Header Ads

মুখ্যমন্ত্রী ইতিহাস জানেন না ঠিক তথ্য দিচ্ছেন না

 চিত্ত পাল,,, রাজনৈতিক,   বিশ্লেষন  ::: মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা  ইতিহাস বিকৃতির তথ্য তুলে ধরতে অত্যন্ত পারদর্শী। তিনি আইনের ছাত্র। সেক্ষেত্রে, সব বিষয়েই যদি তিনি পাণ্ডিত্য জাহির করতে চান, তাহলে তা বুমেরাং হতে বাধ্য। যেমন কয়েকমাস আগে তিনি বলেছেন, "ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষার বিভাগ খুলেছিলেন"। কথাটা সর্বৈবঃ মিথ্যে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষার বিভাগ খুলেছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সেটা ১৯১৯ সালে। ডঃ শর্মা অনুরূপ এক উদ্ভট মন্তব্য করেছেন যে বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা নাকি মাত্র তিন শতাংশ। সম্প্রতি তিনি তাঁর নিজস্ব টুইটার হ্যাণ্ডেলে একটি ভিডিও আপলোড করেছেন। ইতিহাসের স্কলাররা তা শুনে হয়তো ভিরমি খাবেন। কোন  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্তব্য করার আগে একটু পড়াশোনা করে নেওয়া টা বাঞ্ছনীয়। হয়তো তিনি জেনেশুনেই এক শ্রেণী ভোটারের মগজ ধোলাই করার জন্যই এমন উল্টোপাল্টা বলছেন!
উল্লেখ্য, বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৭,৩১,৭০,৯৫১ জন। তার মধ্যে হিন্দুর জনসংখ্যা প্রায় দু কোটি। বাংলাদেশ সরকার যদিও আদমশুমারির শেষ তথ্যে হিন্দুর সংখ্যা  ৯ শতাংশ দেখিয়েছে, আসলে সেখানে আজকের তারিখে হিন্দুর  জনসংখ্যা প্রায় ১৮ শতাংশ।  বাংলাদেশের হিন্দুরা এটাই বিশ্বাস করেন। তিনি আরও বলেছেন, "হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা নাকি দেশ বিভাজন চান নি। তাঁদের ওপর এই বিভীষিকাময় বিভাজন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহম্মদ আলী জিন্নাহ, স্যার সাদুল্লা ও ভাসানির মতো নেতারাই দেশ বিভাজন করেছেন।"

দ্বিজাতিতত্ত্বের ফর্মূলা প্রথম দেখিয়েছেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। শোনামতে, তাঁর পরামর্শেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ১৯৩৬ সালে "অলগ কৌম" অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলিমের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলো। মহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩০ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত কখনও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের দাবি তোলেন নি। শুধু ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত মুসলিমের জন্য আলাদা স্যাটেলাইট ষ্টেট চেয়েছিলেন। যদিও ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের অ্যাকজিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় "টুঁ নেশন থিওরি"-র ওপর প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলো। জিন্নাহ ও পণ্ডিত নেহেরু কখনও পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের পক্ষপাতী ছিলেন না। বিপরীতে, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের পক্ষপাতী ছিলেন বলে জানা গেছে। বাংলাভাগের প্রধান রূপকার হচ্ছেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ভাইসরয় হিসেবে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন দায়িত্ব ভার গ্রহণ করার চার মাস পর ১৯৪৭ সালের তিন জুন সরকারি ভাবে বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরদিন ৪ঠা জুন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল কলকাতার সিংঘী পার্কে এক সভা অনুষ্ঠিত করে দেশভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলো। যদিও সেক্ষেত্রে বাংলাভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় নি। এমন পরিস্থিতি দেখে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার রাজ্যপাল ফ্রেডরিক ব্রুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি এক স্মারকলিপি দিয়ে  বাংলাভাগের জন্য জোরালো দাবি জানান। বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত লীগ মন্ত্রীসভায় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্ভবতঃ অর্থমন্ত্রী ছিলেন। 
বলাবাহুল্য, ১৯৪৬ সালের ১৯-২২ মার্চে অনুষ্ঠেয় বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দলের বিধায়ক ছিলেন ৮৬ জন, মুসলিম লীগের বিধায়ক ছিলেন ১৪১ জন, সিপিআই বিধায়ক ছিলেন ৩ জন, হিন্দু মহাসভার বিধায়ক একজন, নির্দলীয় (মুসলিম) বিধায়ক ছিলেন ৯ জন, নির্দলীয় (হিন্দু) বিধায়ক ছিলেন ১৩ জন ও অন্যান্য বিধায়ক ছিলেন ২৫ জন। বাংলাভাগের বিপক্ষে মুসলিম লীগের ১০৬ জন বিধায়ক ও হিন্দু ২১ জন বিধায়ক ভোট দিয়েছিলেন। ওদিকে, বাংলা ভাগের পক্ষে মুসলিম লীগের ৩৫ জন ও হিন্দু ৫৮ জন বিধায়ক ভোট দিয়েছিলেন। বাংলাভাগের বিপক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো। যদিও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি সিপিআই দলের জ্যোতি বসু সহ বঙ্গ কংগ্রেসের কিছুসংখ্যক বিধায়কের জন্যই বাংলাভাগ বাস্তবায়িত হয়েছিলো।

