Header Ads

ডেপুটি কমিশনার বলেছিলেন বন্যার গুজবে কান দেবেন না। শিলচর বাসী আজ কি দেখছেন?

আজকের শিলচরে র ছবি
হিমু লস্কর  :  শিলচর

কেউ ঠেকে শেখে , কেউ দেখে। আমরা কাছাড়বাসী শিখলাম ঠেকে-দেখে। ভয়ঙ্কর দুর্যোগ সামনে জেনেও জেলার কর্তাব্যক্তিরা শুধু তোতা পাখির মতো আশ্বাসবাণী-ই আউড়ে গেলেন। তাদের অন্তঃসারশূন্য ফাঁকা বুলিতে ভরসা করে ফাঁকতালে ভেসে গেল লাখো মানুষের বাড়িঘর। বেঘোরে প্রাণ খোয়ালেন কয়েকজন। হপ্তাখানেকের মধ্যে ২০-২৫ বছর পিছিয়ে গেল শিলচর সমেত গোটা উপত্যকা। 

মে মাসেই বন্যা হয়েছে কাছাড়ে। হয়েছে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি। এর একমাসের মাথায় জুনে কার্যত মহাপ্লাবনের সাক্ষী হয়েছে জেলা। কিন্তু প্রশাসন কী করেছে, কী বলেছে  এই প্রলয়ে ! প্রশ্নটা মিলিয়ন ডলারের। কেননা, রাজনৈতিক মাঁচায় বুকচিতিয়ে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটানো কিংবা  বরাভয় প্রদান স্বঘোষিত জননেতাদের কর্তব্য।  তাইবলে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যারা বড়ো বড়ো পাশ-টাশ করে জেলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেছেন, জনতার ট্যাক্সে যাদের বেতন থেকে শুরু করে আয়েসি জীবন চলে, স্পর্শকাতর সময়ে যাদের একটা সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে লাখো মানুষের জানমালের নিরাপত্তা----তারাও কি সেটাই করবেন ! 

কেন? 

কেন কাছাড়ের জেলাশাসক কার্যালয়ে কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির একাংশ কর্মীর হাত ও গলায় থাকবে কাছির মতো পুরু সোনার অলংকার? কোন জাদুমন্ত্রবলে শহরে একাধিক ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি করেছেন তারা? মাসকাবারে কত  বেতন তাদের? কেন জেলাশাসক কার্যালয়ের কর্মীদের কেউ ভূমি কেলেঙ্কারী তো কেউ ঘুষ নিতে গিয়ে গ্রেফতার হচ্ছেন? ডিসি অফিসের জনৈক অধস্তন কর্মীকে এনআরসির ভূতপূর্ব সমন্বয়কের নামে ডাকা হয়, কেন? 

এরা কি সবাই উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অন্ধকারে রেখে টেবিল-তলার বেনোজলে চান করছেন? না-কি টেবিল টপকে উঁচু আসনগুলোও চান করছে আরও বেশি জলে? কেন সময় থাকতে বরাকের নড়বড়ে স্লুইস গেট ও নদীবাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নিল না জলসম্পদ বিভাগ? এব্যাপারে  কি কোনও তদ্বির করেছে প্রশাসন?  না-কি 'জনতা যায়ে ভাঁড়মে' মানসিকতায় এতদিন ঘিয়ে মাখা আঙুল চাটতে ব্যস্ত ছিলেন সবাই? 

বন্যার ক্ষতি হয়ত একদিন পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু জলের ছ্যাঁকায় যারা সর্বস্ব হারাল, সন্তান-সন্ততি অভিভাবকহীন হল, তাদের ক্ষতি কি কোনও দিন পূরণ হবে? কে নেবে এর দায়ভার? যারা কমন মেন(Common men) -এর কর-এ করেকম্মে খাচ্ছেন, বড়ফট্টাই করে বেড়াচ্ছেন, তাদের জানা উচিত ----আমজনতা চাইলে এরকম হাজারো প্রশ্নের সুনামি উঠতে পারে। পারবেন তখন সুনামির ঢেউ আটকাতে?  

