এক ছিন্ন মূল হিন্দু পরিবারের যন্ত্রনা র স্রোত
এক ছিন্নমূল হিন্দু পরিবারের সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
স্রোত
*****
আমার যখন নয় বছর বয়স, বাবা আবার বিয়ে করলেন I নারায়ণগঞ্জ শহরের অদূরে, মাটিগড়া গ্রামে ছিল আমাদের বাড়ি I আধা মাইল দূর দিয়ে বয়ে যেত, শীতলক্ষ্যা নদী I নদীর ওই পারে, কিছুটা দূরে ছিল মুন্সিগঞ্জ I ওখানেই ছিল, নতুন মায়ের বাড়ি I বড়দির তখন মাত্র চৌদ্দ বছর I আমার ভাই বিমু, তখন কত হবে? চার কিংবা পাঁচ I আমাদের একটাই দিদি, তবু তাকে বড়দি বলে ডাকতাম I বিজয়াদশমীর দিন সন্ধ্যায়, মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলো I মৃত্যুর কারণ জানিনা, শুধু মনে আছে, বাবা, বিমু আর বড়দিকে জড়িয়ে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন I মায়ের নিথর দেহটা উঠানের যেখানে শোয়ানো ছিল, আমি সেখানে বসে, দাঁতে একটা খড় কাটতে কাটতে, একদৃষ্টে মায়ের মুখপানে চেয়ে রইলাম I সেদিন কাঁদিনি, আমি বুঝতেই পারছিলাম না কিছু I ভাবছিলাম, মরে গেছে তো কি হয়েছে, কাল সকালেই তো মা আবার উঠে বসবে I আজ আর সেদিনের অন্য কোনো কথা, মনে পড়েনা I পৌষ সংক্রান্তির ঠিক আগের দিন, বাবা, আমাদের তিনজনকে ডেকে বললেন, "এই তোমার নতুন মা, প্রণাম করো I" সবাই মুখ তুলে তাকালাম I লালপাড় শঙ্খ ছাপের সাদা শাড়ি, পরনে I মাথায় ঘোমটা, দুধে আলতা গায়ের রং I
শৈশবের অধিকাংশ স্মৃতি বিস্মৃত হলেও, কয়েকটি ঘটনা আজীবন মানুষের মনে বাসা বেঁধে থাকে I সেদিনের ঘটনা, আজও আমি ভুলিনি I আমি ও বিমু, বাবার আদেশানুসারে নতুন মাকে গড় হয়ে প্রণাম করলাম I বড়দি, নিজের জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো I বাবা আবার বললেন, "আয় রানু মা, নতুন মাকে প্রণাম করে নে I" বড়দি, মেঝের দিকে তাকিয়ে, স্থির হয়ে রইলো I লক্ষ্য করলাম, নতুন মায়ের ফর্সা মুখ, আস্তে আস্তে লাল হচ্ছে I কিছুক্ষন, এই ভাবেই কেটে গেলো I হঠাৎ, বাবা, ক্রোধান্বিত হয়ে বড়দির দিকে হাত তুলে তেড়ে গেলেন I বললেন, "তুই তো রানু, এতো অবাধ্য ছিলিনা কোনোদিন !!" নতুন মা, দুজনের মাঝে এসে দাঁড়ালো I বললো, "ছাড়ো, এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত দিয়ো না I ওর যেদিন ইচ্ছা হবে, প্রণাম করবে I জোর করো না I" হঠাৎ করে, বাড়ির পরিবেশ বদলে গেলো, সব কেমন অচেনা লাগতে শুরু করলো I বাড়িতে সারাদিন, অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা ! আমি ও বিমু ফিসফিসিয়ে কথা বলতাম I বড়দি, কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিলো I সকালে ভাতের থালা ও বিকেলে মুড়ি ভর্তি জামবাটি, দুই ভাইয়ের সামনে ঠক করে নামিয়ে দিয়ে চলে যেত I আগের মতো আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো না, "সবটা খেয়ে নে, কিছু যেন পরে না থাকে I"