বলাবাহুল্য, হিন্দু ও অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ৫৮ জন বিধায়ক বাংলাভাগের পক্ষে তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন সেদিন, তাঁরা হচ্ছেন ক্রমে গোবিন্দ লাল ব্যানার্জি, প্রমথনাথ ব্যানার্জি, শিবনাথ ব্যানার্জি, সুশীল কুমার ব্যানার্জি, সুরেশ চন্দ্র ব্যানার্জি, মোহিনী মোহন বর্মন (অনুসূচিত), হেমন্ত কুমার বসু, জ্যোতি বসু(বামপন্থী), চারু চন্দ্র ভাণ্ডারি, সতীশ চন্দ্র বসু, রতনলাল বর্মন(বামপন্থী), মিহির লাল চট্টোপাধ্যায়, অন্নদা প্রসাদ চৌধুরী, কুমারী বীণা দাস, রাধানাথ দাস(অনুসূচিত), খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, কানাইলাল দাস(অনুসূচিত), কানাইলাল দে, হরেন্দ্রনাথ দলুই, সুকুমার দত্ত, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, বিপীন বিহারী গাঙ্গুলি, অরবিন্দ গায়েন(অনুসূচিত), এ কে ঘোষ, বিমল চন্দ্র ঘোষ, বি গোমস, দাম্বার সিং গুরুং, ঈশ্বর দাস জালান, দেবীপ্রসাদ খৈতান, চারু চন্দ্র মোহান্তি, উদয়চাঁন্দ মাহতাব (নির্দলীয়), নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি, নিশাপতি মাঝী (অনুসূচিত), ভূপতি মজুমদার, ঈশ্বরচন্দ্র মল, আশুতোষ মল্লিক (অনুসূচিত), আনন্দ প্রসাদ মণ্ডল, বাঁকে বিহারী মণ্ডল(অনুসূচিত), কৃষ্ণপদ মণ্ডল(অনুসূচিত), ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (হিন্দু মহাসভা), ধীরেন্দ্র নারায়ণ মুখার্জি, মুকুন্দ বিহারী মল্লিক (অনুসূচিত), বসন্তলাল মুজরকা, অর্ধেন্দু শেখর নষ্কর(অনুসূচিত), হেমচন্দ্র নষ্কর(অনুসূচিত), যাদবেন্দ্র নাথ পাঁজা, এল আর পেন্টোনি, আর ই প্লেটেল, অনাদি লাল পোদ্দার, রজনীকান্ত প্রামাণিক, কমলকৃষ্ণ রায়, শ্রীমতী ই এম রিকেটস, রাজেন্দ্র নাথ সরকার (অনুসূচিত), দেবেন্দ্রনাথ সেন, বিমল চন্দ্র সিনহা, বি সি বি উইকস, কালীপদ মুখার্জি, যজ্ঞেশ্বর রায়(অনুসূচিত) ।
এছাড়াও, ১৯৪২ সালের  ২৬ শে জুলাই বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের লীগ মন্ত্রীসভার ক্যাবিনেট মন্ত্রী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার গভর্ণর জেনারেলের কাছে এক চিঠি দিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র। বাংলা সহ সমগ্র ভারতে কংগ্রেস যাতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখার জন্য নিজেকে বৃটিশের কাছে সমর্পিত করেছিলেন। বাংলায় তখন বৃটিশ বিরোধী আবেগ সক্রিয় ছিলো, তখন ডঃ মুখোপাধ্যায়ের এই চিঠি যথেষ্ট অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো।

