বরাক উপত্যকার পরিবেশ থেকে ভয়
লিলাপ্সফোবিয়া এবং প্লুভিওফোবিয়া..!
বরাক উপত্যকায় এগুলো থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ‘অ্যান্টলোফোবিয়া’
পাৰ্থঙ্কর চৌধুরী
লিলাপ্সফোবিয়া ৷ প্লুভিওফোবিয়া৷ অ্যান্টলোফোবিয়া৷
কখনও শুনেছেন এই শব্দগুলো? শোনেননি! তাই তো? না, শোনার কথাও নয়৷ অথচ এই তিনটি শব্দই বরাক উপত্যকার মানুষের মনস্তত্ত্বে জড়িয়ে রয়েছে৷ আবহাওয়া বিজ্ঞানের পরিভাষায় লিলাপ্সফোবিয়া (Lilapsophobia) হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন সম্পৰ্কে ভয়৷ প্লুভিওফোবিয়া (Pluviophobia)-র মানে হচ্ছে বৃষ্টিবাদল সম্পৰ্কে ভয়৷ আর অ্যান্টলোফোবিয়া (Antlophobia) মানে হল, বন্যা বা প্লাবনের ভয়৷ ভরা বৰ্ষায় বরাক উপত্যকায় আমরা এই আতঙ্ক বা ভয় নিয়েই বাস করি৷
এ বছর বৰ্ষা শুরু হওয়ার আগেই এই ভয় জাঁকিয়ে বসছে৷ মাঝ বৈশাখ থেকেই এ বার প্ৰকৃতির যে রুদ্র রূপ ধারন করেছে, তাতে ভয় না পেয়ে উপায়ই বা কী! অনেকেই বলছেন, বৈশাখে এত ঝড় বৃষ্টি আগে দেখেনি বরাক উপত্যকা৷ কিন্তু আমরা যদি সাম্প্ৰতিক অতীতের দিকে ফিরে তাকা্ তা হলে দেখতে পাই, গত কয়েক বছর ধরেই চৈত্ৰ শেষ হওয়ার আগে থেকেই দফায় দফায় ঝড় বৃষ্টি কাঁপিয়ে দিচ্ছে বরাক উপত্যকার ‘পিলে’! যেমন ২০১৭ সালের ২ এপ্ৰিল৷ প্ৰবল বৰ্ষণ, সঙ্গে শিলাবৃষ্টি আছড়ে পড়েছিল হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ জেলায়৷ ২০২০ সালের ১ এপ্ৰিল কাছাড়ের ভাগাডহরে বজ্ৰপাতে মৃত্যু হয়েছিল এক যুবকের৷ এমন আরও ঘটনা রয়েছে, যার ভিত্তিতে এ কথা বলাই যায় যে এ বছরই প্ৰথম বৈশাখে এমন শিলাবৃষ্টি, ঝড় বা প্ৰবল বৰ্ষণ প্ৰথম হয়নি, ঋতু-নিৰ্ধারিত সময়ের হিসেবেই এই অঞ্চল বরুণদেবের চোখ রাঙানি দেখতে শুরু করেছে!
তবে এ বছর খানিকটা বাড়াবাড়ি যে হচ্ছে না, তেমনটা নয়৷ এ বছরের ১ এপ্ৰিল সারা রাজ্যেই প্ৰবল ঝড়বৃষ্টি হয়েছে৷ রাজ্যের অন্তত ২২টি জেলায় ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক৷ এই ২২-এর মধ্যে বরাকের তিনটি জেলাও রয়েছে৷ এরপরও গত ২৫ এপ্ৰিল প্ৰবল বেগে ঝড় হয়েছে৷ ২৬ এপ্ৰিল ও ২ মে ফের প্ৰচণ্ড ঝড়ের সাক্ষী হয়েছে এই উপত্যকা৷ এখনও প্ৰকৃতির যে রূপ তাতে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, আগামী কয়েকদিন আরও বেশ কিছু ঝড়-ঝাঁপটা আমাদের কপালে রয়েছে৷
শিলাবৃষ্টি বা ঝড় ও বৰ্ষণকে একেক অঞ্চলে একেক নামে অভিহিত করা হয়৷ যেমন ভারত ও দক্ষিণ প্ৰশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বলা হয় ‘সাইক্লোন’৷ উত্তর-পশ্চিম প্ৰশান্ত মহাসাগরীয় ও দক্ষিণ-চিন সমুদ্ৰ সংলগ্ন এলাকায় বলা হয় ‘টাইফুন’৷ নৰ্থ আটলান্টিকে ‘হারিকেন’৷ জাপানে ‘তাইফু’৷ মাৰ্কিন যুক্তরাষ্ট্ৰে ‘টৰ্নেডো’৷
