জোড়হাট লোকসভা কেন্দ্র, সারা দেশ তাকিয়ে আছে
প্রতিবেদন -২
প্রাগ নির্বাচনী পর্যালোচনা - যোরহাট লোকসভা সমষ্টি
বিজয় চক্রবর্তী। হজাই
আসামের এক ঐতিহ্য মন্ডিত সমষ্টির নাম যোরহাট লোক সভা সমষ্টি।১২২৬ ইংরেজি সনে আহোম সম্প্রদায় পাটকই গিরিপথ দিয়ে শন দেশ ( ব্রহ্মদেশ) থেকে আসামে এসে নানা জায়গা ঘুরে এই সমষ্টির ঐতিহাসিক স্থান শিবসাগরের নাতিদূরে চড়াইদেও নামক স্থানে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে এবং কালক্রমে চড়াইদেও আহোম রাজ্যের রাজধানীতে উন্নীত হয়। চৌলঙ চুকাফার নেতৃত্বে আহোম আসামে আসে। শিবসাগরের আহোম স্থাপত্য বিশ্ব ঐতিহ্য। নব গঠিত যোরহাট লোকসভা সমষ্টিতে বিশ্বের বৃত্তম নদীদ্বীপ মাজুলী। মাজুলি একটি বিধান সভা সমষ্টি। এই সমষ্টিকে যোরহাট লোক সভা সমষ্টিতে যুক্ত করা হয়েছে। ভারতের একমাত্র নদীদ্বীপ মাযুলিকে বিজেপির আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় সর্বানন্দ সনওয়াল জিলায় উন্নীত করেন। পূর্বে মাজুলি লক্ষীম পুর লোক সভা সমষ্টির অন্তর্গত ছিল। মাজুলিকে সত্রিয় নগরীও বলা হয়। অসমীয়া জাতীর জনক মহাপুরুষ শ্রীশ্রী শঙ্করদেবের সঙ্গে মহাপুরুষ শ্রী মাধব দেবের প্রথম সাক্ষাৎ মাজুলিতেই হয়েছিল। মাজুলির মুখাশিল্প (মুখুষ) বিশ্ব বিখ্যাত। বৈষ্ণব ধর্মের আসামের পিঠ স্থান মজুলিকে নব বৃন্দাবনও বলাহয়।
যোরহাট লোকসভা সমষ্টির ভোটার সংখ্যা ১৭ (সতের ) লাখের উপর। এই সমষ্টিতে পাঁচ লক্ষাধিক আহোম সম্প্রদায়ের ভোট আছে। চার লক্ষ চা শ্রমিক ভোটারের বিপরীতে প্রায় দের লক্ষ হিন্দু বাঙালি ভোটার আছে। প্রায় এক লাখ হিন্দি ভাষী ভোটারও আছে। প্রায় দু লক্ষ মুসলিম ভোটারের বিপরীতে কিছু কিছু খ্রীষ্টিয়ান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভোটারও আছে। বাকী অংশ হিন্দু জনজাতি ও বিভিন্ন গোত্রের অসমীয়া।
১০ টি বিধান সভা সমষ্টির সমন্বয়ে যোরহাট লোকসভা সমষ্টি গঠিত। বিধান সভা সমষ্টি গুলি - যোরহাট, তিতাবর, মরিয়ানি, টিয়ক, মাজুলি, নাজিরা, মহমারা, সোনারি, ডিমৌ ও শিবসাগর। এই সমষ্টিতে CPI(M),CPI এবং আখিল গগৈর রাইজর দলের যথেষ্ট প্রভাব আছে। অখিল গগৈ নিজে শিবসাগরের বিধায়ক। তিনি জেলে থেকেই বিধায়ক পদে নির্বাচিত হয়েছেন। নাজিরা ও শিবসাগরে এক সময় CPI দলের বিধায়ক ছিলেন। নাজিরা থেকে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর পর তাঁর স্ত্রী মাননীয়া শ্রীমতী হেমোপ্রভা শইকিয়াও এই কেন্দ্র থেকেই বিধায়ক হয়ে তরুন গগৈ মন্ত্রী সভায় মন্ত্রী হয়েছিলেন। বর্তমানে এই কেন্দ্রের বিধায়ক তথা আসাম বিধান সভায় বিরোধী দলের নেতা হিতেশ্বর - হেমপ্রভা পুত্র শ্রী দেবব্রত শইকিয়া । তিতাবর কেন্দ্র প্রায়ত মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ মহাশয়ের জন্ম স্থান এবং বিধান সভা কেন্দ্র। বর্তমানে এই কেন্দ্রের বিধায়ক কংগ্রেসের শ্রী ভাস্কর বরুয়া। বাকি কেন্দ্র গুলোতে বর্তমানে বিজেপির বিধায়ক। মরিয়ানী কেন্দ্রের বর্তমান বিধায়ক চা শ্রমিক নেতা, প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক, বর্তমান তিনি বিজেপির বিধায়ক শ্রী রূপ জ্যোতি কুর্মী। মিশ্র ভোটারের এই কেন্দ্রে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট একক ভাবে সর্বাধিক। বাঙালি নেতা প্রায়ত অলোক ঘোষ এক সময় এই কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন। বিলুপ্ত বিধান সভা সমষ্টি থাওরা এই লোকসভা সমষ্টির অন্তর্গত। থাওরা থেকে একই বছরে দুবার বিধায়ক হয়েছেন আহোম যুব নেতা সুশান্ত বড়গোঁহাই, প্রথম ক্ষেপে কংগ্রেস, দ্বিতীয় ক্ষেপে বিজেপি। পূর্বের আমগুরি বিধান সভা কেন্দ্র এবং থাওরা বিলুপ্তি ঘটিয়ে ডিমৌ নামে নতুন বিধান সভা কেন্দ্র সৃষ্টি হয়েছে। পরম্পরায় এই লোকসভা সমষ্টি থেকে আহোম সম্প্রদায়ের লোকই সাংসদ হয়েছেন। শুধু একবার বিজেপির চা শ্রমিক নেতা কামাখ্যা প্রসাদ তাসা এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার এই সমষ্টির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী I,N,D,I,A সমর্থিত, কংগ্রেস মনোনীত, আসামের সফল সাংসদ, "অসম কন্ঠ" বলে পরিচিতি লাভ করা, তরুণ তনয় গৌরব গগৈ ও AASU র প্রাক্তন নেতা, মৌনি সাংসদের সুখ্যাতি প্রাপ্ত, বিজেপি মিত্র জোটের, বিজেপি সাংসদ তপন গগৈ। তিনিই যোরহাটের বর্তমান সাংসদ। দুই গগৈই আহোম সম্প্রদায়ের হওয়ায় খেলা জমে উঠেছে।
আসামের বৌদ্ধিক সমাজের আনেকেই চাইছেন রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে, আসামের কথা সংসদে সজোরে, যুক্তি দিয়ে তুলে ধরার স্বার্থে যোরহাটের সম্মানীয় ভোটারগণ গৌরব গগৈকে জয়ী করুন - এই বিষয়ে গৌরব তাঁর দক্ষতা ইতি মধ্যে প্রমাণ করেছেন। ইংলিশ, হিন্দিতে চুস্ত গৌরব গগৈর ভাড়ার সেরা যুব সংসদের শংসা পত্রেও সমৃদ্ধ। তিনি পূর্বে সদ্য বিলুপ্ত কলিয়াবর সমষ্টির সাংসদ ছিলেন,এখনো আছেন। এই সমষ্টি আসামের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ড: হিমন্ত বিস্ব শর্মার আত্ম সম্মান সূচক সমষ্টি। তিনি এই সমষ্টি দখলে রাখার স্বার্থে তাঁর অন্যতম সেনাপতি, মন্ত্রী শ্রী পীযুষ হাজরিকাকে দায়িত্ব দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। তপন গগৈর হয়ে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীও পালা করে এই সমষ্টিতে প্রচার চালাচ্ছেন, নির্বাচনি আচরন বিধিকে তুয়াক্কা না করে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। তাঁর আচরণ দেখে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন যে,এই সমষ্টিতে প্রতিষ্ঠান বিরোধী চুরা স্রোতের আভাস মুখ্যমন্ত্রীর নজরে এসেছে। দিল্লীতে সবল কন্ঠ পাঠাবার যোরহাটের বৌদ্ধিক সমাজের মানসিকতাও মুখ্যমন্ত্রীকে ভাবিয়ে তুলছে। যোরহাট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে যোরহাটের লড়াই মুখ্যমন্ত্রী বনাম গৌরব গগৈর লড়াই।
