পশ্চিমবঙ্গ র যন্ত্রণা, বঞ্চনা র করুন ইতিহাস
নিচের লেখাটি পেলাম আমার এক বন্ধুর সৌজন্যে। মনে হল সবার জানা জরুরী। ... পড়তে অনুরোধ রইল.….🙏🙏😔
#পশ্চিমবঙ্গের_যন্ত্রণা_ও
#বঞ্চনার_করুণ_ইতিহাস ...
আজ থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৭১ সালে একটি বই বেরিয়েছিল। কী ভাবে একটি দেশের এক প্রবল বিত্তবান রাজ্য চরম দরিদ্র হয়ে পড়ল মাত্র আড়াই দশকে— এ-ই ছিল সেই বইয়ের বিষয়। দেশের নাম ভারত, রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ। বইয়ের নাম দি অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল: আ স্টাডি ইন ইউনিয়ন-স্টেট রিলেশনস। লেখক, সে সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ইংরেজি সংবাদপত্র হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এর দিল্লি বুরোর প্রধান রণজিৎ রায়। প্রথম সংস্করণে বইটির দশটি প্রবন্ধের ন’টি বেরিয়েছিল হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ। দ্বিতীয় সংস্করণে যোগ হয়েছিল আরও কুড়িটি প্রবন্ধ, যার প্রায় সব ক’টিই বেরিয়েছিল হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ। বেশ কয়েকটির অনুবাদ বেরিয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা-তেও।
অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল সাংবাদিকসুলভ বিশ্বস্ত সূত্রের সমাহার নয়, এটি নির্মিত হয়েছে প্রায় পুরোপুরি সরকারি ও লিখিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গকে বুঝতে এই বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের একাধিক প্রধানমন্ত্রীর চিঠিতে, বক্তব্যে বার বার উঠে এসেছে অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর কথা— কখনও রণজিৎ রায়ের সমালোচনা করে, কখনও কুর্নিশ জানিয়ে। বইটির উপর কিছু দিনের জন্যে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল সত্তরের দশকের গোড়ায়। অনেকেই এখনও বইটি খোঁজেন, কিন্তু পান না। পশ্চিমবঙ্গের যন্ত্রণার ইতিহাস দীর্ঘ দিন আউট অব প্রিন্ট। রণজিৎ রায় তো আর এদোয়ার্দো গালেয়ানো নন, তিনি গেঁয়ো যোগী। তাঁর বইটিও তাই হারিয়ে গিয়েছে।
তবে যন্ত্রণার উপাখ্যানের প্রাসঙ্গিকতা যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছে, কারণ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এমনটা হবে বলে বইয়ের গোড়াতেই কংগ্রেস ছেড়ে আসা নেতা শরৎচন্দ্র বসুর একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করে জানিয়েছিলেন লেখক। স্বাধীনতার দু’বছর পরে শরৎচন্দ্র বসু পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেছিলেন, “আজ পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বই সঙ্কটের মধ্যে। তার অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত।” এই উদ্ধৃতির পরের দু’শো পাতায় রণজিৎ বর্ণনা করেছেন, কী ভাবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে খাদের কিনারায় দাঁড় করাল কংগ্রেসের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা।
শুরু থেকেই শুরু করা যাক। প্রথম অর্থ কমিশনের (১৯৫১) প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃত করে রণজিৎ লিখছেন, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার রাতে “ঘড়িতে ১২টা বাজার পরেই… পাটের রফতানি শুল্কে রাজ্যের ভাগ কমিয়ে দেওয়া হল।” ফলে দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ও খাদ্যাভাবে জর্জরিত রাজ্যের অর্থনৈতিক দুর্দশা স্বাধীনতার রাতেই বেড়ে গেল। পরবর্তী বছরে ধারাবাহিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে নীতি প্রণয়ন করেছে নয়াদিল্লি। এখানে দু’-একটি নিয়েই আলোচনা সম্ভব।
এর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে জোরালো ছিল বহুলচর্চিত মাসুল সমীকরণ নীতি। ভারতের লোহা ও কয়লার বড় অংশ রয়েছে বিহার ও বাংলা-সহ পূর্ব ভারতে, মূলত আদিবাসী সমাজ-নিয়ন্ত্রিত অরণ্য অঞ্চলে। এই সম্পদের গুরুত্ব পূর্বাঞ্চলে অপরিসীম, যার সাবলীল বর্ণনা চিত্রিত হয়েছে হিন্দি ছবি গ্যাংস অব ওয়াসেপুর-এ। লোহা ও কয়লা খনি রাজ্যে থাকার কারণে, অবিভক্ত বিহার ও বাংলার খনি থেকে কারখানা পর্যন্ত পরিবহণ মাসুল উত্তর বা পশ্চিম ভারতের তুলনায় ছিল কম।
রণজিৎ লিখছেন, “১৯৫৬ সালে লোহা-কয়লার উপরে মাসুল সারা দেশে সমান করা হল। এই সময় পর্যন্ত টন ও কিলোমিটার-পিছু লোহা জামশেদপুর থেকে হাওড়া আনতে লাগত ৩০ টাকা। জামশেদপুর থেকে লোহা বম্বে নিয়ে যেতে লাগত ১২০। কেন্দ্রের নীতির কারণে কলকাতা ও বম্বে দুইয়েরই মাসুল নির্ধারিত হল ৭৫ টাকা।” এর পরিণাম কী হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দিয়ে রণজিৎ বলেছেন, অবস্থানগত কারণে কলকাতার শিল্পপতিদের টন-কিলোমিটার পিছু কাঁচা লোহার উপরে ৯০ টাকার যে ‘প্রাইস অ্যাডভান্টেজ’ ছিল, তাঁরা তা হারালেন। বস্তুত, বম্বের শিল্পপতিকে যে পরিবহণ শুল্ক (১২০ টাকা) দিতে হত, তা কমে ৭৫ টাকা হয়ে গেল। “ভর্তুকির অর্থও গেল পশ্চিমবঙ্গের পকেট থেকে।”
