Header Ads

৯৯ টি আসন পেয়ে উৎসব করছে কংগ্রেস হাস্যকর ছাড়া কিছু নয়

৯৯ আসন নিয়ে কংগ্রেসের উৎসব সত্যিই হাস্যকর
•••
প্রশান্ত চক্রবর্তী
•••

প্রিয় পাঠক, মহাভারতের এক চিরন্তন দৃশ্য স্মরণ করুন। দ্রোণপর্বে কৌরবদের যত রথী- মহারথী ছিলেন সকলেই একে একে অভিমন্যুর কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন। কারা কারা? প্রথমে পাঁচজন মহারথী। স্বয়ং দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, কর্ণ ও শল্য। এঁরা চারদিক থেকে ঘিরে শরবর্ষণ করেছেন। কিন্তু অভিমন্যুর শরাঘাতে শুরুতেই মূর্ছিত হন শল্য। শল্যের ভাই মারা যান অভিমন্যুর হাতে। 
   এরপর একের পর এক মহারথীর আক্রমণ। দুঃশাসনের অবস্থাও ভয়াবহ। জ্ঞান হারাতেই রথ সমেত সেই দুর্জনকে নিয়ে পালায় সারথি। এরপর কর্ণ। মুহূর্তেই কর্ণের এক ভাইয়ের শিরশ্ছেদ করেন অভিমন্যু। কর্ণও টিকতে পারেননি। অভিমন্যুর আক্রমণে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এরপর শল্যের পুত্র রুক্মরথ ও দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণ অভিমন্যুর হাতে নিহত হন। মহাভারতকার লিখছেন : "প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্যোধন স্বপক্ষের বীরগণকে উচ্চস্বরে বললেন, আপনারা অভিমন্যুকে বধ করুন। তখন দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদবল ও কৃতবর্মা--এই ছয় রথী অভিমন্যুকে বেষ্টন করলেন।"(রাজশেখর বসুর মহাভারত, পৃ ৪২২)।এই অবস্থায়ও কোশলরাজ বৃহৎবলও অভিমন্যুর দ্বারা বীরগতিপ্রাপ্ত হন। সমবেত আক্রমণেও কোনো মতেই যখন এই মহাবীরের সঙ্গে পারা যাচ্ছিল না, তখন দ্রোণাচার্যের মতো প্রাজ্ঞও কর্ণকে বলেছিলেন, "একে এভাবে প্রত্যক্ষ সমরে কেউই পরাস্ত করতে পারবে না। তুমি ওর ধনু ছিন্ন করো, অশ্ব ও সারথিকে বিনষ্ট করো, তারপর পশ্চাৎ থেকে আক্রমণ করো যদি বধ করতে চাও।"(পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ ৪২৩)। 
   এর পরের করুণ ইতিহাস আমরা জানি। কৌরবপক্ষের এই পাষণ্ডরা সমবেত আক্রমণ করে অভিমন্যুকে মেরেছিল। একা কেউই টিকতে পারেনি। তাই যূথবদ্ধ আক্রমণ। 
   সুশীল পাঠক, সেটা ছিল দ্বাপর যুগের ঘটনা। কিন্তু এই ঘোর কলি যুগেও মহাভারতের সেই সমবেত আক্রমণের মতো একটি রাজনৈতিক ঘটনা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। তফাৎ অবশ্য আছে। আজকের ভারতে যিনি সমবেত রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার তিনি অভিমন্যুর মতো বালক-কিশোর নন। রাজনৈতিক জ্ঞানে-অভিজ্ঞতায় তিনি ভীষ্মতুল্য, যুক্তিসিদ্ধ শাণিত বাক্য-আক্রমণে তিনি অর্জুনতুল্য। আর জীবনদর্শনে, ভক্তি-জ্ঞান-কর্মযোগে তিনি কৃষ্ণতুল্য। তাঁকে বেষ্টন করে হারানো সহজসাধ্য নয়।
    মহাভারত তো একটি সিম্বলিক বা প্রতীকী কাহিনি। প্রতীকের ভেতর দিয়ে আবহমানকালের সারসত্য তুলে ধরা হয়েছে। অভিমন্যুর ঘটনাটির চিরকালীন সত্য হল, বিরুদ্ধশক্তি যখন একা জয়ী হতে পারে না তখন দল গুটিয়ে আক্রমণ করে। তবু তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা চাইই চাই। 
    সাম্প্রতিক ভারতের রাজনৈতিক আঁতাত আর যূথবদ্ধ আক্রমণের প্রেক্ষিতে মহাভারতীয় কাহিনিটি মনে পড়ে না কি? 
    কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, সিপিআইএমএল, ডিএমকে, এনসিপি-শরদ, শিবসেনা-উদ্ধব, মুসলিম লিগ, ন্যাশনাল কনফারেন্স, জেএমএম, কেরালা কং, কেরালা কং এম, লালুর পোলার আরজেডি, এমডিএমকে, কেএমডিকে, আইএসএফ, সঙ্গে আরও খুচরোখাচরা কিছু দল। মোট ২৮টি দল। বিরাট কৌরব বাহিনীর মতোই বটে। এরা এককাট্টা হয়েছে বলতে গেলে একজনের বিরুদ্ধে। তিনি নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। তবে তিনি অভিমন্যু নন। অত সহজে পরাস্ত হবার পাত্রও নন। এটা তাঁর শত্রুপক্ষও জানে। বড্ড জেদি মানুষটি। যা ভাবেন তা-ই করেন। ২০০১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে ২০১৪ থেকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন তিনি। সমুখ সমরে তাঁকে কেউই পরাস্ত করতে পারেনি। এক এক করে সব রথী-মহারথীই ধরাশায়ী হয়েছেন। তিনি যা করার করেছেন। ৩৭০ তুলে দিয়েছেন। রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিন তালাক নামক ধর্মীয় অন্ধ প্রথা আইন করে মুছে ফেলেছেন। প্রথমে "ক্যাব" পরে "কা" এনেছেন। নাগরিকত্ব পাচ্ছে ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার লোকেরা। ব্রিটিশের কালা আইনগুলো বাতিল করেছেন। তিন লক্ষ ভুয়া সংস্থাকে বন্ধ করেছেন। নোটবন্দি করে কালাবাজারি, উগ্রপন্থীদের মাজা ভেঙে দিয়েছেন। জিএসটি লাগু করে সারা দেশে এক করব্যবস্থা চালু করেছেন। 
   এসব তো একেকটি যুদ্ধই। রাজনৈতিক যুদ্ধ। এই লড়াইয়ে তিনি  সমস্ত বিপক্ষকে একে একে ধরাশায়ী করেছেন। আধুনিক  কর্ণ, শৈল্য অশ্বত্থামা তাই জোট বেঁধে সমবেত আক্রমণে নেমেছেন। মহাভারতে দ্রোণ যেমন বলেছিলেন :"এর তুল্য ধনুর্ধর আর আছে কিনা এমন মনে হয় না। এ ইচ্ছা করলেই আমাদের সেনা সংহার করতে পারে...।...যদি বধ করতে চাও ওকে রথহীন ধনুহীন করো।"(পৃ ৪২৩)। এই একরকম আহ্বান এবারও দেখা গেছে। "মোদি হটাও দেশ বাঁচাও"। বিরোধীরা বুঝেছে, একা কোনো দলের পক্ষে একে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। তাই ঘোঁট পাকাও, জোট বাঁধো। ঘিরে ফ্যালো। "ইন্ডিয়া" নামটি বেশ সেন্টিমেন্টাল। ২৮টি দলের একটাই লক্ষ। মোদির পতন। নইলে বিপদ। কেননা, ইনি হুমকি দিয়েছেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে আরও কড়া পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে দুজন মুখ্যমন্ত্রী জেলের ভাত খাচ্ছেন। রাজনৈতিক মহলে ফিসফাস : এর কি তাহলে ইয়ে...? থাক। নামটা কল্পনা করুন। ইনি ক্ষমতায় এলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হবে। এক দেশ এক আইন। সবার জন্যে এক আইন। ধর্ম দিয়ে আইন ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে না। ইনি "এক দেশ এক ভোট" করতে চান। ইনি সংরক্ষণ তুলে গুণগত মানবসম্পদ বিকাশ চান। অর্থাৎ, সমস্ত চক্রব্যূহর জাল ইনি কেটে এক মুক্ত আধুনিক সমৃদ্ধ ভারত নির্মাণ করতে চান। তাই "আক্রমণ" বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। 