ওদিকে, মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা বিভাজনের বিভীষিকায় যাঁরা দেশচ্যুত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে নাগরিকত্ব প্রদানের পোষকতা করেছেন। যদিও এখন বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে, ডবল ইঞ্জিন সরকার ২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ সংসদে পাশ করেছে।  গত চার বছরে এই আইনের বিধি প্রস্তুত করতে সক্ষম হয় নি। ফলে এই আইন প্রযোজ্য হবে না। শোনা মতে, জেপিসি-র প্রশ্নোত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে যে ভারতে অনুপ্রবেশ করার সময় যাঁরা ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার বলে ঘোষণা করেছেন, তাঁরাই এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাবেন। ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা ঘোষিত মানুষের সংখ্যা ‌৩১,৩১৩ জন। এদের মধ্যে হিন্দু অনুপ্রবেশকারী ২৫,৩৪৭ জন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ এর অধীনে তাঁরা ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য। অথচ, এন আর সি থেকে বাদ পরা প্রায় ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালিকে কোন আইনের সাহায্যে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন! সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে, "That is a different issue altogether. This bill for those who have applied and who have claimed that they have been persecuted in their respected country."
প্রাক্তন বিধায়ক তথা ভাষিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান শিলাদিত্য দেবের হোজাই  বিধানসভা কেন্দ্রেই ৩৩ শতাংশ মানুষের নাম এন আর সি থেকে বাদ পড়েছে। জানা মতে, তারমধ্যে ২৮ শতাংশ হিন্দু বাঙালি। বাঙালির নাগরিকত্ব নিয়ে কোন কথা না বলে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন মুসলিম বাংলাদেশির প্রহসন নিয়ে। হিন্দু বাঙালির আইনি রক্ষা কবচ স্বরূপ "Immigrants Expulsion from Assam Act 1950" আইনটি প্রযোজ্য না করে হিন্দু বাঙালিকে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ পাঠাচ্ছে সরকার। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে দু ধরনের মামলা হয়। প্রথমত বর্ডার পুলিশের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে নোটিশ দেওয়া হয়, দ্বিতীয়ত হচ্ছে স্বরাষ্ট্র বিভাগে/নির্বাচন শাখার মাধ্যমে ডি ভোটার ঘোষণা করা। ফলশ্রুতিতে, ঘোষিত বিদেশি ও ডিটেনশন ক্যাম্প হচ্ছে শেষ গন্তব্য। রাজ্য সরকার ডি ভোটার, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অতি সাধারণ গরীব, কৃষক, শ্রমিকদের ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে পাঠাচ্ছে। বর্তমানে পাসপোর্ট আইনের অধীনেও এই দুই সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক মানুষকে সমন দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এই সমন পাওয়ার পর প্রথমেই জামিন নিতে হবে। তাই না হলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। 
নাগরিকত্ব আইনের উপযুক্ত ব্যাখ্যা সম্পর্কে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের নেতারা অজ্ঞ নন। কিন্তু তারা হিন্দু বাঙালি কে এই আইনের ফাঁক সম্পর্কে না বুঝিয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করা পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশভাগের জন্য জিন্নাহ, সাদুল্লা কিংবা ভাসানী কে এক পক্ষীয়ভাবে দোষারোপ করা সমীচীন নয়। সমভাবে দায়ী, হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলো। যাঁরা দেশ বিভাজনের বলি হয়েছেন, তাঁরাই একমাত্র অন্তর্জ্বালা আত্মোপোলব্ধি করছেন ! কী বেদনাদায়ক!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.