সে সময়ে শিল্প স্থাপনের জন্য কেন্দ্র থেকে লাইসেন্স বা অনুমতি নেওয়ার রীতি ছিল। সরকারি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে রণজিৎ দেখিয়েছেন, কী ভাবে এই অনুমতির সংখ্যা রাতারাতি কমিয়ে দেওয়া হল, যার ফলে মহারাষ্ট্র বা গুজরাতে কারখানা বাড়ল, কমল পশ্চিমবঙ্গে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও স্তরে পশ্চিমবঙ্গের আয় নিয়ন্ত্রণ (যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে প্রত্যক্ষ আঘাত, এ নিয়ে আজকাল বিস্তারিত আলোচনা হচ্ছে), পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রাজ্যের অর্থ বরাদ্দ কমানো এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উত্তর ভারতে আসা উদ্বাস্তুদের নানা সুযোগ-সুবিধা ও অর্থ দিয়ে সাহায্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে আসা শরণার্থীদের বরাদ্দ নিয়ন্ত্রণ।
শেষের দু’টি বিষয় নিয়ে বিধানচন্দ্র রায় ধারাবাহিক ভাবে চিঠি লিখেছেন জওহরলাল নেহরুকে। উইথ ড. বি সি রায় অ্যান্ড আদার চিফ মিনিস্টার্স: আ রেকর্ড আপটু ১৯৬২ বইয়ে একাধিক মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব সরোজ চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও নেহরুর মধ্যে চালাচালি হওয়া চিঠি প্রকাশ করে দেখিয়েছেন, কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের উপরে কী সাংঘাতিক অসন্তুষ্ট ছিলেন রাজ্যের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অসন্তোষের ব্যাখ্যা রয়েছে রণজিৎ রায়ের তথ্যে।
“দেশের মোট গড় শিল্প উৎপাদনে ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের অবদান ছিল ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষ বছরে, ১৯৬০-৬১ সালে, এই অবদান পৌঁছল ১৭.২০ শতাংশে। মহারাষ্ট্রের অবদান বেড়ে ২০.৩০ শতাংশে চলে গেল।” অর্থাৎ, বামফ্রন্ট এবং পরে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই অনাথ হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি। এ নিয়ে এই সময়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন জরুরি।
তবে তা কেন হওয়া সম্ভব নয়, তার ব্যাখ্যা দিলেন কেন্দ্রে বিজেপির এক তাত্ত্বিক নেতা, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বিজেপি বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলে না কেন— সে সময়ে তো তারা ক্ষমতায় ছিল না। আমার নির্বোধ যুক্তি, শিল্পের উন্নতি করতে অবনতির মূল্যায়ন জরুরি, বিশেষ করে সব তথ্যই যখন অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল-এ রয়েছে। ভদ্রলোক চমৎকার জবাব দিলেন। “সে সময়ে যে সমস্ত শিল্পপতির পরামর্শে কংগ্রেস পূর্ব ভারতের কারখানা ও সংস্থার সদর দফতর উত্তর ও পশ্চিমে পাঠিয়ে দেয়, তাঁদের পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্র এখন আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।” অতএব, খেলা শেষ।
নানা তথ্য-তত্ত্ব একত্র করে তাতে কিছু অনুমান (রবীন্দ্রনাথের কথায়, “কিছু তার দেখি আভা/ কিছু পাই অনুমানে”) মিশিয়ে যা পাওয়া যায়, তা থেকে স্পষ্ট, স্বাধীনতার পরে পূর্ব ভারতকে ‘লেবার হাব’ বা শ্রমিক জোগানোর গড় হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন ভারতের নীতি-নির্ধারকরা, রাজনীতিবিদরা, শিল্পপতিরা। তাঁরা চেয়েছিলেন, পশ্চিম ও উত্তর ভারত সম্পদশালী আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠুক, পূর্ব নয়। গবেষকরা এর কিছু ব্যাখ্যাও সাম্প্রতিক কালে দিয়েছেন, তবে তা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
রণজিৎ স্বাধীনতার পরে সম্পদ স্থানান্তরের প্রথম পঁচিশ বছরের ইতিহাস লিখেছেন, পরের পাঁচ দশকের ‘লেবার হাব’ তৈরির গল্প এখনও লেখা হয়নি। এই পঞ্চাশ বছরে সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প। অর্থনীতিও।
যেমন এক দিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন রণজিৎ রায় স্বয়ং। বছর কুড়ি আগে দিল্লির বাড়ি থেকে পায়চারি করতে বেরিয়ে আর ফিরলেন না। হারিয়েই গেলেন শেষ পর্যন্ত, এই বাংলার অর্থনীতির মতোই। তাঁর বইয়ের মতোও বলা যায় হয়তো।
ঋণ : লেখক ও সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী।
কোন মন্তব্য নেই