স্বামী বিবেকানন্দের অসম সফরের উজ্জল স্মৃতি
স্বামী বিবেকানন্দ আসাম এসেছিলেন । তবে ২০০১ সালে নয়, ১৯০১ সালে। তারিখটা ঠিকই আছে। ১৭ এপ্রিল। গত ১২ই জানুয়ারি বিবেকানন্দের জন্মদিনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাষণে স্বামী বিবেকানন্দের কামাখ্যা দর্শনে আসার সনটা ভুল বলেছেন। এর জন্য তিনি প্রচুর ট্রোলের শিকারও হচ্ছেন। দায়িত্বশীল কোন আসনে বসে ভুল বললে ট্রোল তো করা হবেই। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ট্রোলিং দেখে এটাও বোঝলাম, স্বামী বিবেকানন্দ যে কামাখ্যা দর্শনে এসেছিলেন, সে তথ্যটাই আমরা অনেকে জানি না। মেয়েবেলায় কামাখ্যা মন্দিরে থেকে পুজো দেবার সৌভাগ্য হয়েছিল দু'য়েকবার। তখনই দেখেছিলাম, বিবেকানন্দের থাকার সেই ঘরটি। বিষয়টা তেমন আলোচ্য হয় নি বলেই আজ মুখ্যমন্ত্রী সনে গড়মিল করায় অনেকে এটা ভাবছেন, বিবেকানন্দের আসাম আসার ঘটনাটিই মিথ্যা। আমাদের নিজেদের জানার পরিসরটাকে বাড়িয়ে তারপর কাউকে নিয়ে হাসাহাসি করা উচিত, এ ব্যাপারটায় কিন্তু আমরা কেউ গুরুত্ব দিই না।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ সনের এপ্ৰিল মাসে অসম-ভ্রমণে এসেছিলেন। তাঁর সাথে মাতৃদেবী ভুবনেশ্বরী দেবীও ছিলেন। মূলত মায়ের কামাখ্যা দৰ্শন ছিল অভিপ্ৰায়। কলকাতা থেকে ঢাকা। ঢাকা থেকে নদী পথে উজিয়ে ধুবুড়ি~ধুবুড়িতে এক রাত্ৰি বাস~তারপর গুয়াহাটি। পানবাজারের ডনবস্কো গিৰ্জার কাছে কলেজ হোস্টেল রোডের কোনায় পুরনো আসাম টাইপের একটি ঘর ছিল, স্বামীজি সেখানেই বসবাস করেছিলেন। বৰ্তমানে ওখানে পুলিস বিভাগের কাৰ্যালয়।
১৯০১ সনের ১৭ এপ্ৰিল থেকে ৩ দিন কামাখ্যায় ছিলেন স্বামীজি। সৌভাগ্য কুণ্ডর পেছন দিকে টিলার সৰ্বোচ্চ শিখরে লক্ষ্মীকান্ত আর শিবকান্ত শৰ্মা পাণ্ডার বাড়িতে অতিথি হয়ে ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সন্ন্যাসী। ইংরেজিতে নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলেন~শংসাপত্ৰ। (পাণ্ডা পরিবারকে দেওয়া স্বামীজির শংসাপত্ৰ বা certificateটির ছবি সঙ্গে দিলাম)
স্বামীজি আর তাঁর মাতৃদেবী যে ঘরে থেকেছিলেন সেই দুটো ছোট কক্ষ আজও রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের সেই পুণ্য স্মৃতিধন্য গৃহে ধূলি শিরে নিতে দেশ-বিদেশের পণ্ডিত-গবেষকেরা এখানে আসেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ বিদেশী। কয়েক বছর আগে, এজন বাঙালি তথাকথিত পণ্ডিত কলকাতা থেকে এসেছিল। তার মতলব ছিল~যেনতেন স্বামীজির লেখা মূল শংসাপত্ৰটি হস্তগত করে পালিয়ে যাওয়া। উদ্দেশ্য পূরণ না-হওয়ায় সেই অধম পামর লোকটি নিরীহ পাণ্ডার পরিবারটির ওপরে ভুয়ো একটা কেস ঠুকে হেনস্থা করেছিল।
পরিবারটিতে বৰ্তমানে পাঁচজন মেয়ে। পাণ্ডার পূজাকৰ্ম বংশানুক্ৰমিকভাবে পুত্ৰ পরম্পরায় চলে। তাই পরিবারটির আৰ্থিক অবস্থা সুস্থির নয়। দুজন জামাই সাহায্য করেন।
