সত্যজিৎ রায় ও কাঞ্চনজঙ্গা ছবি আজ ইতিহাস
ঘটনাটা হয়তো অনেকেরই জানা। তবু আজকের দিনে আর একবার শোনাতে ইচ্ছে করছে। স্থান দার্জিলিং। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির শুটিং চলছে। সত্যজিতের প্রথম রঙিন ছবি। তখনকার দিনে রঙিন ফিল্ম জোগাড় করা খুব সহজসাধ্য ছিল না। একমাত্র ‘কোডাক’ কোম্পানি দেশে দেশে রপ্তানি করে। অনেক আগে থেকে বরাত দিতে হয়। বাণিজ্যিক এবং প্রশাসনিক বাধা পেরিয়ে পরিচালকের হাতে পৌঁছতে লেগে যায় মাসখানেক।
একে রঙিন ছবি। তায় আবার ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, অনিল চ্যাটার্জির মতো নামজাদা ব্যস্ত কলাকুশলীদের নিয়ে কাজ। সাধারণত ছবি করতে কত রীল ফিল্ম লাগবে, তার হিসেব করতে মানিকবাবুর ভুল হয় না। এবারও হিসেব ঠিকঠাকই ছিল। বাধ সাধল প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। পরপর দুদিন কাজের মাঝপথে মেঘলা করে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। বেশ খানিকটা ফিলম নষ্ট হয়ে গেল। পরিচালকের মাথায় হাত। একে রঙিন ফিল্ম জোগাড় করা কঠিন। তার ওপর রঙিন ছবি হলেও কম বাজেটের ছবি। প্রযোজক মানিকবাবু নিজে। এমতাবস্থায় শুটিং বন্ধ করে কোলকাতা ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আবার পরে সবাইকে একজোট করা যেমন সময়সাপেক্ষ ঠিক ততটাই ব্যয়সাপেক্ষ। চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গেল সত্যজিতের। ঠিক তখনই ইউনিটের অন্যতম সদস্য বংশীবাবু (আলোকচিত্র সম্পাদক বংশীচন্দ্র গুপ্ত) একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখালেন।
একই সময় দার্জিলিং-এ শুটিং চলছে এক বলিউড ছবির। ছবির নাম ‘প্রফেসর’। যার নায়ক তথা প্রযোজক শাম্মী কাপুর। আজও যেমন, সেদিনও তেমনটাই ছিল। বাজেটের প্রশ্নে বলিউড টলিউডকে কয়েক যোজন পেছনে ফেলে দিত হেলায়। সত্যজিৎ তাঁর দলবল নিয়ে উঠেছেন ম্যাল-এর কাছে মাঝারি মানের একটা হোটেলে। আর শাম্মী কাপুরের দল রয়েছে বাজার এলাকার সবথেকে নামকরা ‘সিনক্লেয়ার হোটেল’-এ (শিলিগুড়িতেও এদের একটা শাখা আছে)।
সত্যজিৎ কয়েকজনকে নিয়ে গেলেন ‘সিনক্লেয়ার’-এ শাম্মী কাপুরের সঙ্গে দেখা করতে। সন্ধেবেলা হোটেলের লাউঞ্জে শাম্মীজি তাঁর লোকজনকে নিয়ে আড্ডা বসিয়েছেন। হঠাৎ সত্যজিৎ রায়কে সেখানে ঢুকতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। ‘পথের পাঁচালি’ আর ‘অপরাজিত’-র দৌলতে সত্যজিৎ তখন এক বিশ্বজোড়া নাম। শাম্মী কাপুর আরও অবাক হলেন, যখন সত্যজিৎ তাঁর সামনে এসে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘মে আই টক টু ইউ?” শশব্যস্ত শাম্মী কাপুর উঠে দাঁড়িয়ে সত্যজিতকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর টেবিলে। টুকরোটাকরা কুশল বিনিময়ের পর খানিকটা দ্বিধা নিয়েই সত্যজিৎ তাঁর সমস্যার কথা বললেন। শাম্মী কাপুর মানিকবাবুর দুটো হাত ধরে বললেন, “দাদা, আপনার ক’টা ফিল্ম লাগবে?” “তিনটে হলেই আমার কাজ শেষ করে ফেলব। আর কোলকাতা ফিরেই আমি ফিল্ম পাঠিয়ে দেব আপনাকে।” জিভ কাটলেন শাম্মী, “দাদা, শরমাইয়ে মৎ। ফিল্ম ফেরত দিতে হবে না। বিশ্ববিখ্যাত একজন পরিচলককে এ আমার সামান্য উপহার।”
মানিকবাবু শাম্মীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলেন। অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। ছবির কাজ একদম শিডিউল মেনে শেষ করতে পারবেন। এতক্ষণ পর্যন্ত অভিনেতা অভিনেত্রীরা কেউই এই বিপদের কথা জানতেন না। হোটেলে ফিরে সবাইকে ঘটনাটা খুলে বললেন মানিকবাবু। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ছবি বিশ্বাস আড়ালে বললেন, “ঢ্যাঙাকে সবাই খুব মানে।”
পরদিন সকাল না হতেই শাম্মী কাপুর ফিল্ম পাঠিয়ে দিলেন। সত্যজিৎ চেয়েছিলেন তিনখানা। শাম্মী পাঠিয়েছেন পাঁচখানা। যদিও তিন রীলেই কাজ হয়ে গেল। দুটো তখনই ফেরত পাঠিয়ে দিলেন সত্যজিৎ।
কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারত। শুধু হল না ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোয়নি বলে। সত্যজিৎ কোলকাতায় ফিরেই ফিল্ম জোগাড় করার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। শাম্মী যা বলেছেন সেটা তাঁর ভদ্রতা। বিপদের সময় যে পাশে দাঁড়িয়েছে তার জিনিস তাকে ফেরত দেওয়াটা মানিকবাবুর শিষ্টাচার। অবশেষে ফিল্ম এল। মানিকবাবু পাঠিয়ে দিলেন শাম্মী কাপুরের ঠিকানায়। সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটা এক পাতার চিঠি। শাম্মী ইউনিটের লোকজনকে ডেকে চিঠি পড়ে শোনালেন আর ফিল্মের রীলগুলো তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এতে মানিকবাবুর ছোঁয়া আছে। এই ফিল্মে আমরা কোনদিন ছবি করব না।” আজও আর.কে.স্টুডিওর আর্কাইভে শোভা পাচ্ছে সত্যজিতের সেই চিঠি আর তিন রীল ফিল্ম।
(সংগৃহীত)
কোন মন্তব্য নেই