Header Ads

মিঠুন চক্রবর্তীর জীবনের লড়াই বাঙালি দের শিক্ষা দেবে

উত্তর কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারী থেকে স্কুল পাস করে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে কেমেস্ট্রী অনার্স নিয়ে স্নাতক হয়েছিলেন মিঠুন। রহড়া পলিটেকনিকে এডমিশন নিয়েছিলেন কিন্তু সম্পুর্ন করতে পারেননি। ১৯৭০ সালে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। উত্তাল সময়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে বম্বেতে কাকার বাড়িতে আশ্রয় নেন, কিন্তু কিছুদিন পরে নকশাল পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় কাকা আর রাখতে রাজি হননি। 
সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ে মাত্র উনিশ বছর বয়সে কলকাতা ছেড়ে বম্বে পাড়ি দেওয়ার সময়েও মিঠুন ভাবেননি যে তিনি অভিনেতা হবেন। ভেবেছিলেন কিছুদিনের জন্যে শহর ছাড়ছেন। কলকাতা শান্ত হলে আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু পাকেচক্রে বম্বেতে কিছু বন্ধুর সাথে একদিন হঠাৎ পুনের FTII তে গিয়েই সব এলোমেলো হয়ে যায় গৌরাঙ্গর। সেইজন্যেই পরবর্তিকালে  মিঠুন হিসাবে উত্তরনের পর বলেছেন আমি কোন এম্বিনেশন থেকে অভিনেতা হইনি। আমি কম্পালশন থেকে এক্টর হয়ে গেছি।
সাংবাদিক আলি পিটার জনকে একবার মিঠুন বলেছিলেন যে - "কলকাতায় আমি যে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং নকশাল নেতা চারু মজুমদারের ঘনিষ্ঠ ছিলাম তা সিনেমা জগতের ও জগতের বাইরে অনেকেই জানতেন। পরিবারে একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার (ভাইয়ের মৃত্যু) পর আমি এই আন্দোলন থেকে সরে আসি। কিন্তু নকশাল হিসেবে আমার পরিচয় কিন্তু পিছু ছাড়েনি। পুনের এফটিআইআই এমনকি সত্তরের দশকের শেষে মুম্বাই অবধি আমার এই পরিচয় আমাকে ধাওয়া করে বেরিয়েছে।"
রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার পরে FTII এর কোর্স করতে গিয়েও সমস্যায় পড়েছিলেন মিঠুন। ইন্সটিটিউট থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কতৃপক্ষ। শেষে শেষে সংস্থার ডিরেক্টর রোশন তানেজার সাথে সরাসরি কথা বলেন তিনি। মিঠুনের নাছোড়বান্দা মনোভাব আর যুক্তির আছে হার মেনে তাকে রাখতে বাধ্য হন রোশন তানেজা।

মৃগয়া দিয়ে অভিনয় জীবনের শুরু রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেয়ে শুরু করলেও বলিউডে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে দো আনজানে , মুক্তি আর ফুল খিলে হ্যায় গুলশন গুলশনের মতো ছবিতে দুই মিনিটের রোলে বা ভিলেনের শাগরেদের গুরুত্বহীন ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।

মিঠুনের ভাষায় - "যেদিন বম্বে স্টেশনে নেমেছিলাম বিশ্বাস করুন পকেটে টুথব্রাশ কিনবার পয়সাটুকুও ছিলো না।" বম্বেতে কখনো আন্ডার কন্সট্রাকশন সাইটে ঘুমিয়ে, ফুটপাথে বাতিল কাপড় বিক্রি করে পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে প্রথম বিভাগে স্বর্ণপদক নিয়ে পাশ করেন মিঠুন। সেই সময়ে তার সহপাঠি ছিলেন শক্তি কাপুর এবং গুলশন গ্রোভার। রানা রেজ ছদ্মনামে ছোটখাটো মডেলিং করেছেন।
৭৫ টাকা মাসিক ভাড়ায় পেইং গেস্ট হিসাবে থেকেছেন একসময়ে। সঙ্গি ছিল এক দক্ষিন ভারতীয় যুবক। কেউ কারোর ভাষা বুঝতো না। মিঠুনের চেয়ে বেশী টাকা দিতো বলে সেই ছেলেটা চৌকিতে ঘুমাতো আর মিঠুন ঘুমাতেন মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে। একবার সারাদিন ঘোরাঘুরি  করে এসে ক্লান্ত মিঠুন সেই রুম পার্টনারের খাটে ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর মিঠুনের ভাষায় - হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে ব্যাটা দেখতে পায় আমি ওর চৌকিতে ঘুমিয়ে আছি। আর যায় কোথা! দক্ষিনী ভাষায় আমাকে ভয়ানক গালাগালি শুরু করলো। আমি কোনওরকমে আকারে ঈঙ্গিতে ক্ষমাটমা চেয়ে সেই যাত্রায় রেহাই পাই। তবে ওর সাথে থাকাটা পরে আমার খুব কাজে লেগেছিলো। অগ্নিপথে ওর গালাগালি দেওয়ার স্টাইলটা পুরোপুরি নকল করে দিয়েছিলাম।

