Header Ads

আন্দামানে রস আইল্যান্ড ঘুরে এসেছি

 নয়া ঠাহর। ,আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ভারতবর্ষের অধীনে থাকা বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৫৭২ টি ছোটবড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জ। চোখ ধাঁধানো সুনীল জলরাশি এবং তার সঙ্গে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য প্রতিটি ভ্রমণকারীর মন ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু এই আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেই রয়েছে অভিশপ্ত এক দীপ রস আইল্যান্ড। আসুন জেনে নিই এই রস আইল্যান্ড সম্পর্কে অজানা বিশেষ কিছু তথ্য।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫৭২টি দ্বীপপুঞ্জ থাকলেও সেগুলির মধ্যে মাত্র ৩৮টি দ্বীপে মানুষের বসতি আছে। এখানকার চোখ জুড়িয়ে দেওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভিতরেই লুকিয়ে আছে অন্ধকার ইতিহাস এবং ভৌতিক অনুসর্গ।

এই দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম ছোট্ট একটি দ্বীপ রস আইল্যান্ড। ভারতবর্ষ এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য এই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে স্যর ড্যানিয়েল রসের নামানুসারে। তিনি ছিলেন ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের একজন বিশেষজ্ঞ জরিপকর্মী। পোর্টব্লেয়ার বন্দরকে পাহারা দেওয়ার কাজে তিনি এই দ্বীপকে চিহ্নিত করেন। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ শাসনে এই দ্বীপই ছিল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের হেড কোয়ার্টার।

ড্যানিয়েল রসের পাশাপাশি এই রস আইল্যান্ড দ্বীপে আরো একজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি হলেন আর্চিব্যাল্ড ব্লেয়ার। তিনিও ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক জরিপকর্মী। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নামে এই সমগ্র দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারের নামকরণ করা হয়। তার আগে এর নাম ছিল পোর্ট কর্নওয়ালিস। কিন্তু এই ভূখণ্ডের থেকেও বেশি বাসযোগ্য ছিল রস আইল্যান্ড।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ছিল নৈসর্গিক দৃশ্য ও প্রতিকূলতার সহাবস্থানের আদর্শ একটি উদাহরণ। চরম প্রতিকূলতার জন্য এখানেই দ্বীপান্তরের জায়গা কেন্দ্র করা হবে বলে ঠিক করেন ব্রিটিশ শাসকরা। আন্দামানে ব্রিটিশদের পা পড়ার প্রায় ষাট বছর পরে সিপাহি বিদ্রোহের পরে বন্দিদের আনা হয় এখানে। ৭৭৩ জন বন্দিকে নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছন জেলর জেমস প্যাটারসন। 

তারও কিছুদিন পরে কলকাতা থেকে আন্দামানে পা রাখেন আরও ২০০ বন্দি। তাঁরা ছিলেন মূলত সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতিবাদীরা। জেলর প্যাটারসনের নির্দেশে তাঁদের পাঠানো হয় রস দ্বীপে। নির্মম অত্যাচারের মধ্যে তাঁদের লাগানো হল বন কেটে বসতি স্থাপন তৈরির কাজে। নিজেদের থাকার ছাউনি থেকে সাহেবদের বাংলো তৈরি হতে লাগল অনাহারী এইসব বন্দিদের শ্রমে।

০.৩ বর্গকিমি আয়তনের এই রস দ্বীপ তখন ঘন বনে ঢাকা। জঙ্গল কেটে দ্বীপকে বাসযোগ্য করার বহু পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে হয়েছিল বন্দিদের। তখন ব্রিটিশ সাহেবরা ছিলেন জাহাজে। তাঁরা ডাঙায় পা রাখেননি।শাসনের কেন্দ্রবিন্দুকে মনের মতো করে সাজিয়েছিল ব্রিটিশরা। বিলাসবহুল বাংলো, বড় গির্জা, বলরুম, বেকারি থেকে শুরু করে সমাধিস্থান। সব জায়গাতেই ছিল আধিপত্যের ছোঁয়া। জীবনযাপনের সব প্রয়োজনকে এখানে বন্দিদের দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকরা ।

 দ্বীপান্তরে থাকা বন্দিদের যথেচ্ছ মৃত্যু হত ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া এবং পেটের অসুখে। সে সময় তাঁদের উপর কুইনাইন ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতেন শাসকরা। শোনা যায় সে সময় দশ হাজার বন্দিকে জোর করে কুইনাইন খাওয়ানো হয়েছিল। এর ফলে তাঁরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। 

১৯৪১ সালে বিধ্বংসী এক ভূমিকম্প হয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। কিন্তু তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি পোর্টব্লেয়ার বা রস আইল্যান্ডের ব্রিটিশ উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করে জাপানিরা। 

বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের পরে আবার ক্ষমতায় ফেরেন ব্রিটিশরা। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদেরও ভারতবাসের সময় ক্রমশ শেষ হয়ে আসে।এর পর দীর্ঘদিন রস আইল্যান্ড পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। ১৯৭৯ সালে এখানে কেন্দ্র তৈরি করে ভারতীয় নৌসেনা।

রস আইল্যান্ডের বাসিন্দা এখন একপাল হরিণ। বিশ শতকের গোড়ায় হরিণদের সেখানে রাখা হয়েছিল ব্রিটিশদের শিকার শিকার খেলার জন্য। সেই খেলা বন্ধ হয়েছে বহু দিন। দ্বীপের সবুজকে আশ্রয় করে অতীত কারাগারে নিভৃতবাস করছে হরিণের দল।

খুব সম্প্রতি ২০১৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই দ্বীপের নতুন নামকরণ করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামানুসারে।এখন পর্যটকরা দেখতে যান দ্বীপ জুড়ে পড়ে থাকা ব্রিটিশ শাসনের কঙ্কাল। বুনো লতাপাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় ব্রিটিশ কমিশনারের অতীত বাংলো, গির্জা এবং নাম পরিচয়হীন অজস্র দেওয়াল।

অতীতের প্রাণস্পন্দনের সব চিহ্নকে নিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে এই দ্বীপ। একথা বলা হয় অতীতের বন্দিদের আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায় পরিত্যক্ত জনপদের আনাচে কানাচে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.