Header Ads

মহাজাগতিক মহাকালের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা ভারতের

মহাজাগতিক  মহাকালের  ইতিহাসে  এক নতুন  যুগের  সূচনা  করল ভারত 
•••••
প্রশান্ত চক্রবর্তী
•••••
     মহাজাগতিক মহাকালের ইতিহাসে এক নতুন দিনের সূচনা করল ভারত। আমার দেশ ভারতবর্ষ। মনে পড়ছে অতুলপ্রসাদ সেনের সেই চিরস্মরণীয় গান : "বলো বলো সবে শত বীণা বেণু রবে, ভারত আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে, নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ-পূরবে।" সত্যি, এ এক নতুন ভারত। পূর্ণাঙ্গ ভারত। যে-ভারত পূর্ণের সাধনা করেছিল। "ঔম পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম পূর্ণত পূর্ণমুদাচ্যতে পূর্ণস্য পূর্ণমাদয় পূর্ণমেববশিষ্যতে"। আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণে ভারত ক্রমশ নিজের বিস্তার ঘটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটি স্পর্শ করল। সীমা ছেড়ে অসীমের সাধনা তো ভারতের চিরদিনের তপস্যা। 
   মনে পড়ে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই ১০:৫৬ পিএম EDT (স্থানাংকিত আন্তর্জাতিক সময় বা ইউটিসি (ইউটিসি) সময় 
 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো ১১ মিশন চাঁদে মানুষের প্রথম সফল অবতরণ ঘটিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই ০২:৫৬) মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখেন।সেদিন বঙ্গের প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার বিশাল শিরোনাম করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের "বলাকা" কাব্যের পঙক্তি চয়ন করে :
"মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা"। আজ ভারতবর্ষও নিজ মর্তসীমা পেরিয়ে চাঁদের মাটি ছুঁল।
   ভারতীয় সভ্যতায় চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারা চিরদিন এক চর্চা ও কৌতূহলের বিষয় সুপ্রাচীন কাল থেকে। তাই জীবনচক্রে এদের প্রচ্ছায়াও কল্পনা করা হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র দুই ধারা ভারতীয় সভ্যতায় সমান্তরাল প্রবহমাণ। কত কল্পনা, কত সাহিত্য, কত লোক সাহিত্য, কত-না সৃষ্টিশীল ধারায় চন্দ্র-সূর্যের ছোঁয়া। যদিও আমাদের সংস্কৃতি মূলত সৌরসংস্কৃতি, তবু চান্দ্রসংস্কৃতিও নানাভাবে আমাদের জীবনচলনায় উপস্থিত। কোথাও চাঁদ আমাদের মামা। চান্দামামা। শিশুর কপালে টিপ দিয়ে যান তিনি। শিশু সাহিত্যে "চান্দমামা" নামে একটি ম্যাগাজিন নানাভাষায় গোটা ভারতে ছড়িয়েছিল। এই তো গেল দশক অব্দি। 
   আবার তিনি পৌরাণিক সোমদেবতা। সপ্তাহের প্রথম দিন। মাইকেল মধুসূদন লিখলেন :"সোমের প্রতি তারা"। লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া লিখলেন : জীবন মানেই তো সম্পর্কের কৃষ্ণপক্ষ বা শুক্লপক্ষ। আজ আলো তো কাল কালো। দুইয়ে মিলে জীবন। চান্দ্রমাসের মতোই। যেন লোকগানের  সুর
"সাদা সাদা কালা কালা, রং জমেছে সাদা কালা"।
   শিবের মাথায় এক ফালি চাঁদ। হুট করে নেমে এল কবি অশোকবিজয় রাহার কবিতায় "চমকে দেখি আরে! 
আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে!" কিশোর কবি সুকান্ত কম বয়সে কমিউনিস্ট মগজধোলাইর শিকার। তাই তিনি লিখলেন :
"কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।"
সুকান্ত যে-অন্ধ মতবাদে বিশ্বাস করে চাঁদকে ঝলসানো রুটি কল্পনা করেছেন, সেই মতবাদের অনুসারীরা তো এই চন্দ্র-অভিযান নিয়ে গোটা দেশে ঘ্যানর-ঘ্যানর করছিল। কী হবে কয়েকশ কোটি খরচা করে। দেশের লোক খেতে পায় না যেখানে। সবই "মুদির চক্কান্ত"। প্রকাশ রাজ নামক হিন্দি ও দক্ষিণী সিনেমার ভিলেইনটি বিষাক্ত বাম। চন্দ্রযান-৩ -এর বিরোধিতা করতে গিয়ে গোটা দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় আড়ংধোলাই খাচ্ছেন। "ভাত দে পার্টি" বোঝে না, এই দেশ বিজ্ঞান ও অধ্যাত্মসাধনাকে নিয়েই এগিয়েছে চিরকাল। আমাদের সভ্যতায় সাহিত্যে শিল্পে যেমন চাঁদের উপস্থিতি তেমনি চাঁদ আমাদের অসীম কৌতূহলের উৎসও। 
    স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কতভাবে যে চন্দ্রবন্দনা করে গেছেন। তাঁর অবিস্মরণীয় গানগুলো মনে পড়ছে আজ এই চন্দ্রজয়ী দিনে। 
"চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো,
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো"। আবার অন্য গানে আছে "চাঁদ হাসো হাসো, হারা হৃদয় দুটি ফিরে এসেছে"। এরপর কবি মেতেছেন চাঁদের জোছনায় : 
"আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তেরই মাতাল সমীরণে"। কিংবা :
"যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে"।
    এদিকে নজরুল চাঁদকে দেখছেন অন্যরকম। তিনি লিখছেন :
"চাঁদের কলঙ্ক ঐ, ও কি তব ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ?" সমু্দ্রকে বলছেন কবি :
"মানিনী ঝেঁপেছে মুখ নিশীথিনী-কেশে?
ঘুমায়েছে একাকিনী জোছনা-বিছানে?
 চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে
তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার?
কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার?"
    সত্যিই রহস্যময় চাঁদ। সেই রহস্য কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিকদের  অন্তর আবহমান কাল মথিত করে করেছে। এবারে করছে ইসরোর বিজ্ঞানীদের।
   এদিকে দেখুন, আমাদের কত কত লোকগানে চাঁদ ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা ও গায়ক ফজলুর রহমান বাবু আর শাওন গেয়েছেন : 
"চাঁদনি রাইতে নিরজনে আইসো বন্ধু সংগোপনে, ফুলের বিছানা দিমু তোমায় বসিতে।" 
এই গান শুনতে শুনতে মন হু-হু করে উড়ে যায় সেই দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের রাসলীলা বা ঝুলনপূর্ণিমার রাতে। এদিকে ঘরে-ঘরে উলুধ্বনি, কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতে সুন্দর ও শ্রীর আরাধনা। মনে পড়ে, ভগবান তথাগত বুদ্ধ এক অনন্য পূর্ণিমার রাতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 
   হাজার হাজার বছরের পরিক্রমা। সেই পরিক্রমায় জীবনানন্দ লিখছেন :
"মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে আমার মুখের দিকে,~
ডাইনে আর বাঁয়ে...
মেঠো চাঁদ~কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা~"।
 ওহো, লাইনটি পড়তে পড়তে মনে এল~ বাঁকা চাঁদ তো আরব থেকে এই উপমহাদেশে এসেছিল। আর কাস্তে আর বাঁকা চাঁদে কোথাও যেন মিল!।তাই কি কমিউনিস্টরা অত মৌলবাদী-ঘেঁষা?
    থাক ওসব। বরং আজ চন্দ্রজয়ের দিনে আর রাঘবের গান "চাঁদ কেন, আসে না আমার ঘরে" গুনগুন করে আক্ষেপ করব না। বরঞ্চ গাইব :"ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।"
    আমার দেশ ভারতবর্ষ জোছনা ধরতে গেছে চাঁদে। এক কৃতবিদ্য স্বপ্নের সওদাগর প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে গেছে। ভারত আজ চাঁদে পা রাখার পর তিনি বলেছেন : "আগে বাচ্চারা বলত চাঁদমামা বহুত দূর, আগামী প্রজন্ম বলবে চলো চাঁদে করি ট্যুর।" সত্যি, একদিন চাঁদে ট্যুর করতে যাব আমরা।
    জ্বলন হচ্ছে। পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি আমরা। মৌলবাদীরা ওয়াজ মেহফিলে বলে, তাদের অবতার নাকি নখ দিয়ে চাঁদকে দুফালা করেছিলেন। বুঝুন কাণ্ড। "ভাত দে পার্টি"-র কারও ঘুম হবে না আজ রাতে। কেননা এই সফলতা কার জন্যে সেটা ওরা মোক্ষম জানে। আর চাঁদের বুড়ি চরকা কাটুক না-কাটুক, এই দেশের রাজনৈতিক বুড়ি তো ঈর্ষায় জ্বলবে। তবে এবার আর বলবে না, তুই কে রে হরিদাস পাল। এবার বললে, মানুষ ছুঁড়ে দেবে ঘৃণার থু।
    এরা বন্ধ্যা। রাজনৈতিক বন্ধ্যা। এদের মাঠে ফসল নেই।এরা দেশদ্রোহ ফলায়। তাই জীবনানন্দও সেই কবেই লিখে গেছেন :
 "যে মাঠে ফসল নাই, 
তাহার শিয়রে 
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ, 
কোনো সাধ নাই তার 
ফসলের তরে।"
   চন্দ্র-অভিযান আমাদের স্বপ্নপূরণের অভিযান। নরদেবতার অভিযান। নরেন্দ্রর অভিযান। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাই আজ আমাদের মনের স্পন্দনের দ্যোতক :
"মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা
তখন দিবে না দেখা 
দেবতার অমর মহিমা?"
•••
দৈনিক যুগশঙ্খ 
২৪-৮-২০২৩

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.