১৯৭৪ সালে পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে একটি নাটক প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারপতি হিসাবে এসেছিলেন মৃনাল সেন। সেই প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার পেয়েছিলেন মিঠুন। পরবর্তিকালে মৃগয়া ছবির আদিবাসী  নায়কের জন্যে বলিষ্ঠ গড়নের কালো যুবকের দরকার পড়লে মৃনাল সেনের মিঠুনের কথা মনে পড়ে। জোড়াবাগানের পঞ্চানন দাসের ব্যায়ামাগারে নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন মিঠুন। কলেজ জীবন কুস্তিগীর হিসেবেও বেশ নাম ডাক হয়েছিল তাঁর।
মিঠুন সেই সময়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন।
মৃনাল সেন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে মিঠুনের ঠিকানা জোগাড় করেন। মিঠুনের কাছে খবর যায় মৃনাল সেন তাকে খুঁজছেন, পোর্ট ফোলিও পাঠাতে বলেছেন। খবরটা শুনে প্রথমে ভীষন অবাক হয়ে গেছিলেন সেই সময়ের গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী, কারন মৃনাল সেনের মতো বিখ্যাত পরিচালকের সাথে তাঁর কোন পূর্ব পরিচিতি ছিলো না। পোর্ট ফোলিও সমেত মিঠুন দেখা করেন। গৌরাঙ্গ নাম পাল্টে মিঠুন নামটাও মৃনাল সেনের দেওয়া। জোড়াবাগানের পঞ্চানন দাশের ব্যায়ামাগারে নিয়মিত ব্যায়াম করা আর ফ্রী স্টাইল কুস্তি করে তৈরী করা শরীরটা মৃগয়ায় বলিষ্ঠ সাঁওতাল ঘিনুয়ার চরিত্রের জন্যে দারুন ভাবে মানিয়ে যায়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের সংগ্রামী জীবন ছিলো মৃগয়ার সাব্জেক্ট।
মৃগয়া ছবির শেষ দৃশ্যে যখন আদিবাসী যুবক ঘিনুয়ারূপী মিঠুনের ফাঁসী হয় তার আগের মুহুর্তের অভিব্যক্তি কিরকম হবে সেই বিষয়ে মিঠুন পরিচালক মৃনাল সেনের কাছে জানতে চান। মৃনাল সেন তাকে বলেছিলেন - "চিড়িয়াখানায় খাঁচায় বন্ধ বাঘের চলাফেরা আর তাকানো দেখেছিস?" মিঠুন উত্তর দিয়েছিলেন - "ব্যাস আর বলতে হবে না বুঝে গেছি।" যারা মৃগয়া দেখেছেন তাদের কে আলাদা করে বলার দরকার নেই যে দৃশ্যটার কি সার্থক রূপায়ন ঘটিয়েছিলেন মিঠুন। মৃগয়ার শুটিং চলাকালীন মিঠুনের ডেডিকেশন আর কমিটমেন্ট দেখে ছবির নায়িকা মমতাশঙ্কর বলেই ফেলেছিলেন - " তুই তো ছবিটা নিয়ে একদম পাগল হয়ে গেছিস রে!"
১৯৭৬ সালে কলকাতার রক্সি হলে মৃগয়া মুক্তি পায়। মিঠুনের বয়স তখন দশদিন কম ছাব্বিশ। মৃনাল সেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের রাষ্ট্রীয় সম্মান পান। মিঠুন চক্রবর্তী এমন একজন অভিনেতা যিনি নিজের প্রথম ছবিতেই রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন। সেই রেকর্ড আজও অক্ষত আছে।
মৃগয়ার পরে মিঠুন আর মৃনাল সেন একসাথে আর একটাই ছবিতে কাজ করেছেন, ১৯৮০ সালে "নকশাল"। এই ছবিটা খাজা আহমেদ আব্বাস অনেক আগে মিঠুনকে অফার করেছিলেন। কিন্তু ফিল্ম দুনিয়ায় নতুন ইমেজ তৈরীর জন্যে মিঠুন সেই সময়ে রাজী হননি। জনকে তিনি বলে ছিলেন, "কিন্তু আব্বাস সাহেবের নামটাই শেষ পর্যন্ত আমাকে এই চরিত্রে অভিনয় করতে উজ্জীবিত করে। ততদিনে, মানুষ আমাকে অভিনেতা থেকেও বেশি ড্যান্সার ও ফাইটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর, ঠিক এই সময়ে আব্বাস সাহেবের সিনেমায় একজন নকশালের ভূমিকায় অভিনয় করতে পেরে আমি সত্যি ধন্য হয়েছিলাম।"
শেষে ১৯৮০ সালে ছবিটা মিঠুনকে নিয়েই তৈরী হয়। ফ্লপ করেছিলো।
পরের দিকে মৃনাল সেন "ঢাকি" বলে একটা ছবির স্ক্রীপ্ট মিঠুনকে ভেবেই তৈরী করেছিলেন যেটা বিভিন্ন কারনে বাস্তবায়িত হয়নি। মিঠুন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন - যে আমি আজও একটা ফোনের অপেক্ষায় আছি মৃনালদা বলছেন 'ঢাকি শুরু করছি চলে আয়।'
মৃগয়া মুক্তির সময়ে মিঠুনের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। বাবা বসন্ত চক্রবর্তী  ছিলেন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামান্য কর্মী। বাবা, দুই ভাই , তিন বোন আর মাকে নিয়ে  চরম অনটনের সংসার ছিলো। বড়ভাই মিঠুন ফিল্মে আসার আগেই এক দুর্ঘটনায় মারা যান। বাবাকে সাহায্য করার জন্যে মিঠুন একসময়ে বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে টাকা ধার করে বড়বাজার থেকে আলু এনে বিক্রি করেছেন। তাঁর পুরষ্কার পাওয়ার খবর দিতে আসা সরকারি প্রতিনিধিদের বলেছিলেন " পুরষ্কার চাইনা আমার দুবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।"

