এন আর সি তেরো লাখ বাঙালি হিন্দুর নাম কাটা পড়েছে, হিন্দু মুসলিম সমন্বয় গড়ে এই জটি. ল সমস্যা সমাধান করতে হবে
চিত্ত পাল। রাজনৈতিক বিশেষ। গত ৩০ জুলাই : "বর্তমান ভারত তথা অসমে যে বিভাজনকামী রাজনীতি শুরু হয়েছে, এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে সমন্বয় ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে। নাগরিকপঞ্জী নবায়নে তেরো লক্ষ হিন্দু বাঙালির নাম কর্তন করা হয়েছে, ডি ভোটার সমস্যায় ভারাক্রান্ত এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। বাঙালি হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।" নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির (সিআরপিসি) এক সভায় কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা তথা বিশিষ্ট আইনজীবী হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী এ কথা বলেন।
গুয়াহাটির পল্টন বাজারস্থিত আইএনটিইউসি অফিসের প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত সভায় আজ তিনি বলেন যে দেশভাগের বলি হিন্দু বাঙালির নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত আরোপ কিংবা ভিত্তিবর্ষের নির্ধারিত সীমারেখায় বন্দি করা উচিত নয়। বিজেপি সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কোনভাবেই হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব প্রদানের গ্যারান্টি দেয়া না। কারণ, নাগরিকত্ব আবেদনের সঙ্গে বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের প্রমাণ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে রে তিনি উদ্বাস্তু। সেক্ষেত্রে, সরকার এমন নিয়ম চালু করতে হবে যে দেশভাগের বলি হিন্দু বাঙালিরা যাতে একটি অ্যাফিডেভিট কিংবা সেল্ফ ডিক্লারেশনের মাধ্যমেই নাগরিকত্ব পেতে পারেন। রাজ্যের ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে এক "কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম" প্রস্তুত করার পরামর্শও দেন তিনি।
মেঘালয়ের প্রাক্তনমন্ত্রী মানস চৌধুরী অত্যন্ত আক্ষেপের সুরে বলেন যে উত্তর পূর্বাঞ্চলের আত্মঘাতী বাঙালিরা একমাত্র সিআরপিসি সংগঠনটির মাধ্যমেই জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে এক ছাতার তলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন। সুসংহত আন্দোলন বা প্রতিবাদের অভাবে মেঘালয় থেকে প্রায় দেড় লক্ষ বাঙালি বেরিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে বরাক উপত্যকা ও অসমে এসে তাঁরা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে তারিখে জীবন আহুতি দেওয়া শহিদেরা শুধু বরাক উপত্যকার স্বার্থে আন্দোলন করেন নি। ওই ভাষা আন্দোলন ছিলো সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালি ও বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন। বর্তমানে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে নাগা,খাসি,মিজো,অরুনাচলীরা নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা বাঙালিরা কী পেলেন? ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কিছুসংখ্যক রিটায়ার্ড চাকরিজীবি ও ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী কোথায় ? বাঙালিরা আবেগ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। আবেগ দিয়ে রাজনৈতিক কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। আমাদের জন্য আইন আছে, রয়েছে ভোট। ভোটের মাধ্যমেই সঠিক প্রত্যুত্তর দিতে আহ্বান জানান তিনি।
