ছোট্ট এক পাখিকে মেরে ফেলার শাস্তি
*ভালোবাসা*
☘️☘️☘️☘️☘️☘️
আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস। প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হোস্টেল সুপার মহারাজকে ছাত্ররা যেমন শ্রদ্ধা করে তেমনি ভয় পায়।
এক রবিবার। বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা। মহারাজের কানে খবর গেল, হোস্টেলের অন্যতম বদমাইশ ছাত্র দশম শ্রেণির সৌম্য কিছুটা খেলার ছলে, কিছুটা নিষ্ঠুরতায় ছোট্ট একটি পাখিকে মেরে ফেলেছে। কঠিন হয়ে উঠলো মহারাজের চোয়াল। সৌম্যকে ডাকলেন তিনি, জানতে চাইলেন এই অমানবিকতার কারণ। যুৎসই কোন কারণ দেখাতে পারল না সৌম্য। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে নীরবে। মহারাজ গম্ভীর হয়ে বললেন, "আজ দুপুরে, বিকেলে ও রাতে তোমার খাওয়া বন্ধ থাকবে। তুমি তোমার ঘরে যাও। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বেরোবে না।"সৌম্যর বন্ধুরা আড়ালে বলাবলি করতে লাগলো, "মহারাজ কিন্তু খুব নিষ্ঠুর।"
সারাদিন কাটলো। রাত্রিবেলায় খাওয়ার ঘণ্টা পড়ল। সৌম্য বাদে আর সবাই চলে গেল ডাইনিং হলে।
ছেলেরা খেয়েদেয়ে ফিরে আসার পর সৌম্যর কানে কানে আদিত্য কিছু একটা বলল। শুনেই সৌম্য তার বেড থেকে নেমে দাঁড়ালো। এক মুহূর্ত ভাবলো কী যেন। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল হোস্টেল সুপার মহারাজের ঘরের দিকে।
দরজা ভেজানো ছিল। খুব ধীরে কাঁপা কাঁপা গলায় সৌম্য বলল," আসবো মহারাজ?"
মহারাজ বললেন," এসো। বলো কী বলবে। আমি জানি তোমার খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু আজকের রাতটুকু তোমাকে কষ্ট করতেই হবে।"
সৌম্য বলল," খাওয়ার কথা বলতে আমি আসিনি, মহারাজ। এইমাত্র খবর পেলাম, আমার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও না খেয়ে রয়েছেন সারাটা দিন। এমনকি এক বিন্দু জলও খাননি। মহারাজ, আমি জানি, আপনার হাইপোগ্লাইসিমিয়া আছে। আপনার সুগার ফল করার ভয়ংকর সম্ভাবনা। আপনাকে নিয়ম করে মিষ্টি খেতে হয়। আমার বাবারও এই রোগটি ছিল এবং এতেই তিনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি।" একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ মহারাজের পাদুটো চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো সৌম্য। বলতে লাগলো," মহারাজ, আমি জানি, আমি খুব খারাপ ছেলে। আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, ভয় পাই। কিন্তু আপনাকে রেখেছি আমার বাবার জায়গায়। যদি আপনার কিছু হয়ে যায়, সারা জীবনেও আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। দয়া করুন মহারাজ। আমাকে খেতে দিতে হবে না। আপনি কিছু খান। দয়া করে কিছু খান মহারাজ। নইলে আমি পা ছাড়বো না।" করুণভাবে কাঁদতে লাগল সৌম্য।
অন্যান্য ছাত্ররা দূর থেকে ভয়ে ভয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল। হঠাৎ তারা একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলো। সৌম্যকে জড়িয়ে ধরে আকুলভাবে কাঁদছেন মহারাজ, তাদের বাঘের চেয়েও ভয়ংকর মহারাজ। কী বিরল স্বর্গীয় দৃশ্য! সৌম্য এবং মহারাজ দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছেন।
আড়াল থেকে এই দৃশ্য দেখে ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছলেন হোস্টেলের ম্যানেজার ধীরেন বাবু। কিচেনে গিয়ে কুককে বললেন," শিগগির দুটো থালায় ভালো করে খাবার-দাবার সাজিয়ে মহারাজের ঘরে দিয়ে এসো। চারটে করে রাজভোগ দিতে ভুলো না কিন্তু।"
~ সুদীপ্তকুমার চক্রবর্তী, সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
কোন মন্তব্য নেই