Header Ads

ডুবন্ত নাগরিকের দিনলিপি


- পার্থঙ্কর চৌধুরী,
অধ্যাপক, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়


টানা ছয়দিন হয়ে গেলো গোটা শহরটাই জলের তলায়। এটা তো নিশ্চিত, যে এক না একদিন তো বন্যার জল কমে আসবে। ততদিনে কাড়ি কাড়ি টাকা আসবে। পাব্লিকের ট্যাক্স আর আম্বানীর দেওয়া টাকা দিয়ে দরাজ হস্তে বন্যাক্রান্ত 'মামা-শ্বশুর'-দেরকে ‘হাওরের গরু’, অর্থাৎ, ‘ত্রাণ-সামগ্রী’ বিতরণ করা হবে। ছবি আর ভিডিও দিয়ে 'খবরের কাগজ’ আর 'সামাজিক মাধ্যম' ছয়লাপ করতে গিয়ে 'ড্রইঙ-রুম-পলিটিশিয়ান'-রা নিশ্চয়ই অন্যথা করবেন না।

ভাগ্যিস্ খুব শিগগিরই, অর্থাৎ আগামী দু-চার মাসের মধ্যে এখানটায় কোন 'ILL-ACTION' নেই। না, 'উপ' জাতীয়ও নেই। বিরাট রক্ষে! শহর শিলচরে যখন চুইয়ে চুইয়ে জল ঢুকছিল, তখন শহরের 'ড্রইঙ-রুম-পলিটিশিয়ান'-রা দীর্ঘদিন থেকে 'বাম' অধ্যুষিত প্রতিবেশী রাজ্যে গিয়ে নিরোর বেহালা বাজাচ্ছিলেন। 'বেতুকান্দি-কাণ্ড' যখন এখানে চলছে, সেই সময়টাতেই ওরা 'ব'-অক্ষরটার নিচে একটা বিন্দু (.) জুড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় মরিয়া। সত্যি সেলুকাস... কি বিচিত্র শিলচর নামক এই ‘বন্যাভূমি’!

বলতে চাইছিলাম, বন্যার জল কমে গিয়ে একসময় যখন শহর তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে, আশা করা যেতেই পারে আমাদের 'ব্যালকোণি' -বাবু, যিনি কি না অবলীলায় 'মঙ্গলগ্রহে প্রানের সন্ধান' থেকে শুরু করে 'রকেট-বিজ্ঞান' কিম্বা 'হরিৎ-বিতর্ক' সবকিছুতেই প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয় নিয়ে, কোন কাগজ না দেখেই, ঘণ্টাখানেক বেমালুম বক্তৃতা দিতে পারেন, উনি এবং সেই সমস্ত 'ড্রইঙ-রুম-পলিটিশিয়ান'-রা নিদেনপক্ষে একটা গণমাধ্যমে নিজেদের 'কর্তব্য' ( আসলে কি ছিল) বনাম 'কর্মের' (বাস্তবে কয় ইঞ্চি জলে ক’দিন নেমেছেন, তার) খতিয়ান তোলে ধরবেন। এবং সেদিন তা শোনে, সদ্য জল থেকে উঠে আসা শহুরে নাগরিক আগামী বন্যার (যেটা এবছরই আবার হতে পারে) হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্ততঃপক্ষে মানসিক রসদ লাভ করবেন। 

কাজটা ভাল হোক, কিম্বা মন্দ, প্রত্যেক শুরুর পেছনে আপাত-অদৃশ্য অনেক পর্যায় থাকে, সোজা কথায় যেটাকে 'সলতে-পাকানো' বলা হয়। খাল কেটে যারা শহরে বন্যা এনেছে, তাদের চরম শাস্তি নিশ্চয়ই প্রাপ্য। দুর্যোগ মোকাবিলা আইন, ২০০৫-এ এর বিধান রয়েছে। কিন্তু যে সমস্ত আমলাদের কর্তব্যের গাফিলতিতে এমন দশা এই শহরে হল, তারা কি ‘বেকসুর খালাস’ পেয়ে যাবেন? আরও বলছিলাম, বেতুকান্দি লাগোয়া মহিষাবিল নিয়ে বিগত দু-তিন দশক ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে যারা 'সোনার ডিম' সেদ্ধ করে খাচ্ছিলেন, দুর্যোগ মোকাবিলার 'সেকসন্- ৪০' কি তাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে না?