মৃনাল সেনের কাছ থেকে ডাক পাওয়ার আগে FTII থেকে পাশ করবার পরে কলকাতায় ফিরে এসে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজা দেখতে বেরিয়েছিলেন। লম্বা হওয়ায় আর বেলবটস পরে ঘোরায় একটা প্যান্ডেলে ছেলে ছোকরারা অমিতাভ বচ্চন ! অমিতাভ বচ্চন এসেছে রে! বলে টিটকারি মারতে থাকে। তাদের দিকে তাকিয়ে নিজের সঙ্গি বন্ধুকে মিঠুন বলেছিলেন -"একদিন আমি এখানে আসবো সেদিন এরা বলবে অমিতাভ বচ্চন নয় মিঠুন চক্রবর্তী এসেছে।"
মৃগয়ায় রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেলেও বলিউডে নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া মিঠুনের পক্ষে অত সহজ হয়নি। পদে পদে লাঞ্ছিত হয়েছেন অপমানিত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশী অপমানিত হয়েছেন নিজের গায়ের রং নিয়ে। একসময়ে ভেবেছিলেন সত্যিই বোধহয় হিরো হতে পারবেন না। চিন্তা করছিলেন যদি ভিলেন হিসাবে দাঁড়ানো যায়। ফুল খিলে হ্যায় গুলশন গুলশন ছবিতে ভিলেনের ভূমিকায় একটি ধর্ষনের দৃশ্যে অভিনয়ও করে ফেলেন। ছবির নায়ক হৃষি কপূরের হাতে মারও খান। কিন্তু এইসব করেও প্রাপ্তির ভাঁড়ার আখেরে শূন্যই থেকে যায়। এক পরিচালকের কাজে কাজ চাইতে গেলে সেই পরিচালক তাকে বলেছিলেন - তোমাকে জামাকাপড় পরালে কেমন দেখাবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না! ক্ষিপ্ত মিঠুন জবাব দিয়েছিলেন - "কেন! আমি আমি কি আপনার সামনে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি নাকি?"
গায়ের রঙ সংক্রান্ত হিনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে মিঠুন নিজের ডান্স আর মার্শাল আর্টের ওপরে প্রানপনে জোর দেন। মিঠুনের ভাষায় - আমি এমনভাবে ডান্স আর ক্যারাটে দিয়ে নিজেকে গ্রুমিং করতে চেয়েছিলাম যাতে পর্দায় আমার গায়ের রং নিয়ে দর্শক চিন্তা করার অবকাশই না পায়। ডান্স এবং ক্যারাটের ক্ষেত্রে মিঠুন আক্ষরিক অর্থে ট্রেন্ড সেটার।

