শিলং এর ডাউকি সেতু , বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসমের কৃতি সন্তান
পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে অসমের বাঙালি পরিবারের সংযোগ ✍ বরাকমূলের প্রকৌশলী দুই কৃতি পিতাপুত্রের অবদান নব প্রজন্মের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হল।
সিলেটি প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরীর
অমর কীর্তি
-মিলু কাশেম
সিলেটের জাফলং বেড়াতে গিয়ে
অদূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের যে পাহাড়ী শহরটি দেখা যায় সেটার নাম ডাওকি।আর ডাওকির পাশে পাহাড়ী উমগট নদীর উপর দুই পাহাড়ে ঝুলে থাকা দৃষ্টি নন্দন যে ব্রিজটি সবার দৃষ্টি কাড়ে সেটাই ডাওকি ব্রিজ।জাফলং ভ্রমনকারীদের কাছে ডাওকি ব্রিজের রয়েছে আলাদা আকর্ষন।
কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা এই ব্রিজ তৈরীর ইতিহাস।এর সাথে জড়িয়ে আছে
সিলেটের অনেক কৃতি মানুষের নাম।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই সেতুটি এখনো
সবার কাছে আকর্ষনীয়।যারা এই পথ দিয়ে শিলং বা ভারতে গেছেন তারা কাছ থেকে দেখেছেন চমৎকার এই ব্রিজটি। কিন্তু হয়ত জানেন না এই ব্রিজটির স্থপতি সিলেটের এক কৃতি সন্তান।
১৯১৯ সাল, অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতবর্ষ । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেড়াতে আসলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের শৈলশহর শিলং'এ । শ্রীহট্টে এই খবর শুনে শুরু হলো গুরুদেবকে নিয়ে আসার তোড়জোর । বাঁধা হয়ে দাড়ালো শিলং-শ্রীহট্ট সড়ক ।কারন সরাসরি কোন সড়ক যোগাযোগ ছিলো না। চেরাপুঞ্জি হয়ে মানুষের পিঠে চড়ে পাহাড় থেকে নামতে হতো। এদিকে গুরুদেব মানুষের পিঠে চড়ে আসতে রাজি নন । যাই হোক্ অবশেষে গুয়াহাটি-বদরপুর-লাতু-কুলাউড়া আন্তঃসংযোগ রেলওয়েতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কবিগুরু শ্রীহট্টে পদার্পণ করলেন ।
এই ঘটনার পর পর শিলং শ্রীহট্র সরাসরি সড়ক যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন শ্রীহট্রের সুধী সমাজে আলাপ আলোচনার সূত্রপাত হয়। এর ধারাবাহিকতায় বিষয়টি প্রথমে সবার দৃষ্টিতে নিয়ে আসেন কংগ্রেস নেতা ও আসাম প্রাদেশিক শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রী শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারের সন্তান খানবাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ ওরফে কাপ্তান মিয়া । কিছুদিন পর কাপ্তান মিয়া প্রয়াতঃ হোন । তখন থেকেই রাজ্যের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনায় আসে শিলং-ডাউকি-তামাবিল-শ্রীহট্ট সড়ক
নির্মানের বিষয়টি।
বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক । কংগ্রেস নেতা ও আসাম প্রাদেশিক সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী(প্রথমে পার্লামেন্ট স্পীকার, পরবর্তীতে মন্ত্রী) শ্রীহট্টের বরগঙ্গা গ্রামের(অধুনা বুরুঙ্গা) সন্তান বসন্ত কুমার দাসকে বিষয়টি যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলে । তিনি উদ্যোগ নেন রাস্তাটি নির্মাণের । মন্ত্রী বসন্ত কুমার দাসের অকৃত্রিম প্রচেষ্টায় অর্থবাজেটে সেটি বরাদ্দও হয়ে যায় । এগিয়ে আসে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সরকার । কিন্তু বাঁধা হয়ে দাড়ায় খাসি ও জৈন্তিয়া পাহাড়কে বিভক্তকারী খরস্রোতা 'উমগট নদী'। বসন্ত বাবু প্রমাদ গুনলেন ।
এদিকে শ্রীহট্টের করিমগঞ্জের লাতুর (অধুনা, বড়লেখার শাহবাজপুর, পরবর্তীতে দেশ ভাগের পর ঢাকার বাসিন্দা ) তরুণ ছেলে আবিদ রেজা চৌধুরী তখন 'বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ' শিবপুর পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকৌশল শিক্ষা নিয়ে সবেমাত্র শিলং এ সরকারি প্রকৌশলী হিসাবে চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন । উল্লেখ তিনি হলেন শ্রীহট্রের প্রথম মুসলিম প্রকৌশলী। তার সাথে যোগাযোগ করে উমগট
নদীতে ব্রিজ নির্মানে সহযোগীতা চাওয়া হলো।তিনি সার্বিক সহযোগীয় এগিয়ে এলেন।