অন্য দিকে গৌরব গগৈর প্রচারে তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন বিরোধী দলের দল নেতা নাজিরার বিধায়ক দেবব্রত শইকিয়া, বিধায়ক ভাস্কর বরুয়া, এবং বিধায়ক অখিল গগৈ। সাংগঠনিক শক্তি ও টাকা পয়সায় বলিয়ান শাসক দলের প্রার্থী তপন গগৈর প্রচারের মত জৌলুস নেই আর্থিক ভাবে জর্জরিত তথাকথিত বিরোধী জোট I, N,D,I,A র প্রার্থী সাংসদ গৌরব গগৈর প্রচারে। এখন পর্যন্ত গৌরবের প্রচারে কোনও তারকা প্রচারককে দেখা যায় নি। গৌরব নিজে তারকা বলে কি অন্য তারকাদের দেখা যাচ্ছেনা? তবে এটা ঠিক এই মুহূর্তে প্রচারে বিজেপি প্রার্থী অনেকে এগিয়ে যদিও লড়াই চলছে সমানে সমানে। গৌরব গগৈর কণ্ঠে পিতৃ হারা সন্তানের আবেগের সুর। আবেগ কতখানি সফল হবে বলা মুশকিল।
জন বিন্যাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, কাজিরাঙ্গা সমষ্টির মত এখানেও হিন্দি ভাষী ভোট বিজেপির পক্ষে থাকবে। একই ভাবে, কাজিরাঙ্গায় বর্নিত কারনে চা শ্রমিকদের ভোট এবং বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটের সিংহ ভাগ বিজেপির পক্ষে যাবে যদিও বিজেপি সরকারের বিভিন্ন নীতির জন্য হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায় সরকারি সুযোগ সুবধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বসুন্ধরা মিশন ১,২,৩ কোনোটিই হিন্দু বাঙালির ভূমির অধিকার ও মালিকানা সত্ব প্রাপ্তির পক্ষে নয়। এমন কি বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অনুজ্ঞা পত্র ( licence) প্রাপ্তি এবং নবী কারনে সরকারের নীতি বাঙালি হিন্দুকে বঞ্চনার কারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো এই মনোভাবের বসবর্তি হয়ে, অন্তত হিন্দুত্বের আধারে নিরাপত্তার প্রশ্নে কংগ্রেস আমল থেকে বিজেপি সরকার ভালো বলে মনে করে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়। লোকসভা সমষ্টির মুসলমান ভোট দুই ভাগে বিভক্ত- গড়িয়া - মরিয়া ও বঙ্গীয়। বিজেপি সরকারই প্রথম গড়িয়া মরিয়া উন্নয়ন পরিষদ গঠন করায় এই সম্প্রদায়ের সুলোয়ানা ভোট বিজেপির পক্ষে যাবার সম্ভবনা প্রবল। কাজিরাঙ্গার প্রতিবেদনে বর্নিত কারনে বঙ্গীয় মুসলিম ভোটারের একটি অংশ বিজেপিকে হয়ত বিবেক ভোট দেবে। এতে কংগ্রেসের মুসলিম ভোটে টান পড়বে।
