অসমের ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালীর ভাগ্যকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে
ষষ্ঠ পর্ব
চিত্ত পাল।
অসমের ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালির ভাগ্যাকাশে ক্রমশই কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে। তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দেশভাগের পর থেকে বিনা অপরাধে অসমে নানা ঘাত প্ৰতিঘাত নিরন্তর সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। আজ হিন্দু বাঙালি যাঁরা "আকৌ এবার মোদী সরকার" বলে উদ্বাহু তুলে নেচেছিলেন, তেমন অদূরদর্শি ও অপরিপক্ক বাঙালি দেশভাগের সময়ও ছিলো। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে সিলেট জেলা কে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই তদানীন্তন অসমের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ অসমিয়া জাতির স্বার্থে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাংলাভাষী ঘন বসতি জেলা টিকে অসম থেকে বাদ দিতে অত্যাধিক সক্ৰিয় হয়েছিলেন। কিন্তু স্বজাতির বিরুদ্ধে যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মণ্ডলও কম যান নি। করিমগঞ্জের পাশেই হবিগঞ্জের অবস্থান রয়েছে। সেখানে হিন্দু বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওই বাঙালিরা গণভোটে কিছুতেই পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার সমর্থনে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মণ্ডল এ খবর পেয়ে হবিগঞ্জে গিয়ে হিন্দু বাঙালি দের বোঝানোর চেষ্টা করেন। যদিও ওই গ্রামে হিন্দু বাঙালিরা তাঁকে স্পষ্ট ভাষায় ভারতের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। হবিগঞ্জ থেকে ফেরার পথে বিরাট বড় জলাশয় যাকে পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় "হাওর" বলা হয়, নৌকো দিয়ে ফেরার পথে যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মন্ডল অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। শোনা মতে, তিনি রাগে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হুসেন সূরাবর্দীর পাকিস্তান পন্থী সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথাবাৰ্তা বলে চলে গেলেন। রাতে তারা অসামরিক পোশাকে হবিগঞ্জ গ্রামে হিন্দু বাঙালি দের বাড়িতে আক্রমণ করলেন। ওই গ্রামে হিন্দু বাঙালিরা পর দিন ভয়ে আর গণভোটে অংশগ্ৰহণ করতে যান নি। ফলস্বরূপে, সিলেট সহ হবিগঞ্জ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গেই থেকে গেলো। ওদিকে, পুরষ্কার স্বরূপ যোগেন্দ্ৰ নারায়ণ মন্ডল পাকিস্থান এর আইনমন্ত্রী হন। কিন্তু ভগবান বিরূপ! হিন্দু বাঙালির ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন ও নারী ধর্ষণ দেখার পাশাপাশি নিজে প্রাণের মায়ায় তাঁর লক্ষ লক্ষ সমর্থকদের ফেলে রেখে কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর কুকর্মের হাত থেকে অভিশাপ মুক্ত হতে পারেন নি। আমার ভয় হচ্ছে প্রাক্তন বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের জন্য। তিনি তো ১৯৫১ সালের পরিবর্তে ১৯৪৮ সাল কেই ভিত্তিবর্ষ করতে তাবেদারি করে আসছেন। নিজের নাক কেটে সতিনের যাত্রা ভঙ্গ করতে চান। তাঁর অবশ্য কলকাতার মধ্যমগ্রামে বিশাল সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়াও নয়াদিল্লিতেও দুটো সম্পত্তি রয়েছে বলে শুনেছি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কয়েকটি আগাছা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢেউয়ে উতরে গেছেন। যাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই বলে অনেকেই মনে করেন।
গত ২৯ শে আগষ্ট থেকে সুপ্রীম কোর্টে সাংবিধানিক বিচার পীঠে নিঃস্ব, অসহায় যাঁরা দুবেলা অন্নের সন্ধানে দিনান্ত কায়িক পরিশ্রম করেন, তাঁদের নাগরিকত্বের ভাগ্য ঝুলে রয়েছে। তাঁরা এ খবরও রাখেন না যে তাঁদের বিরুদ্ধে কী ঘটতে চলেছে? গত ২০১২ সালে ৫৬২/২০১২, ৮৭৬/২০১৪,৩১১/২০১৫ এবং ৬৮/২০১৬ নম্বরে সুপ্রীম কোর্টে মামলা করা হয়েছে। "অসম সন্মিলিত মহাসংঘ" বনাম ভারত সরকার ৫৬২/২০১২ মামলা টি লিষ্টে ছয় নম্বরে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, মহাসংঘের সহযোগী সারা অসম আহোম সভা, দেউরি, চুতিয়া, কৈবর্ত, মিসিং, সোনোয়াল, খামতি, রাভা, গারো ও কোচ রাজবংশীরা মিলে ৮৭৬/২০১৪ নম্বরে মামলা করা হয়েছে। তাঁদের দাবি, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬ (ক) ধারা সংযুক্ত করার বিষয় টি অবৈধ। নাগরিকত্ব আইন ২০০৩ সালে অনুচ্ছেদ ৪ (ক) যুক্ত করে নাগরিকত্ব পঞ্জীয়ন ও জাতীয় পরিচয় পত্র প্রদান সম্পর্কীয় নিয়মাবলীও অবৈধ বলে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে। কারণ, এই নিয়মে অধীনেই ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকা অবৈধ বিদেশিরা রেশন কার্ড, গ্রাম