গাঁধীর জীবনের দুটি ভিন্ন দিকে ও ঘটনা
*গান্ধির জীবনের দুটি ভিন্ন দিক ও ঘটনা*
•••
*ড. প্রশান্ত চক্রবর্তী*
•••••
১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধির ভূমিকা সদর্থক ছিল না। বরং গভীর রহস্যপূর্ণ ছিল। এর ঠিক কিছুদিন আগে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধি সত্যাগ্রহের আহ্বান জানান। ৬ এপ্রিল সারা দেশে হরতাল করা হবে। কিন্তু এর আগেই ৩০ মার্চ হরতাল শুরু হয়ে যায়। চরম বিশৃঙ্খলা। দিল্লিতে পুলিশের গুলিতে অনেক লোক মারা যায়। ৫ এপ্রিল গান্ধি রবীন্দ্রনাথকে একটা চিঠি লেখেন, সত্যাগ্রহকে সমর্থন জানানোর জন্য। ১২ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ উত্তর দেন। কবি গান্ধিকে সত্যাগ্রহের বিষয়ে সাবধান করেছিলেন, গান্ধি শোনেননি। এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় সত্যাগ্রহের সংযম রক্ষা সম্ভব হয়নি। বহু লোক মারা যায়।আর চরম ঘটনাটি ঘটে ১৩ এপ্রিল~১৯১৯~পঞ্জাবের অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালা বাগ-এর নরসংহারের মধ্য দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে~এখানেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম গান্ধিকে "মহাত্মা" সম্বোধন করেন। "The Indian Daily News" পত্রিকার ১৬ এপ্রিল তারিখে চিঠিটি প্রকাশিত হয়। সারা দেশ যে মোহনদাস করমচান্দ গান্ধিকে "মহাত্মা" গান্ধি হিসেবে জানে~তার উৎস এই চিঠি। যদিও আজকের দিনে দুটি প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে গেছে~
১. গান্ধিকে আদৌ "মহাত্মা" বলার অবকাশ আছে কি!? দেশভাগ, নেহরু-পরিবার সহ নানা বিষয়ে তাঁর ভূমিকা কিন্তু প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। এবং এটাও একেবারে পরিষ্কার যে~নেহরু-পরিবার তাঁর নাম ভাঙিয়ে(পদবি সহ), নোটে তাঁর মুখ ছাপিয়ে সুকৌশলে নিজেদের ক্ষমতাদখলের কাজটি করে গেছে। ক্ষমতা পাওয়ার পর নেহরু গান্ধির সাথে কী আচরণ করতেন~ গবেষকরা এই নিয়েও আলোকপাত করছেন সম্প্রতি।
২. তাঁকে কি প্রকৃত অর্থে "জাতির পিতা" বলা উচিত?! তাহলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্থানটি ঠিক কী হবে ভারতে?
•••
এছাড়া, আরেকটি কারণে চিঠিটি উল্লেখযোগ্য~এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ দেশকে নারী রূপে বর্ণনা করেছেন। দেশ মানে একটি রাজনৈতিক ভূখণ্ড নয়~দেশ একটি সত্তা। মাতৃরূপী। তাই তো বলা হয় ভারতমাতা। যদিও ঋষি বঙ্কিমের "বন্দে মাতরম" স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল শ্লোগান ছিল এবং দেশমাতৃকার ধারণাটি পোক্ত হয়েছিল~ রবীন্দ্রনাথ যেন সেই দর্শনকে আরও উঁচুতে তুলে ধরলেন। কবির গানে দেশকে মাতারূপেই বন্দনা করা হয়েছে। কবি লিখেছেন~ "ওগো মা তোমার কোলে জনম আমার মরণ তোমার কোলে" বা~"ও মা অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা"। এমনকি কবির লেখা "আমার সোনার বাংলা" তথা বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংগীতে আছে~" ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে" বা "মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি"!