প্রশ্ন ছেড়ে চলুন চোখ রাখি-----বিধ্বংসী বন্যার ঠিক আগ মূহুর্তে এবং বন্যা শুরুর পর কী বলছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। তবে এর আগে বরাকের বাইরের পাঠকদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ জরুরি।   

শিলচর সহ উপত্যকায় বৃষ্টি নামে ১৬ জুন,বৃহস্পতিবার। শুক্রবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ধারাবর্ষণের সাক্ষী হয় শহর (শিলচর)। রবিবার আসতে আসতে বন্যা। সোমবার থেকে বুধবার বা এর পরবর্তী দিনগুলোতে কী ঘটেছে, ঘটছে ---শিলচরবাসী মাত্রেই  তা জানেন। 

অনেকেই বলবেন, প্রকৃতির রুদ্ররোষ আটকাবে মানুষ, এ আবার কি কথা ! আর কেউ কি তখন জানত, এমন প্রলয়ঙ্করী বন্যা আসছে ! 

তর্কের খাতিরে আদ্ধেক কথা  না-হয় মেনে নেওয়া গেল। সত্যিই তো, বন্যায় মানুষের হাত নেই। সে কাউকে বলেকয়ে আসেও না। তবে আঁচ করা তো যায়। আর কিছু না-হোক, মানুষকে অন্তত সময় থাকতে সতর্ক করা তো যায়।  আর সেটা করতে গেলে সবাইকে যে আবহাওয়াবিদ কিংবা নদীবিশেষজ্ঞ  হতে-ই হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? ইটস অ্যা ম্যাটার অব কমনসেন্স। 

সেই কমনসেন্স থেকে ঘাঘরার মাছ শিকারী বাবলু দাস পনের-কুড়ি দিন আগেই অনুমান করেছিলেন, ফের বন্যা আসছে। বোয়ালজুরমুখে ঘাঘরার স্লুইসগেটের কাছে জাল পেতে মাছ ধরেন বাবলু। সেদিন মাছ কিনতে গিয়ে তার মুখে এ কথা শুনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি করে বুঝলেন? বাবলু বলেছিলেন, নদীতে মাছের লাফালাফি দেখেই তিনি এই অনুমান করছেন। 

বিষটা তাহলে কী দাঁড়াল গিয়ে ! একজন মাছশিকারি  মাছের লাফালাফি দেখেই যা অনুমান করতে পারলেন, অনেক বড় পাশটাশ করেও সেটা পারলেন না প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা! অথচ শিলচরে বৃষ্টি নেমেছে বৃহস্পতিবার। এর তিনদিন আগে সোমবার রাতের প্রবল বর্ষণের জেরে মঙ্গলবার সকালে গুয়াহাটি চলে যায় জলের নীচে। এসবের মাঝখানে প্রবল বৃষ্টির কারণে ধস পড়ে আবারও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বরাক উপত্যকা। ওইসময় হাওয়া দফতরের পূর্বাভাসে বলা হয়, আরও তিন-চারদিন রাজ্যসহ উত্তরপূর্বে প্রবল বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা। কার্যত প্রলয়ের অশনিসংকেত ছিল সেটাই। কিন্তু প্রশাসন সেটার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। কই সঠিকভাবে সতর্কবার্তা জারি করা হবে,  উল্টে বরাভয়ের পর বরাভয় দেওয়া হয়েছে। ১৮ জুন বেতুকান্দি নদীবাঁধ ভেঙে বরাকে জল যখন প্রবলতর বেগে শহর অভিমুখে ধাবিত, সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী জেলাশাসক বলছেন,  "I urge upon the public not to panic and don't believe in rumours that are being circulated. We have released emergency phone numbers of DDMA, which will be available for the public 24x7..."

