রাজার রাজা রামমোহন রায় জন্মদিনে তাকে স্মরণ করুন
তাঁর না ছিল রাজ্য, না ছিল প্রজা, না ছিল সৈন্য, না ছিল অস্ত্র, তবু সে রাজা, তবু সে জয়ী মহা যুদ্ধে।
সত্যিই তাঁর জীবন ছিল এক মহা যুদ্ধের। সেই ৫ বছর বয়সে মাতামহের অভিশাপ নিয়ে জীবন শুরু হয় তাঁর। সেই বয়সে অতশত বুঝতো না সে, তবু ঠাকুর ঘরে গিয়ে সব লন্ডভন্ড করে দিত। রোজ রোজ এই দৌরাত্মি কাঁহাতক সহ্য হয়! খেলেন মাতামহের অভিশাপ।
বাবা রামকান্ত পাঠিয়ে দিলেন কাশীতে সংস্কৃত পন্ডিতের আখরায়। কয়েক বছরের মধ্যেই পন্ডিত হয়ে বাড়ি ফিরে শুরু হল ফের দৌরাত্মি। বাবা ফের পাঠিয়ে দিলেন পাটনায় ফার্সি শেখাতে। এত ভাল ফার্সি শিখলেন যে লোকে তাকে মৌলভি বলে ডাকত।
এই মেধাই হল তাঁর কাল। বাড়িতে নিষ্প্রাণ মাটির দেব-দেবীর পূজার বিরুদ্ধে সবসময় তর্ক জূড়ে দিত। সেই তর্ক গ্রামের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ত। ফলে পরিবারের সন্মানে ঘা লাগতো।
তখন ১৫ বছর বয়স তাঁর। অতিষ্ঠ হয়ে বাবা তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থেকে। কোথায় যাবে কোথায় থাকবে কি করবে সবকিছুই অসহায় অনিশ্চিত। তবু সে মেনে নিল।
দেশে দেশে ঘোরে আর লক্ষ্য করে ধর্মের অনাচার কুসংস্কার মানুষে মানুষে বৈষম্য আর হানাহানি। সবথেকে খারাপ লাগে নারীর প্রতি চরম অবিচার। যার সেবায় সংসার সচল সেই নারীকেই স্বামীর চিতায় জোর করে পুড়িয়ে হত্যা করা? এ কোন ধর্ম!
পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। কেউ তার খোঁজ রাখে না। একদিন ইংরেজ সিভিলিয়ান ডিগবি সাহেবের সাথে পরিচয় ঘটে। তাঁর সপ্রতিভ আচরণ ভাল লেগে যায় সাহেবের। নিয়োগ করলেন দেওয়ান পদে। নিজেই তাকে শেখালেন ইংরেজি ভাষা।
ততদিনে তার উপার্জনের উন্নতি হয়েছে। ওদিকে তাদের পরিবারের অবস্থা সঙ্গীন। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে হাজির হলেন, কিন্তু বিধর্মী নাস্তিক বলে বাবার শ্রাদ্ধকর্ম দূরের কথা, মা-ও পর্যন্ত শাপ-শাপান্ত করে তাড়িয়ে দিলেন ঐ শোকের দিনে। চিরদিনের মত ছিন্ন হল সম্পর্ক।
কবে যে মা মারা গেল, ভাইপো মারা গেল কে জানে।
অসম্ভব কান্না লাগে তাঁর মনে। একদিন কানে এল বড়দা মারা গেছেন। খবরটা চাপা থাকল না। কারন তার বড়ো বৌঠানকে স্বামীর চিতায় বেঁধে সহমরণে পাঠানো হবে। গ্রামকে গ্রাম ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। হাজার হাজার মানুষ খোল করতাল কাঁসর ঘন্টা নিয়ে ছুটতে লাগলো তাদের বাড়ির অভিমুখে।
মমতাময়ী বৌদির অসহায় মুখটা যেন তার সামনে ভাসতে লাগল। ছুটে গেল সে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। তার চিতার সামনে প্রতিজ্ঞা করল এই বর্বরতা সে বন্ধ করবেই।
কিন্তু সেই কাজ কি এতই সহজ! যুগ যুগ ধরে আঁকড়ে বসা অত্যাচারী সমাজপতিদের শাসন উপরে ফেলা মুখের কথা!
বন্যাধারার মত আসতে লাগলো কুৎসা, তাকে নিয়ে লেখা হল কদর্য গান, একসময় খুনের সংশয় পর্যন্ত দেখা দিল তার জীবনে। বাধ্য হয়ে বেতন দিয়ে রাখতে হল নিরাপত্তা কর্মী।
১৮৩০ সাল। দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহের আর্থিক সহায়তায় গেলেন ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জোর সওয়াল করতে।
অবশেষে ১৮৩২ সালে আইন করে বন্ধ করা হল সতীদাহ প্রথা।
যার অবদানের জন্য দূর হল কলুষতা, মুক্তি পেল মাতৃরূপী নারী জাতি, সেই সিংহ বিক্রম মনীষী রাজা রামমোহন রায়ের আজ জন্মদিবস।
আজ তাঁকে শুধু প্রনাম জানানোই নয়_
ঈশ্বরের নামে ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ বন্ধ হোক, এই কামনাই হোক আমাদের সকলের। (শিলং এর মানস চৌধুরী র সৌজন্যে )
কোন মন্তব্য নেই