গোপীনাথ কবিরাজের নাম শুনেছে কি আজকের বাঙ্গালি
*বিরল প্রতিভাবান বাঙালি পন্ডিত গোপীনাথ কবিরাজ।*
***************************
*অনেক গুণী ব্যক্তিত্বদের আমরা মনে রাখি না, খোঁজ ও রাখি না, এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে লেখাটি শেয়ার করলাম।*
******************************
*একটি ছেলে, এমএ পাশের রেজাল্ট সবে হাতে এসেছে। বেনারসে তার বাড়ির বাইরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে বসে আছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জী। নিজে কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন, তাঁকে বোঝাতে। ‘তুমি বাঙালি, কলকাতায় চল, অবিলম্বে অধ্যাপক পদে জয়েন কর’। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও একজন বাঙালি, ডঃ জ্ঞানেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, তিনি আরও বেশী টাকা দিতে তৈরি। লখনউ চলো। লাহোর সংস্কৃত কলেজ, আজমের মেয়ো কলেজের অধ্যক্ষরাও টেলিগ্রাম করেছেন। টাকার পরিমানেও যেন নীলাম চলছে দশটা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। কে পায় তাঁকে অধ্যাপক হিসেবে। বেনারস সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। উত্তরপ্রদেশ সরকার তাঁকে সসম্মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে উপাচার্য করে বসাতে চায়। মাইনে তিরিশ হাজার টাকা, এবং সালটা ১৯১৩। কাশী সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ সে যুগে যে কোনও বিখ্যাত পণ্ডিতের কাছেও স্বপ্নের মত। কিন্তু কাশীর বিদ্বোৎসমাজ তাকেই চায়। ছেলেটি সকলকে একই কথা বলল, আমি মন দিয়ে গবেষণা করতে চাই, চাকরি এখন নয়।*
*কিন্তু একজন সামান্য এমএ পাশ ছাত্রকে নিয়ে এরকম টানাটানি কেন, কে সে? ছেলেটির নাম গোপীনাথ কবিরাজ।আদ্যন্ত বাঙালি। বাবা বৈকুণ্ঠনাথ কবিরাজ, ঢাকার একজন প্রখ্যাত দার্শনিক ছিলেন। কিন্তু ছেলেটি জন্মানোর আগেই বাবাকে হারায়। ঢাকার কাছে, ধামরাই গ্রামে, মামার বাড়িতে মানুষ। আইএ পরীক্ষা দিতে কলকাতা এসেছিল সে, কিন্তু কলকাতার জল হাওয়া মোটে সহ্য হল না, পেট খারাপ লেগেই থাকত। তাই ১৯০৬ সালে তিনি গেলেন জয়পুরে। ভর্তি হলেন জয়পুর কলেজে। কিন্তু থাকবেন কোথায়, খাবেন কি? ব্যবস্থা হয়ে গেল। জয়পুরের রাজা সোয়াই মাধো সিংয়ের প্রধানমন্ত্রী রায় বাহাদুর সংসার চন্দ্র সেন একজন বাঙালি। ছেলেমেয়েদের জন্য একজন গৃহ শিক্ষক খুঁজছিলেন। গোপীনাথ পড়ার সাথে পড়ানো শুরু করলে, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। জয়পুরের মহারাজা কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় বসলেন গোপীনাথ, কিন্তু শুধু ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টই নয়, একটা নম্বরও যে তাঁর কাটা যায়নি। অধ্যক্ষ সংজীবন গাঙ্গুলি আর ইংরেজি অধ্যাপক নবকৃষ্ণ রায় দুজনই বাঙালি, এঁরা জানতেন এরকম কিছু একটা হতে চলেছে। কারণ প্রতিদিন অধ্যাপকরা এসে অভিযোগ করেন, গোপীনাথ এমন এমন প্রশ্ন করে, যে রাতের বেলা বাড়িতে পড়াশোনা করতে হয়। একদিন অধ্যক্ষ তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখতে বললেন। তিনি এমন একটা আর্টিকেল জমা দিলেন, যেটা নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পাঠাতে হল। ইংরেজি অধ্যাপক নবকৃষ্ণ রায় ব্রাউনিং এর একটি কবিতার ভাব লিখতে বললেন, গোপীনাথের লেখা দেখে নববাবু বললেন, ‘মাই গড আই কুড নট রাইট বেটার দ্যান দিস’। শুধু কি তাই, পাণিনি, ইতিহাস, সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রীক, ইংরেজি, প্রত্নতত্ত্ব সব বিষয়ে এই বয়সে সে রীতিমত পন্ডিত। তার নম্বর কাটবে কে? তাঁকে পনের টাকা তখনকার দিনে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হল, লাইব্রেরী খুলে দেওয়া হল তার জন্য।*
*বিএ পরীক্ষা দেবার সময় তাঁর মৌখিক পরীক্ষা নিতে এলেন কাশীর কুইন্স কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ আরথার ভেনিস। গোপীনাথের জ্ঞান দেখে তাঁর মাথা ঘুরে গেল। যে কুইন্স কলেজে ভর্তির জন্য সবাই তদ্বির করত, সেখানে এমএ পড়ার জন্য গোপীনাথকে অনুরোধ করতে লাগলেন ডঃ ভেনিস। গোপীনাথ কাশী চলে এলেন। সেই যে এলেন, জীবনে দুবার কাশী থেকে বেরিয়েছেন, দুবারই দিল্লিতে গেছেন। একবার পদ্মবিভূষণ নিতে, একবার সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার নিতে।*
