Header Ads

শ্রদ্ধাঞ্জলি

হঠাৎ পাওয়া অন্তরে গেঁথে যাওয়া এক টেলিফোন কল



রত্নজ্যোতি দত্ত

প্রায় চৌত্রিশ মাস আগে শিলচর থেকে হটাৎ পাওয়া এক টেলিফোন কলের কথা সেদিন মনে পড়ে গেল। ওপাশের ভদ্রলোক জানিয়ে ছিলেন যে তিনি আমার পিতৃদেব আসামের বিশিষ্ট সমাজসেবী রাধাপদ দত্তের প্রয়াণের কথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক বহুল প্রচলিত দৈনিক সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। পিতৃদেবের দেহাবসানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি আমাকে আন্তরিক সমবেদনা জানান। সেই দিনই বাবার বাল্যবন্ধু প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ মহাশয়ের লেখা একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সে মহানুভবের এরূপভাবে সুদূর শিলচর থেকে রাজধানীতে দূরভাষযোগে আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো আমাকে প্রভাবিত করেছিল তা বলতে আজ আর কোনো বাধা নেই।
গত সোমবার (২২ নভেম্বর, ২০২১) রাত্রি দশ ঘটিকার পর একটা কল পেলাম  রাজধানীর বসন্ত কুঞ্জ লোকালয়ে বসবাসকারী রাজু (দেবাশিষ বিশ্বাস) দার কাছ থেকে। রাজুদা একজন ভদ্রলোকের মৃত্যু সংবাদ জানানোর জন্য ফোনটি করেছিলেন।সাথে উদ্দেশ্য ছিল সে মৃত্যু সংবাদের সাথে জড়িত থাকা একটি জ্বলন্ত সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্য। রাজুদা সেদিন কলটি করেছিলেন শিলচরের অনতিদূরে থাকা পৈলাপুলের নেহেরু কলেজের সেবা নিবৃত এক ইংরাজীর  অধ্যাপকের  প্রয়াণ সংবাদ জানানোর জন্য। আর, উনি অবসর নেওয়ার প্রায় এগারো মাসের পরও প্রাপ্য নিয়মিত পেনশন পাননি। নিঃসন্তান প্রয়াত অধ্যাপকের পত্নীর ভবিষ্যতের আর্থিক সুরক্ষার প্রসঙ্গও রাজুদা সেদিন উল্লেখ করেন। বিগত দুই দশক ধরে দেশের রাজধানীতে থাকা রাজুদা নেহেরু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও প্রয়াত অধ্যাপকের গুনগ্রাহী বিদ্যার্থী।
স্বাভাবিকই যে রাজুদাকে প্রয়াত অধ্যাপকজনের নাম জিজ্ঞাসা করলাম। রাজুদা বললেন সে অধ্যাপক হলেন দীপক সোম। সঙ্গে সঙ্গেই রাজুদাকে বললাম - আমিও  উনাকে চিনি, যদিওবা আমি উনার ছাত্র নই । 
আমার কথায় রাজুদা মনে  হল একটু অবাক হন।  রাজুদা জিজ্ঞেস করলেন তা তুমি উনাকে কিভাবে চিনো? জানালাম পিতৃদেবের শ্রাদ্ধ্য দিবসে প্রাপ্ত মনে দাগ কাটা সে ফোন কলটির কথা। 
দ্বিতীয় যোগসূত্রটি ছিল তদনীন্তন নেহেরু কলেজের প্রয়াত অধ্যক্ষ অরুণ কুমার দত্ত চৌধুরী যিনি আমার মেজো মামা হন। অধ্যক্ষ দত্ত চৌধুরী মহাশয়ের স্নেহধন্য প্রিয়পাত্র ছিলেন দীপক সোম। সর্বজনবিদিত বরাকের নামি শিক্ষাবিদ দত্ত চৌধুরী মহাশয় প্রায় দুই দশক নেহেরু কলেজের অধ্যক্ষতা করেছিলেন। নেহেরু কলেজের বর্তমান সময়ের  শ্রীবৃদ্ধির  ভিত্তিপ্রস্তর চৌধুরী মহাশয় রেখেছিলেন যা পৈলাপুলবাসী আজও শ্রদ্ধাসহকারে স্মরণ করেন। সে সময়ের গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি উগ্রপন্থি সমস্যায় জর্জরিত মনিপুর রাজ্যের লাগোয়া বরাক উপত্যকার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে জাতীয় মূলধারার সাথে যুক্ত করার রাষ্ট্রীয় কার্য্যের কেন্দ্রভূমি রূপে বর্তমান সময়ে পরিণিত করার কাজে নিয়োজিত আছে। পৈলাপুল জায়গাটি আসামের লক্ষিপুর বিধানসভার অন্তর্গত। 
নেহেরু কলেজ প্রয়াত দীনেশ প্রসাদ গোয়ালা, সাতবারের বিধায়ক ও যিনি বহু বছর ধরে আসাম সরকারের মন্ত্রী পরিষদে সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এবং বরাক উপত্যকার বিখ্যাত ব্যঙ্গ লেখক প্রয়াত গণেশ দে-র মতো ব্যক্তিত্বদের দ্বারা ঋদ্ধ হয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে৷
রাজুদা প্রিয় দীপক স্যারের পরের দিনের মিডিয়া কভারেজ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন কারণ তিনি ছিলেন না বরাক উপত্যকার প্রধান কেন্দ্র শিলচরের কোনো নামকরা কলেজের অধ্যাপক। ছিলেন না আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক। 
তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে আমি তার প্রিয় 'দীপক স্যার'-এর প্রয়াণের উপর একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখ লিখব যদিওবা সাক্ষ্যতে উনার সাথে কখনো দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তার উদারচেতা ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অপ্রত্যক্ষভাবে  অবগত ছিলাম।
রাজুদার চিন্তা নিরসনের জন্য পরদিন সকালবেলা লক্ষীপুরের বিধায়ক কৌশিক রাইকে ফোন করে অধ্যাপকের প্রয়াণের কথা জানিয়ে পেনশন নিয়মিত করে অধ্যাপকের সহধর্মিনীর দুশ্চিতার সুরাহা করার অনুরোধ জানালাম। কৌশিকবাবু পেনশন সম্বন্ধিত সমস্যার অতি সত্বর সমাধানের কথা দিলেন।
রাজুদার ফোনের পর সে দিন রাত্রেই আমি আমার বাবার মৃত্যুতে সমবেদনা জানানো দীপক সোমের ব্যাক্তিত্বের কথা বন্ধুবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ধ্রুবেন্দুশেখর ভট্টাচার্য্যকে জানাই।  "দীপকবাবু নিশ্চিতভাবেই একজন ভালো লোক ছিলেন কারণ তিনি নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে কাকুকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। একজন ভালো মনের অধিকারিই একজন সৎ ব্যাক্তির কদর করতে পারেন। এরূপ প্রজাতির ব্যাক্তিত্বরা কিন্তু ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন, তা এক পরিতাপের বিষয়।" বন্ধুবরের এই কথাগুলো সত্যিই মনে গেঁথে গেছে। 
সত্যি তো, দীপকবাবুর মতো আধুনিকমনস্ক বিদ্যার ছটা ছাড়ানো শিক্ষকরা এ পৃথিবী ছেড়ে না ফিরে আসার দেশে চলে যাচ্ছেন একে একে!!  

[লেখক নুতন দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত একজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও নয়া ঠাহর পোর্টাল গোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতা সম্পাদক।]

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.