বম্বেতে থাকাকালীন বিক্রম মঙ্গোরা বলে এক বন্ধুর সাহায্যে একটা জীমখানার মেম্বারশীপ নিয়েছিলেন মিঠুন। না ব্যায়াম করার জন্যে নয়। যাতে সকালে উঠে অন্ততঃ ঠিকঠাক টয়লেটে যেতে পারেন সেই জন্যে। তারপরে সারাদিন স্টুডিও আর প্রয়োজক পরিচালকদের দরজায় দরজায় ঘোরাঘুরি। মাথার ওপরে কোন ছাদ ছিলো না। রাত্রে শিবাজী পার্কে শুয়ে থাকার সময়ে চুলের মুঠি ধরে পুলিশ নিয়ে গেছিলো থানায়। বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন। সেইদিনগুলোতে মাঝে ভেবে ফেলেছিলেন আত্মহত্যার কথাও। এইসব কারনেই কোন সাক্ষাৎকারে নিজের সংগ্রামী দিনগুলোর কথা বিশেষ বলতে চাননা মিঠুন। কারন হিসাবে বলেন আমার মতো বহু লোক বর্তমানে জীবনযুদ্ধের লড়াই লড়ছে, এইসব শুনলে তারা ভয় পেয়ে যাবে।

বম্বের একটা ক্রিকেট ময়দান সংলগ্ন হাসপাতালের হস্টেলে এক ছাত্রকে ম্যানেজ করে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। সেই ছাত্র শর্ত দিয়েছিলো তাকে টাকা দিলে থাকতে দেবে কিন্তু ভোর ছটার আগে হস্টেলের পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে হবে আর সন্ধ্যে ছটার পরে পেছনের পাঁচিল টপকেই ঢুকতে হবে। মিঠুন রাজি হয়ে যান। সেই মাঠে সেই সময়ে নেট প্র্যাক্টিস করতেন দিলীপ বেঙ্গসকার। বেঙ্গসকার বলেছিলেন - প্রায়ই দেখতাম হয় সকালে একটা কালো লম্বা মতো ছেলে মাঠের পেছনের পাঁচিল টপকে বাইরে যায় আর সন্ধ্যেবেলায় পাঁচিল টপকে হস্টেলে ঢোকে। সন্দেহ হওয়ায় একদিন আমরা কয়েকজন মিলে পাকড়াও করি। আমরা মারধোর করতে উদ্যত হওয়ায় ছেলেটা বলে ও চোর নয়। বাংলা থেকে কাজের সন্ধানে এখানে এসেছে। পয়সার খুব অভাব তাই এইসব করে এখানে সেখানে দিন কাটায়। আমরা ওর কথা বিশ্বাস করে ওকে ছেড়ে দিই। পরের দিকে সুপারস্টার মিঠুন হিসাবে ওর সাথে যতবার কোন না কোন পার্টি বা অনুষ্ঠানে ওর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে আমি শুধু দূর থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখতাম আর ভাবতাম কি পর্যায়ের কঠিন সংকল্প আর মানসিকতা থাকলে সেইদিনের ওই জায়গা থেকে আজকের এই জায়গায় পৌঁছানো যায়। খেলোয়াড় জীবনে ওর জীবন থেকে অনেক প্রেরনা নিয়েছি।

