বেলুড় এর দুর্গা পুজো ভোগ ইত্যাদি
।।বেলুড় মঠের দূর্গা পুজো এবং উপাচার ।।
🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷
বেলুড় মঠের দূর্গা পুজোতে মোট দশটি থালায় মাকে ভোগ দেওয়া হয় তার মধ্যে আটটি থাকে আমিষের থালা, বাকি দুটি
অর্থাৎ নারায়ণ শিবের জন্য হয় নিরামিষ
ভোগ।
☘️আমিষ ভোগের প্রধান বড় থালাটি থাকে মায়ের জন্য আর বাকি গুলি থাকে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, নবপত্রিকা, মহাসিংহ ও মহিষাসুরের জন্য। বেলুড় মঠের স্বতন্ত্র লক্ষ্মী ও সরস্বতী পুজোর ভোগে কিন্তু আমিষ দেওয়া হয় না । তবে এই সময় যেহেতু তাঁরা মায়ের সহচরীরূপে উপস্থিত থাকেন তাই আমিষ ভোগ থাকবেই।
🌼সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমীর সকালে মায়ের প্রধান পুজো অর্থাৎ ষোড়োশপচারে পুজোর পর দেওয়া হয় বাল্য ভোগ। এই বাল্য ভোগে থাকে পিতলের এক বড় হাঁড়ি খিচুড়ি ও গোটা ইলিশ মাছ ভাজা মশলা দিয়ে। এই ভোগ কিন্তু কেবল মায়ের জন্যই নিবেদিত হয় অন্য কোনো দেবী দেবতার জন্য এই বাল্য ভোগ নয়।
🌼এবার আসা যাক মায়ের দ্বিপ্রাহরিক ভোগের পদের কথায়: মায়ের জন্য সাদা ভাত দেওয়া হয় গোবিন্দভোগ চালের ও মায়ের জন্য নিবেদিত পোলাও তৈরী করা হয় বাসমতি চালে। এই চালগুলি বাছাই ও ঝাড়াই মহালয়ার দিন থেকে মঠের নবীন ব্রহ্মাচারীদের দায়িত্বে থাকে যাতে মায়ের ভোগে কোনো কাঁকর না পাওয়া যায়। অন্ন ভোগের থালায় স্তূপাকারে দেওয়া হয় সাদা ভাত তার পাশে বাটিতে দেওয়া হয় খিচুড়ি ও পোলাও সঙ্গে থাকে পরমান্ন অর্থাৎ পায়েস। মায়ের পাতে থাকে পাঁচ রকমের সিদ্ধ যেমন কাঁচকলা সিদ্ধ, আলু সিদ্ধ, পটল, কুমড়ো ও উচ্ছে সিদ্ধ। ভাজার মধ্যে মায়ের ভোগে দেওয়া হয় আলু, পটল, বেগুন, উচ্ছে ও বড়ি। মায়ের জন্য মেদিনীপুর থেকে আনানো হয় গয়না বড়ি। বাজারে যত রকমের সময় অসময়ের সবজি পাওয়া যায় তার সব দিয়েই মায়ের জন্য তরকারি ও ডালনা প্রস্তুত করা হয়। বাঁধাকপি, ফুলকপি থেকে এঁচোড়, মোচা সবই থাকে মায়ের সবজি তরকারিতে। সবরকম তরকারি সুন্দর ভাবে আলাদা আলাদা বাটিতে মায়ের জন্য সাজিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে ভাজা ও সিদ্ধ সুন্দর করে থালার পাশে সাজিয়ে দেওয়া হয়। আগে মাটির বাসনেই মায়ের ভোগ নিবেদন করা হতো দুর্গাপুজোতে কিন্তু প্রবীণ সন্ন্যাসীদের কথায় এই মাটির পাত্রগুলি স্তূপাকৃতি হয়ে যেত ভোগ নিবেদনের পর তাই মায়ের জন্য বড় কাঁসার থালা বাটির ব্যবস্থা করা হয়। এই বাসন মাজার জন্যই কয়েকজন সবসময় প্রস্তুত থাকেন। মায়ের ভোগের থালায় সব কিছুর সঙ্গেই দেওয়া হয় নুন, লেবু ও আলাদা আলাদা জলের গ্লাস।
🌺যেহেতু মায়ের ভোগ আমিষ দিয়েই নিবেদিত হয়, তাই মাছের পদে থাকে বিশেষ আয়োজন। অন্তত পাঁচ রকমের মাছ প্রতিদিন দেওয়া হয় যদি তার থেকেও বেশি মাছ পাওয়া সম্ভব হয় তাহলে তাও দেওয়া হয়। পাঁচ রকমের বিশেষ মাছের মধ্যে রোজ থাকে ইলিশ, চিংড়ি, রুই, ভেটকি ও সরপুঁটি।
🌺সন্ধিপুজোতে মাকে দেওয়া হয় বড় ভোগ এর মধ্যে সব রকমের অন্ন ভোগ তরকারি ফল মিষ্টি ও মাছের নানা পদ থাকে সঙ্গে থাকে কালীঘাটের বলির মাংস। শ্রী শ্রী মায়ের নির্দেশে বেলুড় মঠে পশুবলি দেওয়া হয় না, বলির পাঁঠা দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজো, শ্যামাপুজো ও ফলহারিণী পুজোর দিন কালীঘাটে মাকে উৎসর্গ করে মঠে সেই প্রসাদী মাংস নিয়ে এসে রান্না করে ভোগ দেওয়া হয়। এক দেবীর কাছে উৎসর্গ করা প্রসাদ যখন আবার অন্য দেবীর পুজোতে ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় তখনি তা হয়ে যায় মহাপ্রসাদ। যেমন পুরীতে জগন্নাথ দেবের প্রসাদ মা বিমলাকে নিবেদন করার পর তা মহাপ্রসাদ হয়ে যায়।