কত নবান্ন, কত নববর্ষ, কত বিজয়াদশমী গেলো I বড়দি আর নতুন মাকে প্রণাম করলো না I অষ্টাদশী বড়দির বিয়ে দেওয়ার জন্য, নতুন মা উঠেপড়ে লাগলো I ততদিনে, আমাদের নতুন ভাই বিলু, তিন বছর বয়স পার করেছে I নদীতীরে, আমাদের বিস্তীর্ণ চাষের ক্ষেত ছিল I ধান নয়, পাট চাষ হতো আর বিভিন্ন সব্জি I বাবার নির্দেশে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও, পড়াশোনা বন্ধ করে তেরো বছর বয়সে চাষের কাজে লেগেছিলাম I বিমু, তখনও স্কুলে যায় I একদিন, বিমু, গায়ে জ্বর নিয়ে স্কুল থেকে ফিরলো I রাত বাড়ার সাথে সাথে, বমি ও পায়খানা I বড়দি, গোটা রাত বিমুর মাথার কাছে বসে কাটিয়ে দিলো I সকালে, গ্রামের কবিরাজ এসে ওষুধ দিয়ে গেলো I তবু, বিকেলে বিমুর অবস্থার আরো অবনতি হলো I মলে ভীষণ দুর্গন্ধ, নতুন মায়ের নির্দেশে বিমুকে গোয়াল ঘরের পাশে একটা অপরিচ্ছন্ন গুদাম ঘরে রাখা হলো I বড়দি, বাবার কাছে অভিযোগ করলেও, বাবা নীরব থাকলেন I বড়দিরও বিমুর ঘরে যাওয়া বারণ হলো I রোজ গভীর রাতে, বড়দি চলে যেত বিমুর কাছে I সকালে, চুপিচুপি শোবার ঘরে চলে আসতো I একদিন জানাজানি হলো I শুনলাম, নতুন মা ও বাবার মধ্যে প্রচন্ড বাকবিতন্ডা চলছে, বড়দিকে নিয়ে I পরদিন সকালে বিমু চলে গেলো, সমস্ত বাকবিতন্ডাকে পিছনে রেখে I বড়দি, শোকে পাথর হয়ে গেলো, সারাদিন নিজের ঘর ছেড়ে বের হতো না I
নতুন মা স্বাভাবিক থাকলেও বাবা মুষড়ে পড়েছিলেন I তবু, কিছু দিন পর উনিও স্বাভাবিক হলেন I বড়দির কোনো পরিবর্তন হলো না, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করে না I বিকেলে ক্ষেত থেকে ফিরে, নিজেই মুড়ি চিড়ে নিয়ে বড়দির ঘরে গিয়ে বসতাম I নিচু স্বরে অনেক কথা বলতাম I বড়দি কোনো উত্তর দিতো না, শুধু শুনতো I আদৌ কি শুনতো !? বাড়ির এই দমবন্ধ পরিবেশ, আমি সহ্য করতে পারছিলাম না I একদিন, ভালো করে লক্ষ্য করলাম, বড়দির সোনার বরণ চেহারা ভেঙেচুরে বিদ্ধস্ত হয়ে গেছে I অজানা আশঙ্কায়, আমার অন্তর কেঁপে উঠলো I "বড়দি ! তুই এতো বদলে গেছিস কেন !?" জড়িয়ে ধরলাম তাকে I বেশ কিছুক্ষন পর, বড়দিও আমাকে জড়িয়ে ধরে, কান্নায় ভেঙে পড়লো I বিমু যাওয়ার পর, প্রথমবার বড়দিকে কাঁদতে দেখলাম I বহুদিন পর, বড়দি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো I সেদিন অনেকক্ষন ধরে, আমার মাথার চুল নিয়ে নাড়াচাড়া করলো, চোখে ছিল উদাস দৃষ্টি I কয়েকদিন পর সজল দা এলো বাড়িতে, প্রথমবার I নতুন মায়ের তুতো ভাই I ঢাকা শহরে পাটের ব্যবসা করে I ভালো মানুষের চেহারা, কথাবার্তা বেশ সুন্দর I আমাদের ক্ষেতের পাট, সরাসরি কিনে নিয়ে যাবে I পাটের মান, নিজের চোখে দেখে নিতে এসেছে I
