শিলচর বন্যা একটু বেঁচে থাকার কাতর আর্তনাদ
✍অপরাজিতা দে-র লেখা ✍ তারিখ ২৫ জুন, রাত ৮টা, এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী শিলচর শহরে, শুধুমাত্র শহরে তিনটা লাশ ভেসে উঠেছে। বন্যায় ডুবে হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা সংবাদমাধ্যমে এখনও বেরোয়নি। শহর শিলচর ভাল নেই, সুস্থ নেই। ‘শহর’ শব্দের উচ্চারণ খুব সচেতন ভাবেই একটু জোর দিয়ে নিলাম, কারণ শহরের বাইরের খবর এই উপত্যকার মানুষের কাছেও নেই পুরোটা। এই ‘নেই’ এর অনুপাতই এখন শিলচরে বেশি। গ্রামের খবর ‘নেই’, পানীয় জল ‘নেই’, খাদ্য ‘নেই’, বিদ্যুৎ ‘নেই’, ইন্টারনেট ‘নেই’, মোবাইল নেটওয়ার্ক ‘নেই’, ওষুধ ‘নেই’, কোনও যোগাযোগ মাধ্যম ‘নেই’, বাড়ি-ঘর ‘নেই’, মনে শক্তি ‘নেই’, দেহে প্রাণ ‘নেই’। আছে শুধুমাত্র জল, মানুষের হাহাকার, একটু বেঁচে থাকার কাতর আর্তনাদ।
যারা এই পরিস্থিতির শিকার হননি কোনওদিন, হতেও যেন না হয়; তারা একবার ভেবে দেখুন। শনিবার কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার সময় দেখলেন শহরের অনেক রোডে হাঁটু জল। আপনি নিশ্চিত কারণ এখনও পর্যন্ত কোনওদিন বন্যায় আপনার বাড়ি জল ওঠেনি। কিন্তু রোববার আপনার এবং পরিচিত আরও অনেকের উঠোন পর্যন্ত জল। বিদ্যুৎ সকাল থেকে নেই। প্রথম উপলব্ধি করলেন বিদ্যুৎ খুব তাড়াতাড়ি আসবে না, তাই মোমবাতিটা বা কেরোসিনের বাতিটা বা ইনভার্টার দিয়ে আলো সাবধানে জ্বালাতে হবে। বাজারে গিয়ে কিছু জিনিস কিনতে গিয়ে দেখলেন যে দোকানপাট বন্ধ, আপনি নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসই না কিনে বাড়ি ফিরলেন। সোমবার আসতে আসতে আপনার ঘরে হাঁটু জল, আপনার গলিতে গলা জল এবং অন্যান্য অঞ্চলের অনেকের বাড়ির গ্রাউনফ্লোর জলের তলায়, অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। তার পর বুঝতে পারলেন খেতে বসেও একটু মেপে খেতে হবে, জল বাড়ছে বেরোতে পারবেন না বা দোকান খোলা পাবেন না অনেক দিন। তারপর বুঝতে পারলেন, যে জল বেমালুম প্রতিদিন ব্যবহার করেন সেটাও মেপে ব্যবহার করতে হবে। এভাবে কারও দু’দিন, কারোর তিন দিন, কারোর চার দিন পর্যন্তও কাটল। তারপর? মোমবাতির শেষ আলো টুকুও নিভে গেল, জলের শেষ বিন্দু দিয়ে গলা ভেজালেন এবং এই আশায় প্রহর গুণছেন যে কেউ যদি এসে সাহায্য করে যায়। ফোন পুরো বন্ধ হওয়ার আগে আপন জনকে জানিয়ে রাখলেন, পাশের শহরের ভাইবন্ধুদের জানিয়ে রাখলেন। এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। আপনার নিজের কোনো কিছু বোঝার আগেই আপনি পুরো জলবন্দি হয়ে গেলেন, কারণ কোনও সতর্কবাণী দেওয়া হয়নি। বুধবার আসতে আসতে আপনি একদম বিধ্বস্ত।
শিলচরে ১৮ তারিখ, শনিবার থেকেই বন্যার জল বাড়তে থাকলেও মানুষ অজান্তেই ফাঁদে আটকে পড়ল। ইনভার্টার বা পাওয়ার ব্যাঙ্কের সুবিধে বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। খাদ্যসামগ্রী বেশির ভাগ মানুষই খুব বেশি হলে এক সপ্তাহের জন্য সংগ্রহ করে রাখেন। দিন আনা দিন মজুরের কথা এখানে লিখছিই না, তাঁদের সংগ্রামটা আরও কঠিন, তাদের সাথে কথা না বলে তাদের কথা লেখাটাই অনুচিত। যাদের ঘরে খাদ্য আছে পর্যাপ্ত, তাঁদের কাছেও জল নেই। বৃষ্টির জল সঞ্চয় করে খেলেই হয়–এই ধরণের উত্তরই অনেকের মাথায় ঘুরছে নিশ্চয়ই। কিন্তু যখন সবাই উপলব্ধি করল স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে অনেক দিন লাগবে, ততক্ষণে বন্যায় অনেকের বাড়ি জলের তলায় হারিয়ে গেছে বা অনেকে নিজের বাড়িরই ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন এবং বৃষ্টি তখন প্রায় নেই। তার পরও অনেকেই বৃষ্টির জল সঞ্চয় করে সেটা খেয়েই বেঁচে আছেন। যাদের সেই জল নেই তারা বন্যার দূষিত জল ফুটিয়ে খাচ্ছেন। এটাতেও সমস্যা আছে, জল না ফুটিয়ে খাওয়া মানে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো। বিপর্যয়ের আসল ছবি বন্যার সংবাদে মেলেনা (গ্রাউন্ড জিরো র সৌজন্যে)
কোন মন্তব্য নেই