🌷মায়ের জন্য রচনা_ভোগ মঠেই প্রস্তুত করা হয়, মহালয়ার দিন থেকেই এর তোড়জোড় হয়ে থাকে। প্রায় দুই হাজার নারকেল নাড়ু মায়ের জন্য তৈরী করা হয় সাথে মুড়কি ও অন্যান্য আয়োজন থাকেই । মায়ের নৈবেদ্যের জন্য সব রকমের ঋতু ফল মাকে দেওয়া হয়, সঙ্গে থাকে কাজু কিশমিশ খেজুর আমসত্ত্ব। মায়ের সামনে আখ, চালকুমড়ো ও কলা বলি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সকল দেবী দেবতা বাহন ও অঙ্গ দেবতার পুজোতে নৈবেদ্যের আলাদা আলাদা আয়োজন থাকে, প্রত্যেকের নৈবেদ্য নিবেদনের পর জায়গাটি মুছে অন্য নৈবেদ্য আনা হয়।
🌷রাতে মায়ের ভোগে দেওয়া হয় লুচি , ছোলার ডাল ও মুগের ডাল , তিন রকমের তরকারি ও পাঁচ রকমের ভাজা এবং মিষ্টি , ক্ষীর , রাবড়ি। রাতে মায়ের ভোগে আমিষ পদ থাকে না সকলের ভোগই হয় নিরামিষ। দুপুর ও রাতে ভোগ নিবেদনের সময় থালার সামনে আসন পেতে দেওয়া হয় এবং নারায়ণের ভোগের উপর তুলসী ও মা দুৰ্গা সহ সকলের ভোগে দেওয়া হয় বেলপাতা। দুপুরে ঠিক ১২ টার সময় ভোগ দিয়ে ভোগারতি হয় এবং রাতে ভোগ দেওয়া হয় আটটার পর। সকালের বাল্য ভোগ দেওয়া হয় পূর্বাহ্নের পুজোর সময়ের মধ্যেই। অষ্টমীর দিন তিথি বারোটার আগেই ছেড়ে গেলে অষ্টমীর মধ্যেই একবার ভোগ দেওয়া হয় তারপর আবার যথারীতি দুপুরের ভোগ দেওয়া হয় সঙ্গে আরতি।
🌹দশমীর দিন মায়ের সামনে বিসর্জন কৃত্য ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় দধিকর্মা ভোগ যার মধ্যে মূলত থাকেচিঁড়ে দই, কিশমিশ, কাজু, নানা ফল, কলা, নাড়ু, সন্দেশ এগুলি।
🌷মায়ের নামে প্রতিদিন মঠে খিচুড়ি ভোগ বিতরণ করা হয়। ভোগ রান্নার ঘরেই মায়ের ছবির সামনে এই ভোগ নিবেদন করে আরতি করা হয় তার পর দর্শনার্থী ভক্তদের পাতে তুলে দেওয়া হয় মায়ের মহাপ্রসাদ রূপে। চাল,ডাল ও সমস্ত রকম তরকারি দিয়েই এই খিচুড়ি প্রস্তুত হয়, আলাদা করে কোনো লাবড়া বা এই জাতীয় কিছু থাকে না সঙ্গে থাকে চাটনি ও মা অন্নপূর্ণার অপার আশীর্বাদ। মঠের খিচুড়ি ভোগ বিষয়ে বেলুড় মঠের এক সময়ের অধক্ষ্য স্বামী বিরাজানন্দের একটি চিঠিতে পাই "শুধু খিচুড়ি পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবস্থা হবে। তাতেই শাক-সবজি যা কিছু দেবে। অন্য তরকারি মিষ্টান্ন কিছু দরকার নেই। এ খিচুড়ি মায়ের সামনে হান্ডা হান্ডা করে বিরাট ভোগ দিয়ে তারপর সর্বহারা নারায়ণদের পরিবেশন করতে হবে। এইবার মা এইভাবে পূজাভোগ গ্রহণ করবেন ও আমাদের পূজা সার্থক হবে। আলাদা ব্যবস্থা কারো জন্য
নয়।"
❤️ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় যেমন "মা শতমুখে খান"। এই ভাবনাকে কাজে করে দেখানোর জন্যই রামকৃষ্ণ মঠের ভারত জুড়ে প্রতিটি শাখাই যেমন মায়ের ভোগের স্বতন্ত্র আয়োজন করেন তেমন তাঁর ছেলেমেয়েরাও যাতে পুজোর দিনে মায়ের করুণা ভরা প্রসাদ পান সে বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়িত করেন। আর মায়ের কৃপায় কেউ অভুক্ত ফেরে না মঠ মিশনের কোনো শাখা থেকেই।
🪷🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🪷
✒️ : সংগ্রহীত।
কোন মন্তব্য নেই