মানেটা কী দাঁড়াল?  বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে সগর্জনে জল ঢুকবে, আর মানুষ আতঙ্কিত না হয়ে ধীরস্থির হয়ে বসে থাকবে? যেসব দৃশ্য তখন সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছিল, তা মিথ্যা,  গুজব? যদি তা-ই ছিল, তাহলে নদীবাঁধ ভেঙে মহাপ্লাবনসম পরিস্থিতির সৃষ্টি হল কিভাবে? ফোন নম্বর ক'জনের কাজে এসেছে? 

সবচাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ওইদিন জারি করা দীর্ঘ প্রেস বিজ্ঞপ্তির একদম শেষের দিকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, 

"As regards dykes, DC Jalli said, "Last time in May, 2022, public at certain places cut the dykes. But this time, I have made it clear that this kind of attitude will not be tolerated. We will take strict action if such types of activities are detected this time. Till now, no breach of dykes have been reported. At Bethukandi, water was entering slowly through the previously broken part. Water Resource Department in association with Irrigation Department are working together to repair the dyke at Bethukandi and sluice gates at several places of Silchar..."

অর্থাৎ 

নদীবাঁধ সম্পর্কে ডিসি জাল্লি বলেন, "গত (2022 সালের) মে মাসে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় নদীবাঁধ কেটে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এবার আমি স্পষ্ট করে দিচ্ছি যে, এই ধরনের মনোভাব বরদাস্ত করা হবে না। এ ধরনের অপকর্মে জড়িত কেউ ধরা পড়লে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত নদীবাঁধ ভাঙার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।বেথুকান্দিতে আগের ভাঙা অংশ দিয়ে ধীরে ধীরে জল প্রবেশ করছিল। তবে জলসম্পদ বিভাগ ও সেচ দফতরের সহযোগিতায় বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। বিভিন্ন স্থানের স্লুইস গেটগুলোও সারিয়ে তোলা হচ্ছে। 

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাঁধভাঙা নদীর জল শহরে ঢুকতে দেখেও প্রশাসনের তরফে বলা হচ্ছে, জল 'ধীরেধীরে প্রবেশ করছিল'। ক্রিয়াপদের সুকৌশল প্রয়োগে সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন, প্রবেশ করছিল। কিন্তু এখন আর করছে না। এছাড়া বলাই হয়েছে, কোথাও কোনও নদীবাঁধ ভাঙার খবর নেই। ফলে একরকম নিশ্চিন্তেই ছিলেন শহরবাসী। জিনিসপত্র গোছগাছ কিংবা যানবাহন নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। 
কিন্তু ২০ জুন পর্যন্ত কী হয়েছে শিলচর সহ গোটা জেলায়? প্রশাসনের বয়ান এবং রাজনৈতিক নেতাদের বয়ানের মধ্যে কি কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে?  কাদের হটকারিতায় এত এত কষ্ট এবং ক্ষয়ক্ষতি হলো? কেন কেন কেন...?  

এখানেই শেষ নয়। ওইদিন-ই (১৮ জুন, ২০২২) সরকারি প্রেস নোটে  ডিসিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, "Till now, we have not received any request for evacuation. So far, roughly around 25,000 people were affected in Cachar district. But this is a dynamic figure, which can change. We have enough dry ration. There is no shortage. All will get relief. So please don't panic, said the Deputy Commissioner..."

পড়ে দেখুন, স্পষ্ট বলা হয়েছে, "We have enough dry ration. There is no shortage. All will get relief. So please don't panic, said the Deputy Commissioner..."

পেয়েছেন কি রেশন? কয়েকটি ত্রান শিবিরে উপর থেকে চিঁড়া গুড় ফেললেই কি হয়ে গেল?  শুধু শিলচরের জনসংখ্যা কত আর ত্রান শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন কতজন -- সেই হিসেবটা মেলালেই গোটা জেলার ছবি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই প্রলয়ের পরও শিলচরের মানুষ কি প্রশ্ন করবেন না? জানতে চাইবেন না কার ভুলে এমন হলো !

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.