বলতে চাইছিলাম, বরাকের শাখানদীগুলোর উজানে তো অনেক কৃত্রিম বাঁধ রয়েছে। মিজোরামের ‘তুরিয়াল’ বা অন্য কোন বাঁধ এক্ষেত্রে সুগ্রীব দোসর-এর কাজ করেছে কি না...সেদিকটা কারা খতিয়ে দেখবেন? তেমন যদি হয়, সেটা তো আর রাজ্য বিপর্যয়ের আওতায় সীমাবদ্ধ থাকছে না! বাস্তবিক অর্থেই বলছি, পাশাপাশি থাকা রাজ্যগুলোর মধ্যে বিপর্যয় মোকাবিলা নিয়ে সমঝোতা প্রয়োজন। বর্ষাকালে স্ফীত বরাকের জল বাংলাদেশের সিলেট এবং সুনামগঞ্জ এলাকাতেও বানভাসি পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাই প্রয়োজন, পাশাপাশি থাকা দেশগুলোর মধ্যেও বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলা নিয়ে সমঝোতা।

ব্রহ্মপুত্রের জল এই মুহূর্তে ডিব্ৰুগড় শহরের চাইতে অনেক উঁচুতে বইছে। ঐ শহরটা তিনদিক থেকেই বাঁধ দিয়ে ঘেরা। দিনরাত টহলদারির জন্য সেখানে যদি লোক মোতায়েন সম্ভব হয়, এখানে (অর্থাৎ বরাকের বেতুকান্দি-তে) সে কাজটায় কেউ কি বাগড়া দিচ্ছিল? 

বলতে এটাও চাইছি, যে ডুবন্ত শহর শিলচর তো খুব শিগগিরই কর্পোরেশনে উন্নীত হতে চলেছে। নতুন নতুন এলাকা পৌর এলাকায় চলে আসবে। এখন না হোক, আগামী দশ বছরেই সেটা হয়ে যাবে। জনবসতি আরো প্রচুর বাড়বে। পরিকল্পিত নগরায়ন করলে ভবিষ্যতের ঠ্যালা অনেকটাই সামাল দেওয়া সম্ভব নয় কি?

 কটূক্তি হলেও অক্ষরে অক্ষরে কথাটা সত্যি যে জাতীয় চ্যানেলগুলো উত্তরপূর্বের খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ কিম্বা উগ্রপন্থী আক্রমন জাতীয় ঘটনাগুলোকেই শুধুমাত্র প্রচারের আওতায় আনে, যেন, এসব ছাড়া উত্তর-পুর্বে আর কিছু হয়ই না! আবক্ষ নিমজ্জিত বরাক উপত্যকার খবর কোন সংবাদ মাধ্যমই তোলে ধরছে না। দীর্ঘদিন অন্যদলে থেকে ইদানীং যারা 'ছিন্নমূল' হয়েছেন, তাদেরও তো বন্যাক্রান্তদের জন্য ন্যুনতম সমবেদনা প্রকাশ করতে দেখা গেলো না! জানি না কেন, আজকাল আর কেউই এসে আমাদের আধ-ভাঙ্গা ‘হি-লে-টি’ (হিন্দি মিশ্রিত সিলেটি)তে জিজ্ঞেস করছেন না... 'কিতা খবর? আফনারা সব ভালা আছোইন তো..?'

(লিখাটি প্রথম শিলচর থেকে প্রকাশিত ‘বার্তালিপি’ পত্রিকার ফেসবুক পেইজে ২৫শে জুন, ২০২২ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে)

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.