    এবারের নির্বাচন একা এবং কয়েকজনের লড়াই। একাই তো। ভারতীয় জনতা পার্টি যতই যা বলুক, মুখটা কিন্তু মোদির। তাই একাই একশ। না না, থুক্কু। একাই ২৪০। ইন্দিরা গান্ধির হত্যার পর মানুষের সমবেদনাকে পুঁজি করে কংগ্রেস ৪০০ পার করেছিল। ১৯৯১-তে পিভি নরসিংহ রাওয়ের সময় কংগ্রেস ২৪৪টি আসন পেয়েছিল। এরপর ২০১৪ পর্যন্ত আর কোনো দলই এককভাবে সরকার গড়তে পারেনি। এত বড় সংখ্যা পায়নি। অগত্যা অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে "মিলিজুলি সরকার"-এর কালচার শুরু হল। কংগ্রেসও একই পথে হাঁটল। ২০১৪-তে তিনি এলেন ২৮২টা আসন নিয়ে। ২০১৯-এ সেটা ৩০২। ভারতীয় জনতা পার্টি নামক দলটি কংগ্রেস নামক(অনেকে বলেন এটি তো আদি কংগ্রেস নয়। নকল গান্ধি-পরিবারের পারিবারিক কংগ্রেস) বিরাট দলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার মূল কারিগর কিন্তু তিনিই। যে যা-ই বলুক। 
   এবারের নির্বাচনে আশানুরূপ ফল হয়নি এটা ঠিক। এর বহুমুখী কারণ আছে। সে-নিয়ে স্বতন্ত্র নিবন্ধ হতে পারে। কিন্তু এককভাবে একটি দল ২৪০ আসন পাওয়া কম কথা নয়। পূর্বাপর ইতিহাস ও তথ্য কিন্তু তা-ই বলছে। আবার বিরোধীরা সকলে মিলে টেনেটুনে ২৩৩। তারমধ্যে কংগ্রেস তিন অঙ্কেও পৌঁছুতে পারেনি। ৯৯-এ থামতে হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে সমাজবাদী পার্টি ৩৭ আর তৃণমূল ২৯। বাকিটা খুচরো। এহেন পরিস্থিতিতেও বিরোধীরা হল্লা শুরু করেছে "মোদি হটাও"। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দাবি করেছেন, মোদি পদত্যাগ করুন। রাহুল গান্ধি তো এক কাঠি আগে। বাকিরা সানাইয়ের পোঁ। কেন ভাই? মোদি পদত্যাগ করবেন কেন? কী কারণ? মোদি তো ২৪০। সর্ববৃহৎ দলনেতা। তারপরও কেন তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে? এর কোনো সদুত্তর নেই বিরোধীপক্ষের কাছে। আলটপকা, ভিত্তিহীন, রাজনৈতিক আক্রোশজনিত দাবি। এই দাবি গণতন্ত্রের দাবি হতে পারে না। রাজনীতি বিজ্ঞানের সামান্য ছাত্রও বলতে পারবে লোকসভায় এককভাবে কোনো দলের ২৪০ কত বিরাট সংখ্যা। আর যদি এনডিএ-র সহযোগী দল ধরা হয় তাহলে তাহলে ম্যাজিক নম্বর ২৭২-এর অনেকটাই ওপরে। ২৯২।  
   দেশটা সত্যিই অদ্ভুত মাইরি। বিরোধিতা করার জন্যে বা ক্ষমতার জন্যে এতটা নীচে নেমে লাভ হবে কি? সেই লাভের গুড়ে বালি। মোদির প্রধান দুই সহযোগী চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি পেয়েছে ১৬ টি আর নীতিশকুমারের জেডিইউ ১২। এঁরা দুজনে মিলে সরে গেলেও এনডিএ ২৬৪টিতে দাঁড়াবে। মাত্র ৮টি সিটের জন্য মোদি-অমিত জুটির শনিমঙ্গল বার লাগবে না। 
    ক্ষমতায় থাকতে থাকতে একটা নেশা ধরে যায়। রাজনীতিতে তাই ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতা চাই। একশর নীচে থেকেও কংগ্রেস বা উনত্রিশে বসে নির্লজ্জের মতো তৃণমূলের এই অসঙ্গত দাবি গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়।
•••
কথা : ৭০০২৭৯১৭৭৩
•••

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.