কয়েকদিন পর এক রাতে, বাবা ও নতুন মায়ের কিছু কথোপকথন কানে এলো I বুঝলাম, সজলদার পাটের গল্প আসল নয় I নতুন মা ডেকে পাঠিয়েছে, বড়দিকে দেখে নেওয়ার জন্য I আরো বুঝলাম, বড়দিকে সজলদার ভালো লেগেছে I সে, আরো দুইদিন এখানে থেকে, আবার ঢাকা চলে যাবে I গভীর রাতে, পা টিপে টিপে বড়দির ঘরে গেছিলাম সেদিন I বড়দির সাথে বিলু শুতো I সারাদিন সে, বড়দির পায়ে পায়ে ঘুরতো I নতুন মাকে মেনে নিতে না পারলেও, বিলুকে অকৃপণ ভালোবাসা দিয়েছিলো I বড়দি আমার গলার আওয়াজ পেয়ে, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছিল I তার সাথে বিলুও I বিলুর পিঠ চাপড়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলো, বড়দি I ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কিছু বলবি মানিক !? আমি সজলদার সম্বন্ধে শোনা কথা, সব বললাম I বড়দি সব শুনে, মৃদু হেসে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, "তুই ঘুমাতে যা এখন, অনেক রাত হলো I" কয়েকদিন পর বাড়িতে ভীষণ শোরগোল I নতুন মা চিৎকার করছেন, সঙ্গে বাবা I গিয়ে দেখি, বড়দি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, বাবা বড়দিকে ভর্ৎসনা করছেন I সজলদার সাথে বিয়েতে, বড়দি, তীব্র আপত্তি জানিয়েছে I সজলদা, আর কোনোদিন আসেনি বাড়িতে I
কয়েক বছর আগেই, ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে I দেশের নতুন নাম পূর্ব পাকিস্তান I হঠাৎ, আবার দেশ অশান্ত হলো I সেটা ছিল ১৯৫০ সাল I আবার, বেশ কয়েকটি জেলা জুড়ে শুরু হলো ধর্মীয় উন্মাদনা I তখন আমি সবে আঠেরো পেরিয়েছি I বাবা, সমস্ত জমিজমা বিক্রি করতে শুরু করলেন I জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, "আর বোধহয় এখানে থাকা যাবে না, মানিক I স্ত্রী কন্যা নিয়ে আমার সংসার I আমরা কলকাতা চলে যাবো I" আমি জানতাম, কস্মিনকালেও কলকাতায় আমাদের কোনো আত্মীয় ছিল না I সেখানে গিয়ে কোথায় উঠবো, কোথায় থাকবো, কি করবো, কিছুই জানি না I শুধু, পূর্বপুরুষের বসত ভিটে বিক্রি করলেন না বাবা I বাকি সবকিছু, জলের দরে বিক্রি করে দিলেন I দিন পনেরোর মধ্যেই, আমরা সবাই নৌকায় চড়ে বসলাম I শীতলক্ষ্যা নদীপথে আমরা চললাম গোয়ালন্দ ঘাট, সেখান থেকে দুটো ট্রেন বদলে কলকাতা I পিছনে পড়ে রইলো মাটিগড়া, নারায়ণগঞ্জ, শীতলক্ষ্যা I আসার পথে বিলুর প্রচন্ড জ্বর এলো, তার তখন নয় বছর বয়স I সারাক্ষন, বড়দিকে দুহাতে জড়িয়ে থাকলো I তখনও জানতাম না, ভাগ্যদেবী আমাদের জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করছেন !! ট্রেন থামতে দেখলাম, শিয়ালদহ স্টেশন লোকে লোকারণ্য I যে দিকে চোখ যায়, শুধু বাক্স পেঁটরা নিয়ে উদ্বাস্তুর ভিড় I
সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে, একটা সুরক্ষিত স্থানের সন্ধানে I স্টেশনে জল নেই, খাবার নেই, পয়সা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না I শিয়ালদহ স্টেশনের শেষ প্রান্তে, অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্রে বিলুকে নিয়ে গেলেন বাবা, সঙ্গে নতুন মা I আধঘন্টা, একঘন্টা, দুই ঘন্টা, বাবা ওদের নিয়ে ফিরলেন না I আবার একটা ট্রেন এলো উদ্বাস্তুদের নিয়ে, অনেক মানুষের ঢেউ, প্রচন্ড ঠেলাঠেলি,আমরা ভাইবোন স্থানান্তরিত হয়ে গেলাম স্টেশনের অন্য জায়গায় I আমি ও বড়দি উদ্বিগ্ন I বড়দিকে বললাম, "তুমি বসো, বাক্স পোঁটলাগুলি একটু নজরে রেখো, আমি একবার গিয়ে দেখে আসছি I" বড়দি আশঙ্কিত চোখে, আমার হাত টেনে ধরলো, "একা যাসনা মানিক, আমিও যাবো I" সব জিনিস নিয়ে আমরা দুজন চললাম চিকিৎসা কেন্দ্রের দিকে I প্রচুর অসুস্থ মানুষ সেখানে, সেবাকর্মীরা সামাল দিতে পারছে না I অনেকে নিচেই শুয়ে পড়েছে I তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছি দুজনে, প্রতিটি মানুষের মুখের কাছে চোখ নিয়ে যাচ্ছি, শয়ে শয়ে ক্লান্ত উদ্বিগ্ন মুখের ভিড়ে বাবা, নতুন মা, বিলুর মুখ খুঁজে পেলাম না I বুকের ভেতর একটা অজানা ভয়, ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসছে I সারা রাত, দুজনে, পুরো শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর চষে ফেললাম, পেলাম না ওদের I পূর্ব আকাশে সূর্যোদয় হচ্ছে, ভগ্নহৃদয় আমি ও বড়দির সমস্ত প্রচেষ্টার সূর্যাস্ত I সহায়তা কেন্দ্রের দিকে পা বাড়ালাম I
তিনজনের নাম ও বয়স দিয়ে অভিযোগ লিপিবদ্ধ হলো, কিন্তু আমাদের ঠিকানা !? খুঁজে পেলে কোন ঠিকানায় আমাদের জানাবে? ঠিকানা লেখার জায়গাটা শূন্য রইলো I বললাম, আমি এসে খোঁজ নিয়ে যাবো I বাবার কাছে শুনেছিলাম, আমরা হালিশহর যাবো I সেখানে প্রীতম দাসের সাথে দেখা করতে হবে I বাবুঘাট থেকে নদীপথে ভাটপাড়া হয়ে, শারীরিক ও মানসিক বিপর্যস্ত দুই ভাই বোন, হালিশহর পৌঁছালাম I ষাটোর্ধ্ব প্রীতম দাস জমির দালাল, তার কাছেও উদ্বাস্তুর ঢেউ I সরকারি খাস জমিতে অল্প জমি পাওয়া গেলো, প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হবে প্রীতমকে I বড়দির সাথে ছিল আমাদের মায়ের সমস্ত গয়না, আমার কাছে বেশ কিছু অর্থ I তড়িঘড়ি করে, বাঁশ চাটাই ও টালি দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই দাঁড় করানো হলো I নতুন করে জীবন যুদ্ধ শুরু হলো I সঙ্গে থাকা অর্থেও একদিন টান ধরলো I শ্যামনগরের জুট মিলে একটা কাজ জোগাড় হলো I সপ্তাহে একদিন ছুটি I ছুটির আগের দিন শিয়ালদহ স্টেশন যেতাম, যদি বাবাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় I ঠিকানা লেখার খালি জায়গায় লিখে এলাম, মানিক চন্দ্র ঘোষ, রিফিউজি কলোনি,হালিশহর I একদিন রাতে বড়দি জিজ্ঞেস করেছিল, "আচ্ছা মানিক, বাবারা কি ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলো I"