নিজের স্ট্রাগলিং পিরিয়ডে গায়ের রং নিয়ে মিঠুন অপমানিত হয়েছিলেন জিতেন্দ্রের কাছেও। মৃগয়ার রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেলেও বম্বেতে হিরো হওয়াটা ওনার পক্ষে সহজ হয়নি। নিজের পোর্ট ফোলিও সাথে নিয়ে এক স্টুডিও থেকে অন্য স্টুডিও ঘুরে বেড়াতেন। এইরকম ভাবেই একদিন হাজির হয়েছিলেন প্রয়োজক পরিচালক টি এল ভি প্রসাদের কাছে। সেই সময়ে প্রসাদ সাহেবের সাথে শুটিং করছিলেন সেই সময়ের বিরাট সুপারস্টার জিতেন্দ্র। টি এল ভি প্রসাদ কিন্তু মিঠুনের নাম আগেই শুনেছিলেন। মিঠুনের পোর্ট ফোলিও দেখে খুব প্রভাবিত হন। উনি জিতেন্দ্রকে বলেন এই ছেলেটা ন্যাশনাল এওয়ার্ড উইনার। বাংলা থেকে এসেছে বম্বেতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্যে। ওর কিন্তু সম্ভাবনা আছে। এসব শুনেও জিতেন্দ্র ছিলেন আশ্চর্য্যরকম নিরুত্তাপ। মিঠুনকে উৎসাহ দেওয়া দূরে থাক সাক্ষাৎ শেষে মিঠুন যখন উঠে চলে যাচ্ছেন তখন পেছন থেকে জিতেন্দ্র মিঠুনকে শুনিয়ে টি এল ভি প্রসাদকে বলেছিলেন - "ইয়ে কালিয়া হিরো বনেগা! অগর ইয়ে সালা হিরো বন জাতা হ্যায় তো ম্যাঁয় ফিল্ম হি ছোড় দুঙ্গা।" ঘুরে তাকাননি মিঠুন অপমানের জ্বালা বুকে নিয়েই চলে এসেছিলেন। ১৯৮২ তে জীতেন্দ্রকে জবাব দিয়েছিলেন ডিস্কো ডান্সার ছবির মাধ্যমে। ডান্সিং স্টারের স্ট্যাটাস মিঠুনের কাছেই হারাতে হয়েছিলো জিতেন্দ্রকে। পরবর্তীকালে মিঠুন আর জিতেন্দ্র স্বর্গ সে সুন্দর, এয়সা প্যায়ার কহাঁ, জাল, মর মিটেঙ্গে র মতো সুপারহিট ছবি একসাথে করলেও মিঠুন অনেকদিন জীতেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেননি। আবার সিনিয়র এক্টর হিসাবে জিতেন্দ্রকে সম্মান করেছেন কখনো কোন উদ্ধত পাল্টা বিবৃতি দেননি। স্রেফ পেশাদার সম্পর্কটা বজায় রেখে চলেছেন।
মনমোহন দেশাই তখন বিরাট পরিচালক প্রয়োজক। মিঠুন তখন ভীষন খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। প্রকাশ মেহেরা প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন - "মিঠুন চক্রবর্তীর বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো ভবিষ্যত নেই। অন্ততঃ আমি জীবনে কখনো ওকে নিজের ছবিতে নেবো না।"  মনমোহন দেশাইয়ের অফিসে গিয়ে হাজির হলেন। দেশাই সাহেব জানতেন ছেলেটা রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেয়েছে তাই ডেকে পাঠালেন। মিঠুন দেশাই সাহেবকে বললেন। - "আপনার নতুন ছবিতে একটা কাজ দিন। খুবই অসুবিধেয় আছি। খাওয়ার টাকা জোগাড় করাই দায় হয়ে উঠেছে। বিশ্বাস করুন দুইদিন ধরে ঠিকমতো কিছু খাইনি। একটা কাজ দরকার।" মনমোহন দেশাই সব শুনে একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন - "দুইদিন কিছু খাওনি শুনে খুবই খারাপ লাগলো এই টাকাটা রাখো। পেট ভরে খেয়ে নিও কিন্তু তোমার জন্যে আমার ছবিতে কোনো কাজ নেই ভাই।" মিঠুন নমস্কার করে চলে এসেছিলেন। বাড়িয়ে দেওয়া টাকাটার দিকে ফিরেও তাকাননি। পরের দিকে নিজের আর অমিতাভ বচ্চনের ডুবে যাওয়া ক্যারিয়ার বাঁচিয়ে তুলতে খ্যাতির তুঙ্গে থাকা মিঠুন চক্রবর্তীকে সাধাসাধি করে নিয়ে গেছিলেন এই মনমোহন দেশাই। অমিতাভকে নিয়ে "জাদুগর", অনিল কাপুরকে নিয়ে "জিন্দেগী এক জুয়া" দুটো বিগ বাজেটের ফিল্মের বিশাল ফ্লপের ধাক্কায় ধাক্কায় দেউলীয়া হতে বসা প্রকাশ মেহেরা ফাইনান্সারদের গুঁতো থেকে বাঁচতে মিঠুনের শরনাপন্ন হয়েছিলেন। অতীত ভুলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মিঠুন। প্রকাশের "দালাল" ছবিতে সাইন করেন। সুপারহিট "দালাল" ছবির মোট বাজেটের তিনগুন বেশী পয়সা বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে ধনেপ্রানে রক্ষা পেয়েছিলেন প্রকাশ মেহেরা।