স্বামীজির পুণ্যস্মৃতিধন্য এই গৃহ শতাব্দীপ্ৰাচীন। সেটাও আবার পুণ্যভূমি কামাখ্যায়। আজকের দিনেও আছে। কিন্তু প্ৰাচীন এই গৃহ জরাজীৰ্ণ। সংরক্ষণের অভাবে যে-কোনো দিন ধসেখসে পড়তে পারে।
মাননীয় মুখ্যমন্ত্ৰীর প্ৰতি অনুরোধ রইল~স্বামী বিবেকানন্দের পবিত্ৰ স্মৃতিধন্য গৃহটি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেন যেন।
দুবছর আগে দেশে মাননীয় প্ৰধানমন্ত্ৰী কলকাতায় স্বামীজির প্ৰতিষ্ঠা করা বিখ্যাত বেলুড় মঠে রাত্ৰি যাপন করেছিলেন। পরের দিন তিনি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মগৃহের পবিত্ৰ ধূলি শিরে তুলে নিতে স্বামীজির জন্মভিটেয় গিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের প্ৰকৃত নাম ছিল নরেন্দ্র। শতাব্দীর ওপারে থাকা বিশ্বজয়ী সন্ন্যাসী নরেন্দ্রর গৃহে গেছিলেন শতাব্দীর এপারে থাকা বিশ্বজয়ী আর একজন নরেন্দ্ৰ।
বৰ্তমান অসম সরকার ভারতীয় ঐতিহ্যের প্ৰতি দায়বদ্ধ হওয়ার পরও গুয়াহাটির বিশ্বপ্ৰসিদ্ধ মাতৃতীৰ্থ কামাখ্যায় থাকা স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিধন্য গৃহ সংরক্ষিত হবে না কেন?!? কতজন অসমবাসী এই গৃহের সন্ধান জানে?! অসমবাসী বাদ দিন~কতজন গুয়াহাটিবাসী জানে?!
অসম পৰ্যটন নিগম এই ক্ষেত্ৰে অগ্রণী ভূমিকা নিলে ভালো হয়। অসমের পৰ্যটনমন্ত্ৰী মাননীয় জয়ন্তমল্ল বরুয়া ডাঙরিয়াকে স্বামীজির স্মৃতিধন্য ঘরটির বিষয়ে সবিশেষ জানিয়েছি। তিনি অতি আগ্ৰহে বিষয়টো অতি শীঘ্ৰ গ্ৰহণ করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। উক্ত গৃহ সংরক্ষণর ব্যবস্থা করে প্ৰচার করলে এটা আমাদের ঐতিহ্যক্ষেত্ৰ রূপে চিহ্নিত হবে আর পৰ্যটনে আকৰ্ষণ রূপে চিহ্নিত হবে।
•••
বঙ্গের স্বনামধন্য সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত বিবেকানন্দ-গবেষক "শংকর" (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়) একবার আমাকে বলেছিলেন~"স্বামী বিবেকানন্দ অসমকে ভারতের সবচেয়ে সুন্দর স্থান হিসাবে দ্বিতীয় বলে লিখে গেছেন। তোমাদের পৰ্যটন নিগম সেই কথাটা প্ৰচারেপ মাধ্যম করা উচিত।"
তাঁর প্ৰস্তাবমৰ্মে আমি বিবেকানন্দ রচনাবলিতে থাকা সেই তথ্য খুঁজে বের করেছি।
১৯০১ সনের ৫ জুলাই বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজিয় মিস মেরি হেলকে লিখেছিলেন~
"কাশ্মীরের পরেই আসাম ভারতের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা...দ্বীপময় বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাহাড়-পর্বতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে, এ দৃশ্য দেখবার মতো..."
~স্বামী বিবেকানন্দ
(মিস মেরি হেলকে লিখিত। বেলুড় মঠ, হাওড়া ৫ জুলাই ১৯০১)
কোন মন্তব্য নেই