*তিনি এমএতে ডঃ ভেনিসের কাছে প্রাচীন লিপি, মুদ্রা, লেখ, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। ব্রাহ্মী, কুষাণ, গুপ্ত যুগের শিলালিপির পাঠোদ্ধারের কাজ শুরু করলেন। বামাচরন ন্যায়াচার্যের কাছে ন্যায় ও শাস্ত্র এবং ডঃ নরমানের কাছে পালি, প্রাকৃত, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষা পড়া শুরু করলেন। জন মার্শালের কথা মনে আছে তো? সেই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে ছিল, পুরাতত্ত্ব বিভাগের ডিরেক্টর? তিনিও গোপীনাথের ভক্ত ছিলেন, হাতে নতুন কোনও শিলালিপি, পান্ডুলিপি এলেই গোপীনাথের খোঁজ। সে ছাড়া এর পাঠ উদ্ধার কে করবে?*
*এর পরেই সেই এমএ পরীক্ষা, আবার ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং নিয়োগ পত্র নিয়ে সকলের লাইন। ১৯২৪ সালে অবশ্য উত্তরপ্রদেশ সরকার একরকম জোর করেই তাঁকে গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের পদ নিতে বাধ্য করে।*
*গোপীনাথ কবিরাজ ছিলেন বিশ্বের প্রথম প্রকৃত ইন্ডোলজিস্ট, ভারততত্ত্ববিদ। এখন যে পৃথিবীর বহু দেশে, বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরেখা তৈরী করেছিলেন গোপীনাথ কবিরাজ। একাধারে প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, ভুগোল, প্রাচীন পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত এবং গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় সুপন্ডিত হওয়ার ফলে, সিন্ধু সভ্যতা, মিশরীয়, অ্যাসিরীয় বা রোমান সভ্যতার তুলনামুলক আলোচনা। আবার ন্যায়, শাস্ত্র, যোগ, সাংখ্য, মীমাংসা বা বেদান্তের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ব্যাখ্যা সব তাঁর কাছে নখ দর্পণে থাকত। তাঁর কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল যাঁদের, তাঁদের মধ্যে একজন লিখেছেন, ‘একদিন বিকেলে গিয়ে দেখি, একটি ছোট মেয়েকে তিনি জ্যামিতির হল এন্ড স্টিভেন্সের পঞ্চম উপপাদ্য বোঝাচ্ছেন। যতবার মেয়েটি বুঝতে পারছে না, ততবার বলছেন। ধৈর্যের যেন তিনি সমুদ্র। সেদিন ব্যস্ত আছেন বলে, পরদিন গিয়ে দেখি, তিনজন বৃদ্ধ পণ্ডিতকে তিনি ব্রহ্মসূত্রের জটিল অদ্বৈত তত্ত্ব বলছেন। হাতের কাছে কোনও বই নেই, ঝড়ের মত, সুত্র সংখ্যা সহ মুখস্থ বলে যাচ্ছেন’।*
*ছাত্র অবস্থায় তিনি পেয়েছিলেন কয়েকজন নামকরা শিক্ষক। আর পরবর্তী জীবনে তিনজন মহাজ্ঞানী গুরু। শ্রী শিবরামানন্দ যোগত্রয়ানন্দ, যোগীরাজ শ্রী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস এবং মা আনন্দময়ী। শ্রী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস ছিলেন বিশ্বের দু'একজন মানুষের একজন, যারা জ্ঞানগঞ্জে শিক্ষা লাভ করতে পেরেছিলেন (জ্ঞানগঞ্জ কি, তা জানতে চাইলে, গুগলে গিয়ে দেখতে পারেন)।*
*আমরা বাঙালি হিসেবে বহু মনীষীর নামে গর্ব করি।তাঁরা সত্যিই আমাদের গর্ব। কিন্তু গোপীনাথ কবিরাজের মত মানুষকে আমরা ভুলে গেলাম কি করে! তিনি ছিলেন প্রকৃত স্থিতধী এবং স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁর উননব্বই বছর বয়সের জীবনে, তাঁকে কেউ কখনও রাগ, ঘৃনা, জাতপাতের ভেদ, অহংকার, এমনকি জোরে কথা বলতেও শোনেনি। তিনি ছিলেন প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু। জ্ঞানের সন্ধানে সমস্ত শ্রেনীর সকল মানুষের সাথে তিনি কথা বলতেন। কিন্তু কাশীর বাইরে বেরোতেন না। দশটার বেশী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট দিয়েছে, তাঁর একটাই শর্ত ছিল, যা করার কর, কেবল এই কাশীর মাটি থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করো না। বিভিন্ন দিকের তাঁর জ্ঞান, সাধনা, অধ্যাত্ম চেতনা, অনাড়ম্বর জীবন, মানুষের প্রতি মমত্ববোধের কারণে, তাঁকে প্রাচীন ভারতের ঋষিদের সাথে তুলনা করা হয়। আশা করি এই মহামানবকে আমরা আগামী দিনে বাঙালির গর্ব হিসেবে স্মরণ করব।*
সংগ্রহ:
স্বামী বেদস্বরূপানন্দ:RMIC,
গোলপার্ক,কলকাতা।
কোন মন্তব্য নেই