Header Ads

অসম চুক্তি অসমের বাঙালি হিন্দুদের চরম ক্ষতি করেছে

৪র্থ পর্ব
চিত্ত পাল

দেশভাগের জন্য বর্তমান অসমে বসবাসকারী হিন্দু বাঙালিরা দায়ী মোটেই দায়ী নন। তদানীন্তন কয়েকজন রাষ্ট্র নেতার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার বলি হয়েছেন এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। অথচ অসম চুক্তির দোহাই দিয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও মুসলিম বাঙালিদের অমানবিক ভাবে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, "অসম চুক্তি"র ৫(৮) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর অসমে প্রবেশ করা বিদেশি দের আইন অনুসারে শণাক্ত করা হবে এবং বহিষ্কার করা হবে। ভোটার তালিকা থেকে নাম বাতিল করা হবে। এমন বিদেশি দের তাৎক্ষণিক ভাবে এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ৫(৯) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৮৩ সালের অবৈধ প্রব্রজনকারী (ন্যায়াধীকরণ দ্বারা নির্ণয়) আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সারা অসম ছাত্র সংস্থা/সারা অসম গণ সংগ্ৰাম পরিষদ এ প্রকাশ করা কিছুসংখ্যক অসুবিধার প্রতি সরকার যথোপযুক্ত বিবেচনা করবে। ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অসমিয়া মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ভাষিক পরিচয় এবং ঐতিহ্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য যথোচিত সাংবিধানিক, আইনগত ও প্রশাসনীয় রক্ষা কবচ প্রদান করা হবে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, ৫(৯) নম্বর অনুচ্ছেদ কোথাও তো আই এম ডি টি ১৯৮৩ আইনটি বাতিলের কথা বলা হয় নি। শুধু কিছু অসুবিধার প্রতি সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজ্য সরকারের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্ৰী প্রয়াত তরুণ গগৈ সম্ভবত আইএমডিটি আইন টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেন নি বলে জানা গেছে। বিপরীতে অসমের হিন্দু বাঙালিরা কখনও এসব আইন ফাইনের ধার ধারে নি। আইনটি বাতিলের পর প্রয়াত তরুণ গগৈকে এই লেখক প্রশ্ন করার পর তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে মৌলানা বদরুদ্দিন আজমল কেন সুপ্রীম কোর্টে অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট নিয়োগ করেন নি? অবশ্য সম্ভবত বদরুদ্দিন আজমল ইতিমধ্যে এআইইউডিএফ দল খোলার জন্যই হয়তো এতো উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি।
অথচ কী দূর্ভাগ্য! এন আর সি প্রস্তুত করণের পর ১৯,০৬,৬৫৭ জন মানুষ এন আর সি ছুট। তার মধ্যে প্রায় বারো লক্ষ মানুষ হিন্দু বাঙালি। আধারকার্ড থেকে বঞ্চিত রয়েছেন ২৭,৪৩,৩৯৬ জন মানুষ। ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। তথাপি তিন বছর পর আজও কেন্দ্ৰীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর নাগরিকত্ব সংশোধনী ২০১৯ আইনের রুলস প্রস্তুত করতে সক্ষম হয় নি। অনেকের ধারণা, রুলস তৈরি হওয়ার পর এই বিতর্কিত 

আইনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার দরুন, কেন্দ্রীয় সরকার ন্যস্ত স্বার্থে অযথা দেরী করে চলেছে।
বলাবাহুল্য, অসমিয়া ও বাঙালির এই সংঘাত দেড়শো বছর পুরোনো বললেও ভূল বলা হবে না। কারণ ১৮২৪ সালে শেষ আহোম রাজা পুরন্দর সিংহ "মার" এর (ব্রহ্মদেশ) আক্রমণে পরাজিত হওয়ার পর ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন ১৮২৬ সালে। তখন থেকে অসম ভারতবর্ষ এর অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথম কলকাতা আসে ১৭০৭ সালে। স্বাভাবিক ভাবেই সবার আগে বাঙালিরাই বৃটিশের সান্নিধ্যে এসেছিলেন।  অফিসিয়াল কাজে বাঙালিরা ইংরাজি ভাষার ওপর যথেষ্ঠ পারদর্শিতা দেখাতে পেরেছিলেন। কারণ অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা রামমোহন রায় বাংলার নবজাগরণ এনেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশের প্রচলিত সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করে পাশ্চাত্য দেশের সঙ্গে টেক্কা মারা যাবে না। তাই রাজা রামমোহন রায় বৃটিশ পার্লামেন্টে নিজে গিয়ে ভারতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন করেন। তাই ভারতের সর্ব প্রথম কলেজ ও ইউনিভার্সিটি কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে। অতএব, অসম বৃটিশের শাসনাধীন হওয়ার পর কলকাতা রাজধানী থেকেই অসমের শাসনকার্য পরিচালনা করা হতো। শোনা মতে, অসমের অফিস আদালতে তখন পার্সি ভাষার প্রচলন ছিলো। কিন্তু অসমে কর্মরত বাঙালি বাবুরা তাঁদের কাজের সুবিধাৰ্থে ১৮৩৬ সালে অসমে বাংলা ভাষার প্রচলন করেন। জানা মতে, ১৮৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, গভর্ণর জেনারেলের আদেশ অনুসারে ভাষা আইন মতে পার্সি ভাষার  পরিবর্তে অসমে বাংলা ভাষা চালু করা হয়েছিলো। একই সঙ্গে, অবিভক্ত বেঙ্গল প্রভিন্সেও ১৮৩১ সালে পার্সি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রচলন করা হয়েছে। অধ্যাপক প্রবীর কর এর লেখা "Muslim Politics in Assam" নামে প্রকাশিত বইটিতে  এ কথার আভাষ পাওয়া যায়। অসমে বাংলা ভাষার স্থায়িত্ব ছিলো ১৮৭২ সাল পর্যন্ত। নাথান ব্রাউনের নির্দেশে ১৮৭২ সালে পুনরায় অসমিয়া ভাষার প্রচলন হয়। ওদিকে, ১৮৭৪ সালে অসমের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সিলেট সহ অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা কে অর্থাৎ সমগ্র নিম্ন অসমকে অসমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছিলো। (ক্রমশ)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.