বিশ বছর আগে মাটিগড়া ছেড়েছিলাম I এই দীর্ঘ সময়ে, জীবন, কতকিছু যে দেখালো আমাকে !!! হালিশহরে ঠাঁই নেওয়ার বছর খানেক পর, হঠাৎ, একদিন শিয়ালদহ স্টেশনে সজলদার সাথে দেখা I সেদিনও নিরাশ হয়ে ফিরছিলাম, এতোদিনেও ওঁদের কোনো খোঁজ পাইনি I সজলদাকে দেখে, একটু যেন আশার আলো জাগলো I সজলদা, অনেক আগেই স্থায়ী ভাবে কলকাতা চলে এসেছিলো, এখানেও ব্যবসা করে বেশ পয়সা করেছিল I নতুন মায়ের কাছে সজলদার ঠিকানা ছিল I নতুন মা, বাবা ও বিলুকে নিয়ে সজলদার আস্তানায় উঠেছিল I সজলদা জানতো, বাবারা কোথায় আছেন I হাজার অনুরোধেও, সজলদা তাঁদের সুলুক আমায় জানালো না I বললো, "তোমাদের নতুন মা অপছন্দের ছিল,এটা বুঝি I কিন্তু, আমাকে কেন ফিরালে? রানু আমায় প্রত্যাখ্যান করলো !!!" আমায় স্তম্ভিত করে চলে যাচ্ছিলো, সে I আবার ঘুরে এলো, একটা কাগজে খসখস করে বাবার ঠিকানা লিখে দিয়ে চলে গেলো I বাবার বাসাবাড়িতে গেছিলাম, আরো খারাপ খবর অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য I প্রিয় রানুকে হারিয়ে, বাবা, দুমাস পরেই বদ্ধোন্মাদ হয়ে গেছেন I তার ঠিকানা এখন সরকারি মানসিক হাসপাতাল I বিলু মাসখানেক বড়দিকে খুঁজে খুঁজে, কঠিন অসুখে শেষ হয়ে গেছে I
বড়দি যে আমাদের পরিবারের প্রাণ ভোমরা, পরিবারের দুঃসময়ে বার বার প্রমাণিত হয়েছে I বড়দিকে নিয়ে বাবাকে দেখতে এসেছি, প্রায় প্রতি সপ্তাহে I বড়দিকে চিনতে পারতেন না I বড়দি, বাবার গায়ে হাত বুলিয়ে বলতো, "এই দেখো, তোমার রানু এসেছে I" তাঁর কানে, কোনো কথা ঢুকতো না I তাকিয়ে থাকতেন গরাদের বাইরে, দৃষ্টিতে তাঁর শূন্যতা I দেড় বছরের মাথায় বাবা চলে গেলেন, আর বাসাবাড়িতে ফেরা হয়নি তাঁর I যাওয়ার আগের দিন, বারবার শুধু বড়দিকে ডেকেছেন I সমাজের বাধা উপেক্ষা করে, বড়দি, বাবার মুখাগ্নি করেছিল I সেদিন জানলাম, শীতলক্ষ্যার শ্মশানে মায়েরও মুখাগ্নি বড়দি করেছিল I বাবাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, বড়দি, সজলদাকে আর ফিরিয়ে দেয়নি I বিয়ে করেছিল, খুব সুখী হয়েছিল দুজন I আমার ভাগ্নি পরী, অবিকল ওর মায়ের মুখ বসানো I এখন ও, ষোড়শী I
গঙ্গার জলে গোড়ালি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছি অনতিদূরেই বড়দির চিতা জ্বলছে I বেয়াড়া কর্কট রোগ, মানুষটাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে গেলো I মাটিগড়া থেকে যেদিন চিরতরে চলে এসেছিলাম, আমার পা দুটো নৌকা থেকে ঝুলছিলো I শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ের জল, সেদিনও আমার গোড়ালি ভিজিয়ে দিচ্ছিল I সেইদিন ভিটেমাটি, আজ আমার রক্তের শেষ সম্পর্কটাও হারিয়ে ফেললাম I বড় আপনার মাতৃসম বড়দি !!! শেষ বিকেল, রক্তিম দিগন্তে সূর্য অস্তাচলে I সেদিকে তাকিয়ে মা, বিমু, বাবা, বড়দিকে, খুঁজছিলাম ব্যাকুল হয়ে I সজলদা, পাশে এসে কাঁধে হাত রেখে বললো, "ফেরা যাক মানিক, পরী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য I"
©শুভ
কোন মন্তব্য নেই