বাঙালি হিন্দুদের আজও নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে
চিত্ত পাল।
ঐতিহাসিক "অসম চুক্তি"র ৩৭ বছর পার হয়েছে ইতিমধ্যে । প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের মধ্যে ১৯৭২ সালে এক আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো। এই চুক্তি "ইন্দিরা-মুজিব" চুক্তি নামে খ্যাত। বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এবং সে বছর ষোল ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসংখ্য হিন্দু বাঙালি স্বদেশ ফিরে গিয়েছিলেন। যদিও মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন প্রায় লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী এক কোটি হিন্দু বাঙালি আসা এই উদ্বাস্তুদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন। রাজ্য গুলি হচ্ছে ক্রমে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ঝারখণ্ড, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সহ অসমে নগণ্য সংখ্যক হিন্দু বাঙালিকে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন।
ওদিকে, অসমে "বিদেশি খেদা" আন্দোলন শুরু হয় ১৯৭৯ সালের ৮ই জুন থেকে। সারা অসম ছাত্র সংস্থা (আসু) ও সারা অসম গণ সংগ্ৰাম পরিষদ যৌথ ভাবে আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের দাবি, ১৯৫১ সাল কে ভিত্তিবর্ষ ধরে অবৈধ ভাবে অসমে আসা ভাষিক সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদের অসম থেকে বিতাড়ন করতে হবে। পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বের মানুষ এই অভূতপূৰ্ব গণ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মহন্ত-র নেতৃত্বে চলা এই আন্দোলন কে প্রশমিত করতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী আসু ও গণ সংগ্ৰাম পরিষদের নেতৃত্ব কে কেন্দ্ৰীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে আহ্বান জানান। প্রফুল্ল কুমার ও ভৃগু কুমার ফুকনের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের নেতারা কয়েক বার আলোচনার টেবিলে বসা সত্ত্বেও কোনো ফলপ্রসু সমাধান বের হয় নি। কারণ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত গান্ধী ১৯৫১ সাল বা ১৯৬৬ সাল কে ভিত্তিবর্ষ করতে কিছুতেই রাজী হন নি। তিনি এক প্রকার গোঁ ধরে বসে ছিলেন। "ইন্দিরা-মুজিব" চুক্তির কথা মাথায় রেখেছি তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ টিকেই বিদেশি তাড়ানোর ভিত্তিবর্ষ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রফুল্ল ও ভৃগু তা মানতে নারাজ। ফলে অসমে আন্দোলনের পারদ আরও বেশি চড়তে শুরু হয়। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়া ১৯৮৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন। সে বছর ১৮ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নগাঁও জেলার নেলী তে বেসরকারি মতে প্রায় পাঁচ হাজার মুসলমান মানুষ কে হত্যা করা হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত গান্ধী এই অমানবীয় ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা দেখে আন্দোলন কারীদের ওপর কঠোর হন। ফলে মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শইকীয়া ছাত্র নেতাদের ওপর দমন নীতি চালাতে শুরু করেন। তখন এমন একটি সময় আসে যে ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর প্রয়াত রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন, তখন অসমের ছাত্র আন্দোলন আবার নতুন উদ্যম শুরু হয়।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী দেশে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের স্বার্থে পাঞ্জাব "লাঙ্গোয়াল" চুক্তি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে "মিজো চুক্তি" ও অসম আন্দোলন কারীদের সঙ্গে "অসম চুক্তি" সম্পাদন করেন। "অসম চুক্তি"র ক্ষেত্রে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কখনও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয় নি। অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির ওপর নাগরিকত্বের নামে নির্যাতন শুরু হয়েছে বলে সকলের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নানা ভাবে, নানা নামে এই জনগোষ্ঠীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। আজও তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। তাঁদের একমাত্র অপরাধ হচ্ছে তাঁরা অসমে সংখ্যাগরিষ্ঠ। গত ২০১১ সালের লোকগনণায় ভূমিপুত্র অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ মাত্র পঁচিশ শতাংশ। ১৯৮৫ সালে প্রয়াত কালীপদ সেন ও ব্যারিষ্টার গোলাম ওসমানি অসম চুক্তির বিরোধিতা করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে "সংযুক্ত সংখ্যালঘূ মোর্চা" (ইউএমএফ) রাজনৈতিক দল গঠন করে সংখ্যালঘু রাজনীতির এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। যার দরুন হিন্দু ও মুসলিম বাঙালি মিলে সতেরো জন বিধায়ক ও একজন সাংসদ নির্বাচিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। ব্যারিষ্টার গোলাম ওসমানি ১৯৮৫ সালের ৯ই ডিসেম্বর হোজাই শহরে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেছেন, "আসাম ইজ এ ল্যাণ্ড অফ মাইনোরিটিস"। অর্থাৎ এখানে কোনও জনগোষ্ঠীই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। প্রয়াত কালীপদ সেন ও গোলাম ওসমানি যে রাজনৈতিক তত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা কয়েকজন ক্ষমতালোভী নেতার বিশ্বাস ঘাতকতার দরুণই ভেস্তে গেছে। আজ বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানেরা নাগরিকত্বের অধিকার হারাতে চলেছে।
কোন মন্তব্য নেই