অঞ্চল ভেদে ঝড়ের রূপ ও আকারও পাল্টে যায়৷ যেমন আমাদের দেশে বাতাসের গতিবেগ যদি ঘণ্টায় ৩১ কিলোমিটারের কম হয় তা হলে সেটাকে বলে ‘লো প্ৰেসার’৷ যদি গতিবেগ ৩১ থেকে ৪৯ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে তা হলে সেটা ‘ডিপ্ৰেশন’৷ ৫০ থেকে ৬১ কিলোমিটার গতিবেগ হলে সেটা ‘ডিপ ডিপ্ৰেশন’৷ ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার হলে ঘূৰ্ণিঝড় বা ‘সাইক্লোনিক স্টৰ্ম’৷ ৮৯-১১৮ কিলোমিটার হলে সেটা বড় ধ্বনের ঘূৰ্ণিঝড়৷ আর ঘণ্টায় গতিবেগ যদি ২২২ কিলোমিটারের বেশি তবে সেটা ‘সুপার সাইক্লোন’৷ বরাক উপত্যকায় ঝড়ের গতিবেগ সাধারণত ঘণ্টায় ৮৮ থেকে ১১৮ কিলোমিটারের বেশি ওঠে না৷
গত কয়েক দশকে আমাদের দেশের ঝড়বৃষ্টির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে ওডিশার সুপার সাইক্লোনই এখন পৰ্যন্ত পূর্ব তথা উত্তর পূর্ব ভারতে গত পঁচিশ বছরের সবচেয়ে সংহারী প্ৰাকৃতিক দুৰ্যোগ৷ (অবশ্য, সুনামির কথা এখানে আনছি না।) আর গত ৩০০ বছরের পরিসংখ্যান যাচাই করলে দেখা যায়, অবিভক্ত ভারতের পূৰ্ব ও উত্তর-পূৰ্ব প্ৰান্তেই ঝড়বৃষ্টি রূদ্ৰরূপ ধারণ করেছে বার বার৷ ১৭৩৭ সালে হুগলিতে সাইক্লোনে তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন৷ ১৮৭৬ সালে বাকেরগঞ্জ (বৰ্তমানে বাংলাদেশ) ঝড়ে মারা যায় দুই লক্ষেরও বেশি মানুষ৷ দেশটা তখনও বাংলাদেশ হয়নি, পূৰ্ব পাকিস্তান ছিল, সে সময় ১৯৭০ সালে ভোলা সাইক্লোনে প্ৰাণহানি ঘটে তিন লক্ষেরও বেশি মানুষের৷ এ ছাড়াও এই অঞ্চলে এ ধ্বনের সংহারী সাইক্লোনের অন্তত কুড়িটি ঘটনা রয়েছে যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়েছে৷
বরাক উপত্যকায় ২০২২ সালের প্ৰলয়ঙ্করী বন্যার স্মৃতি এখনও দগদগে৷ ফলে গত কয়েকদিনের প্ৰবল বৰ্ষণ, প্ৰচণ্ড শিলাবৃষ্টি ও সব উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া বরাক উপত্যকার লোকেদের মনন জগতে একই সঙ্গে ‘লিলাপ্সফোবিয়া’ ও ‘প্লুভিওফোবিয়া’ জাতীয় রোগের সঞ্চার হচ্ছে। উপসর্গ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যেখানে সেখানে গাছ-গাছালির ডালপালা ভেঙ্গে পড়ছে, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে পড়েছে, রেল যোগাযোগ, সড়ক যোগাযোগ কতদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন, তা কেউই বলতে পারছেন না ইত্যাদি আরও নানা উপসর্গ। আর এর থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে অ্যান্টলোফোবিয়া বা বন্যাতঙ্ক৷ মনে হচ্ছে, ‘এক রামে রক্ষা নেই… সুগ্রীব দোসর!
জরুরি ভিত্তিতে কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ করলে উপত্যকার লোকদের হয়তো বা এই ‘অ্যান্টলোফোবিয়া’ জাতীয় রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হত৷
মরশুমের শুরুতেই বরুনদেব যে রূপ দেখাতে শুরু করেছেন… তাতে চব্বিশেও যে বাইশের পুনরাবৃত্তি হবে না… এমন কথা হলফ করে কি কেউ বলতে পারে?
(অধ্যাপক পার্থঙ্কর চৌধুরী, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তু ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন।)
[ইমেলে যোগাযোগ- parthankar@rediffmail.com / হোয়াটসএপে যোগাযোগ- 9435078296]
কোন মন্তব্য নেই