলে যেতে হত। তাই বরাবর আমাদের ভরসা প্রাইভেট টিউটর। কত যে বিচিত্র মাস্টারমশাইদের কাছে আমাদের পড়তে হয়েছে তার হিসেব নেই।

ময়য়মনসিংহের বাড়ির দাদু আর ঠাকুমার ঘরটাকেই বড় ঘর বলা হত। আসলে বড় ঘরটাই ছিল সারা বাড়ির প্রাণকেন্দ্র এবং সেটা বৈঠকখানাও বটে। প্রাইভেসির কোনও বালাই-ই ছিল না। মাঠের মতো বিশাল জোড়া দেওয়া খাটে দাদু আর ঠাকুমা শুতেন, আর তাঁদের সেই দাম্পত্যের মধ্যেই ঠাসাঠাসি করে বিস্তর কুচোকাঁচাও ঢুকে পড়ত। অর্থাৎ দাদু-ঠাকুমার নাতি ও নাতনিরা। সে তো শয্যা নয়, যেন হাট। কারও দাঁত কড়মড় করে, কেউ ঘুমের মধ্যে হিসি করে দেয়, কারও গল্প শোনার বায়না, সে এক হুলুস্থুলু ব্যাপার। তাতে দাদু বা ঠাকুমার কোনও বিকার দেখিনি। বড়জোর ঠাকুমা চড়টা-চাপড়টা দিয়েছেন, আর দাদু রেগে গিয়ে বলেছেন, নিব্বইংশার পো। তার বেশি কিছু না।

সেই বড় ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে হ্যারিকেনের আলোয় আমাকে আর দিদিকে পড়াতে আসতেন যোগেন মাস্টারমশাই। রোগা খ্যাটখ্যাটে চেহারা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, হাস্যবিহীন মুখ। এক দিন বাংলা রিডিং পড়তে দিলেন। পড়ার পর গম্ভীর মুখে বললেন, তোমার উরুশ্চারণ ঠিকমত হয় না। ওইটা ঠিক করতে হইব, বুঝলা?

বুঝলাম। বইতে এক একটা অংশ দাগিয়ে দিয়ে বলতেন, এইটা টুপটুপাটুম মুখস্থ করবা, বুঝলা? বুঝলাম, কিন্তু ‘টুপটুপাটুম’ কথাটার অর্থ ধরতে পারতাম না। দিদিকে জিজ্ঞেস করলে ঠোঁট উলটে বলত, কে জানে? ধরে নিয়েছিলাম, টুপটুপাটুম মানে ভাল করে মুখস্থ করাই হবে।

এক দিন সন্ধেবেলা বসে যোগেন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়া করছি, হঠাৎ মনে হল, ঘরটা দোলনার মতো দুলছে। হ্যারিকেনটা উলটে পড়ে গেল, আমি কুমড়ো গড়াগড়ি। যোগেন মাস্টারমশাই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দুই লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বড় ঘরেই এক ধারে ঠাকুরের আসন। মস্ত কাঠের সিংহাসনে জগন্নাথদেব থেকে শুরু করে বালগোপাল পর্যন্ত গুচ্ছের ঠাকুরদেবতা আর আমাদের গৃহদেবতা জগদ্ধাত্রীর ছবি। সেইখানে বসে লেংড়ি পিসি জপ করছিলেন। পাটাতন থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙেছিল বলে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন বলে তাঁর ওই নাম। আসলে উনি ছিলেন দাদুর বালবিধবা বোন এবং সম্পর্কে আমাদের ঠাকুমা। তা সেই লেংড়ি পিসিই চেঁচিয়ে উঠলেন, ভূমিকম্প! ভূমিকম্প!

ভূমিকম্প কাকে বলে তা তখন জানিই না। তাই হাঁ করে সেই দুলুনির মধ্যে বসে রইলাম। তবে দিদি আমাকে জাপটে ধরে ছিল, মনে আছে। কিন্তু মাস্টারমশাই সেই যে হাওয়া হলেন, তার পর দু’দিন আসেননি।

যোগেনবাবুর চাকরি হচ্ছিল না বলে খুব দুঃখ। নানা জায়গায় দরখাস্ত করেন, দরবার করেন, কিন্তু চাকরি হচ্ছিল না কিছুতেই। সব সুযোগই নাকি ‘হইতে হইতেও হইল না, ইস, অল্পের লিগ্যা ফস্কাইয়া গ্যাল।’ অবশেষে কালীবাড়ির কাছে রাস্তার ওপর একখানা দোকান খুলে বসলেন মাস্টারমশাই। লজেন্স-চকলেট, খাতা-পেনসিল, বিড়ি-সিগারেট, এ-সব বিক্রি হয়। তবে সন্ধেবেলা আমাদের পড়াতে আসতেন ঠিকই।

তখন আত্মীয়স্বজনদের ফাইফরমাশ খাটা আমাদের নিয়মের মধ্যেই ছিল। তা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই কেউ এক দিন আমাকে ডেকে হাতে দুটো তামার পয়সা দিয়ে বলল, যা তো রুণু, দুই পয়সার বিড়ি লইয়া আয়। আমি পাঁইপাঁই করে ছুটে মাস্টারমশাইয়ের দোকানে হাজির হয়ে বললাম, মাস্টারমশয়, দুই পয়সার বিড়ি দ্যান। যোগেন মাস্টারমশাই ভারী অবাক হয়ে আমার দিকে অতি সরল মুখে প্রশ্ন করলেন, তুমি বিড়ি খাইতা? আমি সবেগে মাথা নেড়ে বললাম, না মাস্টারমশয়, অমুক কাকার লিগ্যা। মাস্টারমশাই নিশ্চিন্ত হয়ে বিড়ি দিলেন।

চাকরি আর তাঁর হয়নি। তবে যত দূর জানি, তাঁর দোকানটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে।

সমস্যা হল ‘টুপটুপাটুম’ শব্দটা নিয়ে। দীর্ঘ ত্রিশ-চল্লিশ বছর আমি নানা সময়ে ওই শব্দটির অর্থ খুঁজবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কে আমার গুরুভাই দিবাকরের বাড়িতে কিছু দিন ছিলাম। সে ময়মনসিংহের লোক, তার ছেলের নাম ‘দিবালোক’, কিন্তু বলার সময়ে বলে ‘দিবালুক’। কিছুতেই ছেলেটি বা তার মা-বাবাকে দিয়ে ‘দিবালোক’ উচ্চারণ করাতে পারিনি। তখনই হঠাৎ এক দিন ‘টুপটুপাটুম’ শব্দটিরও রহস্যভেদ হয়ে গেল। ময়মনসিংহ মানেই হচ্ছে উ-কার। সেই ফরমুলায় ফেলে জলের মতো বুঝতে পারলাম, ‘টুপটুপাটুম’ কথাটার মানে হচ্ছে ‘টপ টু বটম’। এই সোজা কথাটা বুঝতে বড্ড লম্বা সময় লাগল, এই যা।

লেখাঃশীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সৌজন্যে সুমন ঘোষ

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.