বঙ্কিমচন্দ্রকে "হিন্দুত্ব"বাদী রূপে নিন্দা করার ঢের উদাহরণ আছে। যদিও মনীষী রেজাউল করিম এর মোক্ষম জবাব দিয়ে দেখিয়েছেন~বঙ্কিমচন্দ্র কতটা উদার দেশপ্রেমী ছিলেন। তা, রবীন্দ্রনাথকেও কি "নাগপুরের লোক" বলা হবে নাকি?! রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গান্ধিকে ওই ঐতিহাসিক চিঠিতে স্পষ্টভাবে ভারতবর্ষকে দেশমাতৃকা রূপে তুলে ধরেছিলেন। এই দেশে হায়দরাবাদী মৌলবাদী ওয়েইসি আজকের দিনেও ভারতমাতা কি জয় বলতে রাজি নয়। বন্দে মাতরম তো নৈব নৈব চ। কেননা~ শরিয়তে তা নাকি গোনাহ। বাংলাদেশের ওয়াজগুলোতেও দেখি অশিক্ষিত বা মাদ্রাসাশিক্ষিত কাঠমোল্লারা হল্লা করছে~সোনার বাংলা বন্ধ করার জন্য। রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি আরও প্রাসঙ্গিক তাই আজকের দিনে।
••••
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির জন্মদিনে এই এলোমেলো কথাগুলো লিখতে গিয়ে আরও একটি ঘটনা মনে পড়ল।
১৯২৫-এর ২৩ মে গান্ধিজি পূর্ববঙ্গের পাবনায় হিমাইতপুরে সৎসঙ্গ আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ঈশ্বরদি স্টেশনে নেমে সরাসরি আশ্রম।
গান্ধিজির সৎসঙ্গ আশ্রমে যাবার একটি পটভূমি আছে। গান্ধিজিকে সৎসঙ্গ আশ্রমে যাবার কথা বলেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধু শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দীক্ষিত ছিলেন। তিনি ঋষি অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষের কাছে পাবনার সৎসঙ্গ আশ্রমের কথা শোনেন। বারীন আন্দামান জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পাবনা আশ্রমে কিছুদিন কাটিয়ে দেশবন্ধুর "নারায়ণ" পত্রিকায় "পাবনার মধুচক্র" (জৈষ্ঠ্য, ১৩২৭ বঙ্গাব্দ)নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। বারীন ঘোষ মারফৎ ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ দেশবন্ধুর। ১৯২৪-এর ১৪ জুন ১৪৪/৪ -এ কলকাতার মানিকতলার একটি বাড়িতে তিনি ঠাকুরের দীক্ষা গ্রহণ করেন। ঠাকুরের বয়স তখন মাত্র ৩৬। চিত্তরঞ্জন ঠাকুরের চেয়ে ১৮ বছরের বড়।
দীক্ষার পর দেশবন্ধুর জীবনে একটি আমূল পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন গান্ধিজি, এনি বেসান্ত, প্রমথ চৌধুরী সহ বহু বিশিষ্টজন। রাজনীতির বাইরে যা কথা হতো~দেশবন্ধু গান্ধিকে তখন তাঁর গুরুর কথা বলতেন। বঙ্গদেশের পদ্মানদীর পারে এক নিভৃত পল্লিতে একান্তমনে 'মানুষ তৈরির কারখানা' চালাচ্ছেন অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক যুবা ডাক্তার...! পল্লি উন্নয়ন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তপোবন আদর্শ কাকে বলে তা হাতেকলমে ইনি করে চলেছেন। দেশবন্ধু গান্ধিজিকেও এও জানান~তাঁর গুরুর আভায়ই তাঁর হৃদয় আজ রাঙা।
কৌতূহলী গান্ধি তাই এলেন সৎসঙ্গ আশ্রমে। স্টিমার ঘাটে ঘটল এক বিচিত্র ঘটনা। আশ্রমের এক কর্মী~হেমগোবিন্দ মুনশি দৌড়ে এসে গান্ধিকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে মুখে উপর্যুপরি চুমো খেতে লাগল। ক্ষীণকায় গান্ধি চিৎকার করে উঠলেন~"এ ক্যায়া রে এ ক্যায়া রে" বলে। ভালোবাসার অত্যাচার আর কাকে বলে! ঠাকুরকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল~আপনার আশ্রমে এত পাগল-বায়ুগ্রস্তলোকও দেখি...!
ঠাকুর হেসে বলেছিলেন~হাসপাতালে তো রোগীরাই যায়।
যা হোক, গান্ধিজি আশ্রম দর্শন করে চলে গেলেন। খুব একটা প্রভাবিত না-হয়েই। ওই হেমগোবিন্দের পাগলামিও এর একটা কারণ বোধহয়। কেননা~গান্ধি বিরক্ত হয়েছিলেন। আশ্রমে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। তারমধ্যেও হেমগোবিন্দ। গান্ধি আঁৎকে উঠে বললেন~"Beware of that man"।
এরপর দার্জিলঙে দেশবন্ধুর সান্নিধ্যে কয়েকদিন কাটান। দেশবন্ধু সারাক্ষণ ঠাকুরের গল্প করতেন গান্ধির কাছে। গান্ধিকে তিনি একটু ফাঁকা সময়ে গুরু অনুকূলচন্দ্রের কাছে আবারও যেতে অনুরোধ করেছিলেন। দেশবন্ধুর প্রয়াণের পর ১৯২৫-এর ১৬ জুলাই গান্ধি তাঁর "Young India" পত্রিকায় দেশবন্ধু রোগশয্যায় তাঁকে যা বলেছিলেন তা প্রকাশ করেন। দেশবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন~ "I have learnt from my Guru, the value of Truth in all our dealings. I want you to you for a few days at least. Your need is not same as mine. But he has given me strenth, I didnot prosses before. I see things clearly which I saw dimly before."
দেশবন্ধুর শ্রাদ্ধ উপলক্ষে গান্ধি কলকাতায় আসেন। তখন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদকে (পরবর্তীকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন। ঠাকুর তখন কলকাতায়, অখিল মিস্ত্রি লেনের বাড়িতে। গান্ধি ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে তখন বলেছিলেন~"আপনার সংস্পর্শে এসে দেশবন্ধুর যে অদ্ভুত মানসিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা দার্জিলিঙে তাঁর সাথে আলাপ করে বেশ বুঝতে পেরেছি।"
•••
*বিভাগীয় প্রধান*
*বাংলা বিভাগ*
*কটন বিশ্ববিদ্যালয়*
*গুয়াহাটি*
•••
তথ্যসূত্র
১. রবিজীবনী~
প্রশান্তকুমার পাল, সপ্তম খণ্ড।
২. মানসতীর্থ পরিক্রমা~সুশীল বসু।
৩. দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস,~হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, প্রকাশন বিভাগ, ভারত সরকার।
•••
কথা : 7002791773
কোন মন্তব্য নেই