নির্বাচনি পরিবেশ ও মুখ্যমন্ত্রীর আগ্রাসী প্রচার বলছে আহোম ভোট ও অন্যান্য অসমীয়া ভোট প্রাপ্তির জন্য কংগ্রেসের উগ্র CAA বিরোধীতা সত্বেও ২০১৯ পরবর্তী আসামের বিভিন্ন্ নির্বাচনের মত এবারও উল্লিখিত দুই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ভোটই বিজেপিতে যাবে। গৌরব গগৈর কেন্দ্রে I, N, D, I, A সরকার হলে CAA বাতিলের হুঙ্কারে আহোম/অসমীয়ার মনে তেমন দাগ কেটেছে বলে মনে হয় না। অন্য দিকে গৌরব গগৈর উগ্র বাঙালি হিন্দু বিদ্বেষী লাচিত সেনার প্রধান, হিংস্র শৃঙ্খল চলিহার দ্বারস্থ হওয়াকে হিন্দি ভাষীও ভালো চোঁখে দেখছে না, দেখছে না বঙ্গীয় মুসলিম ভোটাররাও। সাংসদ অজিত কুমার ভূঁইয়া, বিধায়ক অখিল গগৈর সঙ্গে কংগ্রেস দলের মাত্রাতিরিক্ত মেলামেশা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে আহোম/অসমীয়া জনগণকেও ভাবিয়ে তুলছে। অখিল গগৈর কথা বার্তায় সচেতন মহল অন্তর্ঘাতের গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁর নরেন্দ্র মোদি পুনরায় প্রধান মন্ত্রী হচ্ছেন জাতিয় বচনে কংগ্রেস ভোটারদের মন দূর্বল হচ্ছে। প্রভাব পড়বে ভোটে।
এই ভাবে নির্বাচনি পরিবেশ ও ভোটারদের আচরণ বিশ্লেষন করলে এবং ভোট দেবার অতীতের প্রবণতাকে পাথেও করলে দেখা যায় যে, মুসলিম ভোট ৯০% কাষ্ট হলে এক লাখ ত্রিশ হাজার হয়ত কাষ্ট হবে। গড়িয়া, মরিয়া সিংহ ভাগ বিজেপির ভাগে গেলে এবং বঙ্গীয় মুসলান সম্প্রদায়ের ১০% বিজেপির পক্ষে আসলে বিজেপি পাবে মোট কাষ্ট মুসলিম ভোটের ৪০ থেকে ৫০, হাজার, কংগ্রেস পাবে ৮০/৯০ হাজার। চা শ্রমিক, হিন্দি ভাষী ও বাঙালি হিন্দু ভোট ৭০%কষ্ট হলে প্রায় ৫ লক্ষ্ ভোট কাষ্ট হবে। কাষ্ট ভোটের ন্যুনতম ৭০ % বিজেপির পক্ষে গেলে বিজেপি পাবে প্রায় সাড়ে প্রায় তিন লাখ, কংগ্রেস ডের লাখ। আহোম/অসমীয়া ভোটের ৭০% কাষ্ট হলে প্ৰায় ৭ লাখ ভোট পড়বে। পরিস্থিতি বলছে এই ৭ লাখের ন্যূনতম ৬০% বিজেপির অনুকূলে যাবে। অর্থাত্ প্রায় চার লাখ বিশ হাজার ভোট বিজেপি পেতে পারে। তাহলে বিজেপির সম্ভাব্য প্রাপ্তি হতে পারে প্রায় ৮লাখ ভোট। কংগ্রেস পেতে পারে সাড়ে পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ ভোট। অবশ্যই পুরো হিসাবটি পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান মাত্র। ভোটের দিন এখনো খানিকটা দূরে। ভোটে জনগণই শেষ কথা বলেন।
দেখার বিষয় নির্বাচনি বাতাস কি গতি পরিবর্তন করে, না কি বর্তমানের পথেই ধাবিত হয়?
যোরহাট কেন্দ্রে কোনও ভাবে গৌরব গগৈ জয়ী হলে দিল্লীর দরবারে মুখ্যমন্ত্রী ড: হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ব্যক্তিত্বে খানিকটা হলেও আঁচড় পড়বে। কেন্দ্রীয় বিজেপি যে কয়জন রাজনীতিবিধকে সংসদে দেখতে চান না তাঁদের মধ্যে গৌরব গগৈও এক জন।
ইতি
প্রতিবেদক
বিজয় চক্রবর্তী
হোজাই। অসম
কোন মন্তব্য নেই