তবে লড়াইয়ের দিনগুলোতে পাশেও পেয়েছিলেন অনেককে যারা তাঁর সংগ্রামকে সম্মান করেছে। সুনীল দত্ত, নবীন নিশ্চল, বিনোদ খান্না, রঞ্জিত, সেলিম খান এনারা বিভিন্ন সময়ে নির্মাতা নির্দেশকদের কাছে মিঠুনের নাম সুপারিশ করেছেন। নবীন নিশ্চল মিঠুনের নাম সুপারিশ করেছিলেন যশ চোপড়ার কাছে। কিন্তু ত্রিশূল ছবিতে যশ শচীনকে আগেই ফাইনাল করে ফেলেছিলেন। দর্শকদের দুর্ভাগ্য তারা ত্রিশূলে মিঠুনকে পায়নি। পেলে ছবির লাস্ট একশনটা হয়তো অন্যরকম হোত। "কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী" ছবিতে তাকে গুরুত্ব দিয়ে একটা বেশ বড় রোল দিয়েছিলেন ছবির প্রোডিউসার মহানায়ক উত্তমকুমার। শক্তি সামন্ত উঠতি মিঠুনকে নিয়ে বানিয়েছিলেন " খোয়াব "। অনিল গাংগুলী বানিয়েছিলেন "কৌণ ক্যায়সে?" বলার মতো পারিশ্রমিক প্রথম পেয়েছিলেন " প্রেম বিবাহ " ছবিতে। সেই সময়ে সরকারি বাসে অথবা অটোতে করে শুটিং এ আসতেন। প্রেম বিবাহে অভিনয়ের জন্যে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন পাঁচ হাজার টাকা। টাকাটা দিয়ে প্রোডিউসার জিজ্ঞাসা করেছিলেন - এই টাকা দিয়ে কি করবে? মিঠুন বলেছিলেন - সবার আগে মেসের ভাড়া মেটাবো। দুটো প্যান্ট আর একজোড়া জুতো কিনবো। আর চালাতে পারছি না।
নিজের কঠিন সংগ্রামের কথাগুলো ভুলতে পারেননি বলেই দিলীপ কুমার এবং সুনীল দত্তকে সাথে নিয়ে স্ট্রাগলিং এক্টরদের সাহায্যের জন্যে একটি প্রোডাকশন হাউস তৈরী করেন মিঠুন। ফ্লিম স্টুডীও সেটিং এলাইড মজদুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। নিজের বুদ্ধিমত্তার জোরে নায়িকা সালমা আগাকে দাউদ ইব্রাহীমের খপ্পর থেকে বাঁচিয়েছিলেন। সঞ্জয় দত্ত যখন টাডায় ফেঁসে গেছিলেন তখন অসহায় পিতা সুনীল দত্তের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মিঠুন। যখন খ্যাতির মধ্যগগনে ছিলেন তখন কলকাতায় প্রচুর পূজো উদ্ধোধন করেছেন আর মোটা অঙ্কের দর হেঁকেছেন। পরে দেখা গেছে সমস্ত টাকাগুলো বিভিন্ন সমাজসেবী গোষ্ঠির মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে ফেরার ফ্লাইট ধরেছেন। 
তাসখন্দ ছবিতে মিঠুনের অভিনয় দেখার পর নাসিরুদ্দীন শাহের মতো অভিনেতা বলেছেন - "একমাত্র মিঠুনই পারতো এই লেভেলে রোলটাকে নিয়ে যেতে। তাসখন্দে মিঠুনের অভিনয় দেখার পর বুঝতে পেরেছি আমার এখনো অনেক কিছু শেখা বাকি আছে।"  ভাবুন কে বলছেন!
মিঠুন যতই ফ্যাশন আইকন বা গ্ল্যামার বয় হিসাবে নিজেকে দেখাতে চান এক সময়ের কঠিন সংগ্রামের দিনগুলোতে যে অমানুষিক পরিশ্রম উনি করেছেন সেই কষ্টের ছাপটা কিন্তু চিরকালই ওনার চোখে মুখে লেগেছিল এটা ওনার মুখের দিকে ভালো করে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়।
মিঠুনের হিন্দী ছবির জগতে পদার্পনের প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হতে চললো বাঙ্গালী আজও কিন্তু অপেক্ষায় আছে আরেকটা দ্বিতীয় মিঠুন কবে পাওয়া যাবে এই আশায়।

সংগ্রহীত,
DM for Credit ❤️

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.