প্রধানের সার্টিফিকেটের মাধ্যমে নাগরিক পঞ্জীতে নাম সন্নিবিষ্ট করতে পারবে। এ ছাড়াও, ৬৮/২০১৬ নম্বর মামলায় বিদেশি আইন ১৯৪৬ এর অধীনে বিদেশি আদেশ ১৯৪৮ এর সংশোধন করে ৩ (ক) যুক্ত করার পাশাপাশি পাসপোর্ট আইন ১৯২০ এর অধীনে রুলস ১৯৫০ সংশোধন করে রুলস ৪ উপ বিধি (১) যুক্ত করে ২০১৫ সালের সাত সেপ্টেম্বর জারি করা অধিসূচনা অবৈধ বলে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছে। এই অধিসূচনা মাধ্যমে দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি কে কুঠারাঘাত করে শুধু হিন্দু বিদেশি কে নাগরিকত্ব প্রধানের ব্যবস্থা করেছে। সুপ্রীম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির উদয় উমেশ ললিতের নির্দেশে পাঁচ জন সদস্য বিশিষ্ট বিচারপতির দ্বারা সাংবিধানিক বিচারপীঠে গত ২৯ আগষ্ট থেকে শুনানি শুরু হয়েছে। গত ২৭ আগষ্ট থেকে মাত্র চুয়াত্তর দিনের জন্য মুখ্য বিচারপতির কার্যকাল। তার আগেই এই পঁচিশটি মামলা রায়দান সম্পন্ন করবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছেন।
উল্লেখনীয়, পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু ১৯৫০ সালে Immigrants Expulsion from Assam 1950 Act এর ২ (খ) অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের বলি হয়ে আগত হিন্দু বাঙালিরা নাগরিকত্ব প্রধানের আইন লোকসভায় প্রণয়ন করেছিলেন। এখন এই আইনটি বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে। ওদিকে, ২০১৫ সালের সাত সেপ্টেম্বর কেন্দ্ৰীয় সরকার যো জোরা নোটিফিকেশ্যন জারি করেছিলো, সেটা বাতিলের দাবি তোলা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে বিজেপি সরকার হিন্দু বাঙালি দের সন্তুষ্ট করতে একদিকে যেমন নোটিফিকেশ্যন জারি করেছে, অন্যদিকে, এই নোটিফিকেশ্যন বাতিল করার ব্যবস্থাও করেছে?
গত শনিবার শোণিতপুর জেলার বরসলা বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত তিন নম্বর চিতলমারি গ্রামে তিনশো বাড়ি ঘর ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মার সরকার বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। এক হাজার বিঘা সরকারি জমিতে তাঁরা বসবাস করছিলেন। তার মধ্যে ৫৪ টি পরিবার হিন্দু বাঙালি। চিরাং জেলার বিজনী শহরে হিন্দু বাঙালি পরিবারের এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঊনত্রিশ বছর পর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ পাঠিয়েছে এই সরকার। মুখ্যমন্ত্রী এখন হিন্দু বাঙালি ও মুসলিমদের প্রতি প্রতিশোধ প্রায় হয়ে উঠেছে বলে সর্বত্রই চর্চিত হচ্ছে।
সারদা কেলেঙ্কারিতে তাপস পাল, মাতঙ সিং, রঞ্জনা সিং ও প্রাক্তন সাংসদ কুনাল ঘোষ সহ অনেকেই জেল খেঁটেছেন। একমাত্র ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মাই সি বি আইয়ের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কয়েক বছর আগে কলকাতার তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সিবিআই - র দল তাঁর বাড়িতে আসার প্রেক্ষিতে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে বচসা বাধে। এমন কী সিবিআই কে ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয় নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সিবিআই কার্যালয়ের সামনে দিনজোরা ধর্ণা দিয়েছিলেন। তিনি সুদীপ্ত সেনের চিঠির প্রতিলিপি মিডিয়ার সামনে তুলে ধরে বলেছিলেন, ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মাও তো সুদীপ্ত সেনের কাছে থেকে তিন কোটি টাকা নিয়েছিলেন, তাঁকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? অবশ্য বিশিষ্ট আইনজীবী দের মতে যেহেতু কুনাল ঘোষ কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে সুদীপ্ত সেনের চিঠির সার্টিফায়েড কপি বের করেছেন, সেখানে অবধারিত ভাবে ডঃ শর্মার নাম থাকাটা একপ্রকার নিশ্চিত। সারদা কেলেঙ্কারির বিচার হচ্ছে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্টে । সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিঙে ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মার সঙ্গে চা- বিস্কুট খাওয়ার পরিবর্তে কলকাতা হাইকোর্টে ডঃ হিমন্তবিশ্ব শর্মা কেও তদন্তের আওতায় আনার দাবিতে রিট পিটিশান বা পিআইএল করছেন না কেন? এমন প্রশ্ন অসমের হিন্দু বাঙালির মনে আসতেই পারে। সুদীপ্ত সেনের টাকা খেয়ে সবাই জেল খাটবে। আর তুমি হরিদাস পাল বিজেপি তে যোগদান করে বেঁচে যাব?
অসমের হিন্দু বাঙালির পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তূণ থেকে তীঁর বেরিয়ে গেলে যেমন ফিরিয়ে আনা যায় না। ঠিক তেমনি অসমের হিন্দু বাঙালিরাও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অপরিপক্কতার দরুণ আজ নাগরিকত্ব হারানো পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। (সমাপ্ত) (এই প্রতিবেদনের দায়িত্ব লেখকের নিজের, সম্পাদক নেবে না)
কোন মন্তব্য নেই