সভায় নয়াদিল্লির প্রখ্যাত সাংবাদিক ডঃ মানস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ১৮৭৪ সালে বৃটিশ অসমের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য অবিভক্ত গোয়ালপাড়া ও সিলেট, কাছাড় জেলাকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিলো। প্রাকৃতিক ভাবেই বাঙালিরা এ রাজ্যের ভূমিপুত্র জনগোষ্ঠী। পণ্ডিত নেহেরু পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালির নাগরিকত্ব প্রদানের নিশ্চিয়তা দিয়েছিলেন। আগে দুটো ডিটেনশান ক্যাম্প ছিলো। যদিও বিজেপি সরকার আসার পর সাতটি ডিটেনশান ক্যাম্প নির্মাণ করেছে। এমন কী, এশিয়ার মধ্যে সর্ব বৃহৎ ডিটেনশান ক্যাম্প গোয়ালপাড়া জেলায় নির্মাণ করেছে এই বিজেপি সরকার। হিন্দু মুসলিম বাঙালি একত্রিত হলে বিজেপি সরকার ভেঙে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আজকের সভায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সাংগঠনিক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চিত্তরঞ্জন পালকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভাষণ প্রসঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, রাজ্যের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে থেকে সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে হিমন্তবিশ্ব শর্মা বাঙালি হিন্দু মুসলিম বিভাজনের রাজনীতি করছেন। এটা অনস্বীকার্য যে ১৯৫১ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অসমিয়া মাতৃভাষার পরিচয় দেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ১৯৮৩ সালে নেলীর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো। প্রয়াত কালীপদ সেন ও প্রয়াত গোলাম ওসমানীর নেতৃত্বে গঠিত সিআরপিসি-র মাধ্যমে বাঙালি হিন্দু মুসলিম এক মঞ্চে এসেছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে জানামতে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিলো ৫২.৩ শতাংশ ও অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ছিলো ৩৭.৭ শতাংশ। যারদরুণ, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতারা ১৯৯২ সালে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিলো অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। উদ্দেশ্যে ছিলো বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। ওদিকে, ডঃ শর্মা আরো প্রশ্ন করেছেন যে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে বরপেটা জেলায় ৭০ শতাংশ মুসলিম ও ১৫ শতাংশ হিন্দু বাঙালি থাকা সত্ত্বেও সেখানে বাংলাভাষীর সংখ্যা ৪৫ শতাংশ কী ভাবে হলো? সম্প্রতি তিনি শিলাপাথারে অনুষ্ঠিত এক সভায় দু একজন বাঙালি কে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে হাজার হাজার মানুষকে বাচবিচারহীন ভাবে নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে, পাসপোর্ট আইনের অধীনেও নতুন করে নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। এই নোটিশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামিন নিতে হবে। তা নাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করা হবে। প্রাক্তন বিধায়ক শিলাদিত্য দেব ভাষিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে লম্ফঝম্ফ করা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই বোর্ড গঠনের পুরো কৃতিত্ব টাই সিআরপিসি সংগঠনের। হিন্দু মুসলিম বিভাজনের বিষাক্ত বাক্য প্রয়োগ করে আখেরে হিন্দু বাঙালির সর্বনাশ করছেন। কিন্তু তিনি বি ভোটার, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ সম্পর্কে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেন না।
সভায় বিজয় চক্রবর্তী, তাইজুদ্দিন আহমেদ, শুভ্রাংশু দেব, প্রাক্তন বিধায়ক আতায়ুর রহমান মাজরভূঁইয়া, প্রাক্তন বিধায়ক স্বপন কর, প্রদীপ কর প্রমুখেরা ভাষণ দেন। সভায় সচিব প্রধান সাধন পুরকায়স্থ সিআরপিসি-র প্রতিবেদন পাঠ করেন। তিনি এই সংগঠনের গৌরবোজ্জল ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেন। সভায় পৌরহিত্য করেন সভাপতি নৃপেন চন্দ্র সাহা।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্বান্ত গ্রহণ করা হয় যে সুপ্রীম কোর্টের তত্ববধানে প্রস্তুত করা এন আর সি প্রকাশের জন্য রেজিষ্ট্রার জেনারেল অব ইণ্ডিয়ার কাছে দাবি জানানো, প্রস্তুত কৃত এন আর সি থেকে বাতিল হওয়া ১৯ লক্ষ মানুষের নাম অন্তর্ভুক্ত করা, হিন্দু বাঙালির নাগরিকত্ব প্রদানের কোন ভিত্তিবর্ষ আরোপ করা চলবে না, বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রেখে সংগঠনের বিস্তার সাধন করা ইত্যাদি।
কোন মন্তব্য নেই