সেটা ১৯৩০ সালের কথা, এই আবিদ রেজা চৌধুরীর আগ্রহ ডিজাইন ও নির্দেশনায় ১৯৩২ সালে পাহাড়ী উমগট নদীর উপর পূর্ণতা পেল ডাওকির দর্শনীয় এই ঝুলন্ত সেতুটি।
আর তার মধ্য দিয়ে চালু হলো শ্রীহট্র শিলং সরাসরি সড়ক যোগাযোগ।
জানা যায় এই সেতুটি নির্মানে ঠিকাদারি কাজে নিয়োজিত ছিলেন সিলেটের আরেক কৃতি সন্তান
সরেকওম আবু আজফর উবায়েদ উল্লাহ। তিনি ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন।তার ছেলে সরেকওম মোহাম্মদ কবির জানান তার বাবা যখন মারা যান তখন তার বয়স ৭ বছর ছিলো।তার মায়ের কাছ থেকে তারা
ডাওকি ব্রিজ নির্মানে তার বাবার সংশ্লিষ্টতা আর অনেক লোমহর্ষক কাহিনী শুনেছেন।
উল্লেখ্য বৃটিশ ভারতে শ্রীহট্র ছিলো আসাম প্রদেশের একটি জেলা শহর আর শিলং ছিলো আসামের রাজধানী। ডাওকির উমগট নদীর উপর নির্মিত দৃষ্টি নন্দন এই ব্রিজটিকে তখন বলা হতো Gateway Of Shillong. এই ব্রিজ নির্মানের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত হলো খাসি ও জৈন্তিয়া পর্বতমালা।উন্মোচিত হলো শ্রীহট্র শিলং যোগাযোগের নতুন দ্বার।
এখানে উল্লেখ্য যে, সিলেটে সুরমা নদীর উপর নির্মিত 'কীন্ ব্রিজ' তৈরী হয়েছিল ১৯৩৬ সালে । ব্রিজটির নাম করন করা হয় তৎকালীন আসামের গভর্নর মাইকেল
কিন এর নামানুসারে। ব্রিজটির উদ্বোধন ও করেছিলেন গভর্নর কিন।
এই ডাওকি ব্রিজের স্থপতি ও ডিজাইনার
আবিদ রেজা চৌধুরী হলেন সদ্যপ্রয়াত
সিলেটের কৃতি সন্তান প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর পিতা। উল্লেখ জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি লেখা ও সাক্ষাতকার থেকে ডাওকি ব্রিজ নির্মানে তার বাবার অবদানের কথা জানা যায়।
ডাওকি সেই বিখ্যাত ব্রিজ নির্মানে প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরীর রয়েছে বিরাট অবদান।তার ডিজাইন এবং পরামর্শে খরস্রোতা পাহাড়ী উমগট নদীর উপরে নির্মিত হয় দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত ব্রিজ।
যার মাধ্যমে সংযুক্ত হয় খাসি এবং জৈন্তা পাহাড়।প্রয়াত প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী
ডাওকি ব্রিজের স্থপতি আবিদ রাজা চৌধুরীর ই সুযোগ্য সন্তান।জামিলুর রেজার পরামর্শ আর সার্বিক তত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের অহংকার স্বপ্নের পদ্মা সেতু।যার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে বাংলাদেশ।পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করেছেন আমাদের গর্ব জামিলুর রেজা চৌধুরীর নাম আর অবদানের কথা।
ডাওকি ব্রিজ পদ্মা সেতুকে ঘিরে আবিদ রেজা আর জামিলুর রেজা পিতাপুত্রের এই পরম্পরা ইতিহাস হয়ে আছে।আমরা সিলেটিরা গর্বিত এই পিতাপুত্রের জন্য।
আজ ডাওকির ঝুলন্ত সেতুকে দেখতে হাজারো পর্যটকের ভীড়ে হয়তো কেউ জানেন না এই দৃষ্টি নন্দন সেতু তৈরীর ইতিহাস আর প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরীর নাম । তেমনি হয়ত অনেকই জানেন না বাংলাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাথে জড়িয়ে আছে প্রকৌশলী জামিল রেজা চৌধুরীর নাম।যিনি JRC নামে পরিচিত।
আবিদ রেজা চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস ছিলো আসামের কাছাড় জিলার হাইলাকান্দিতে। যা এখন ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক ভ্যালীর অন্তর্গত ।
প্রায় ৯০ বছর আগে নির্মিত দৃষ্টি নন্দন
এই ঝুলন্ত ব্রিজটি এখনো ভারত তথা এই
অঞ্চলের একটি আকর্ষনীয় স্থাপনা।প্রতি
দিন বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত অগনিত পর্যটক খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ে ঝুলে থাকা ব্রিজটি দেখে মুগ্ধ হন আর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন।কিন্তু কতজন জানেন - এই ব্রিজ তৈরীর ইতিহাস আর তার সাথে জড়িয়ে
থাকা শ্রীহট্র বাসীর আবেগ ভালোবাসা আর ডাওকি ব্রিজের স্রষ্টা আমাদের আবিদ রেজা চৌধুরী নাম।
শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা এই কৃতি পিতাপুত্রের স্মৃতির প্রতি।
কোন মন্তব্য নেই