Header Ads

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের তিরোধান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

--সাঁওতাল পরগণা গেছিলেন কোনোদিন?

--গেছিলাম তো। গত শীতেই এক সন্ধেবেলায়। ফিরে এসেছি পরদিন সকালেই।

--একটা সকালেই দেখা হয়ে গেলো সব!!

--হ্যাঁ,হয়ে গেলো,আর কিছু দেখার ছিলো না।

--ব্যাপারটা কি বলুন তো,কিছু কি হয়েছিলো আপনার? 

--হ্যাঁ, হয়েছিলো। 

স্টেশনে পৌঁছে উঠেছিলাম কাছাকাছি একটা গেস্ট হাউসে। থাকার ইচ্ছেও ছিলো হপ্তাখানেক। জানোই তো, বড্ড চায়ের নেশা আমার। তাই, রাত শেষ হতেই মাফলার সোয়েটার জড়িয়ে গেলুম মোড়ের মাথায় চায়ের দোকানে। ভিড় নেই। খুবই শীত তখন। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এক গ্লাস চা নিয়ে বসেছিলেন, গায়ে বেশ ভারি আর দামি কাশ্মীরি শাল। দোকানের ঠিক বাইরেই এক বয়স্কা মহিলা বসে আছেন ভিক্ষের প্রত্যাশায়। একটা ছেঁড়া শাড়ি, গায়ে চাদর-টাদর কিচ্ছু নেই, শীতে ঠকঠক করে কাঁপছেন। অভ্যাসবশতই হাত চলে গিয়েছিলো পকেটে। একটা কয়েন ছুঁড়ে দিলুম মহিলাটির বাটিতে। বৃদ্ধ হেসে উঠলেন। অকারণ অট্টহাসি। একটু বিরক্ত হয়েই চা টোস্টের অর্ডার দিয়ে বেঞ্চিতে বৃদ্ধের সঙ্গে বেশ দূরত্ব রেখেই বসলাম। একটু পরে বেশ গম্ভীর গলাতেই প্রশ্ন করলেন তিনি-- মশায় কি বাঙালি? বেড়াতে এসেছেন? কী নাম আপনার?  উত্তর দিলুম। বৃদ্ধ হাসলেন।সৌজন্যবশতই প্রশ্ন করলাম, আপনিও কি বেড়াতে এসেছেন? আপনার নাম "কী?উত্তর দিলেন না ,উলটে রীতিমতো বিদ্রূপের হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমাকে---তা মশায়ের লেখাপড়া কদ্দুর? স্নাতক? বেশ ক্ষিপ্ত হয়েই জবাব দিয়েছিলুম-আমি কলেজে পড়াই।
--- অ! তাহলে তো স্নাতকোত্তর। বিদ্যের জাহাজ বললেই চলে!---প্রতিটি শব্দ কাঁটা হয়ে ফুটছে আমার বুকে। চায়ের গ্লাস রেখে এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই স্মিত হেসে বললেন আমাকে --- আপনি স্নাতক নন। স্নান সমাপ্ত না হলে কেউ স্নাতক হয় না। শুনুন, তৈত্তিরীয় উপনিষদে একটা মন্ত্র আছে---- "শ্রদ্ধয়া দেয়ম্। অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্। শ্রিয়া দেয়ম্। হ্রিয়া দেয়ম্। ভিয়া দেয়ম্। সংবিদা দেয়ম্।" মুহূর্তে বজ্রকঠিন হয়ে উঠলো বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর--এভাবে টাকা ছুঁড়ে ভিক্ষা কখনো দেবেন না আর---যদি দিতে ইচ্ছে হয় কখনো, শ্রদ্ধার সঙ্গে দেবেন, অশ্রদ্ধাভরে দেবেন না, সবিনয়ে দেবেন, কুণ্ঠিত হয়ে দেবেন, সমগ্র সত্তা দিয়ে দেবেন ---বলেই বেরিয়ে গেলেন বৃদ্ধ। দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে সেই মহিলাকে বললেন--মা একটু উঠে দাঁড়ান তো। গা থেকে মহার্ঘ শালটা খুলে অতি যত্নে জড়িয়ে দিলেন বৃদ্ধার গায়ে। স্তম্ভিত আমার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে কাটা কাটা গলায় বললেন-বেড়াতে আসিনি, এখানেই থাকি আমি। বাঙালি সম্ভবত নই , সম্ভবত ঘৃণাই করি জাতটাকে। আর  আমার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মুহূর্তে  পৃথিবী দুলে উঠলো আমার চোখের সামনে।। টাল সামলে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াবার আগেই দেখলুম  বৃদ্ধ এগিয়ে গেছেন বহুদূর। যতদূর তিনি চলেছেন ততদূর পর্যন্ত নিষ্পত্র গাছগুলোতে ফুটে উঠছে অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া। যতদূর তিনি চলেছেন, আকাশ জুড়ে শঙ্খধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। শুনছি সমুদ্রগর্জন। স্পষ্ট দেখছি উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ তাঁকে আনত হয়ে প্রণাম করে ফিরে যাচ্ছে; আর আমার চোখের সামনে তখন উন্মোচিত হচ্ছে মহাভারতের মহানাটকের এক দৃশ্যপট। "স্নানম্ চ কিম্ পরম্ প্রোক্তং"-যক্ষরূপী ধর্ম প্রশ্ন করছেন যুধিষ্ঠিরকে-স্নান কী? "স্নানম্ মনোমলত্যাগো"-সসম্ভ্রমে যক্ষকে উত্তর দিচ্ছেন ধর্মপুত্র-বালতি বালতি জল ঢালা নয়, মনোমল ত্যাগ করাকেই স্নান বলা হয়। একমুহূর্তও দাঁড়াবার সাহস ছিলো না আর সাঁওতাল পরগণার মাটিতে। পরের ট্রেনেই ফিরে এসেছিলাম কলকাতায়।

‌                     
  (সংগৃহীত)

🙏🙏আজ বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের প্রয়াণ দিবসে🙏🙏posted as received in wa

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.