শিশু দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ রচনা
রমেশ স্কুল আর দিকপূর্ণপুর
বর্ণালি দাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
শিশুদিবস। ছেলে সকাল থেকেই বালদিবসের রচনা লিখছে হিন্দিতে। লেখা থেকে কাটাকুটিই বেশী। হ্রস্ব ই আর দীর্ঘ ঈ ছোটো মস্তিস্কটায় সবসময় গতি এবং দিক দুটোই পরিবর্তন করে! হিন্দি নোটবুকের নীচে উঁকি দিচ্ছে একটা কালো প্রচ্ছদ। ভাবলাম নির্ঘাত আরেকটা গর্জিলা শাবক নোটবুকের পাতায়। চোখ পাকাতেই বেরিয়ে এলো- ‘দ্য টেস্ট অফ টাইম’ এর পান্ডুলিপির খসড়া।
এহেন দিকভ্রান্ত ছেলেকে নিয়ে গতকাল বসেছিলাম বাংলা অ আ ক খ লেখাতে। ছুটিছাটায় শেখাই, দেখি আবার কয়েকমাসেই যে কে সেই - বাংলা বই পড়তে গিয়ে আবার হোঁচট খাচ্ছে। রাগেদু:খে দিশেহারা। তক্ষুনি অ আ ক খ'র বইটি বেরিয়ে এলো মায়ের ঝুলি থেকে। মা নেই। কিন্তু মা সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছেন। অবাক হলাম। এমনি আমরা মা মেয়ে প্রচন্ড আগোছালো। সেই কবেকার ১৯৯৯ এর পাঁজিপুঁথি। এমনিতে মাকে মায়ের নিজের লেখা গল্প বা ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন চাইলে কখনো কোনো সদোত্তর পাওয়া যেত না। অথচ তেরো চোদ্দ বছরের আমার আমির লেখা ও আঁকার বই সযত্নে মায়ের পেঁটরায়: হায়রে মাতৃস্নেহ। - আবার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ। বইটি ছাপার সময় আমি দিল্লি লেডি হারডিন্জে ফাইনাল এম বি বি এস- তার মধ্যে মা বইটার জন্যে ‘গ্রন্থকারের কলম থেকে’ লেখাটা চাইলেন। - আমি ইচ্ছেমত জ্ঞানগম্যি দিয়ে ভরিয়ে দিলাম পাতা- হা ভগবান!! কি জ্ঞানের বহর জ্ঞানদা বুড়ির। আজ আবার ছেলের কল্যানে স্মৃতি চারণ।
তৃতীয় শ্রেণীকক্ষ। বাংলা ক্লাস। দোহারা চেহারার শিক্ষক। তাঁর বৈশিষ্ট্য একটা সবুজ কালির ফাউন্টেন পেন। কাটাকুটির থেকে ওই পেন কাজে লাগে বেশী বাহবা, সাবাস, নিদেন পক্ষে খুব ভালো লিখতে।
একদিন ক্লাসের শুরুতেই ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলেন এক আজব প্রশ্ন: তোমরা ভবিষ্যতে কে কি হতে চাও লিখে জানাও। তৃতীয় শ্রেণীতেই ভবিষ্যতের ধারাপাত - নাহ! তখনকার দিনের মাবাবারা আজকালকার মতো বাচ্চার ঘোড়দৌড়ের হিসেব কষতেন না ছোটবেলায়! পড়ুয়ারা এই অভিনব প্রশ্নের জন্য তৈরী ছিল না। শিক্ষক, প্রফেসর, ডাক্তার, ইন্জিনীয়ার ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না শিশুদের কল্পনার রাজ্য। সেদিন কল্পনার পক্ষীরাজ টগবগিয়ে ছুটে বেড়িয়েছিল চতুর্দিকে। যে যার খুশি মত ইচ্ছেঘোড়ায় সওয়ারী হয়েছিলো।
তার মধ্যে একজনের খাতায় লেখা ছিল বাংলা ভাষার শিক্ষিকা। জানিনা মেয়েটির মনে সেদিন কি ছিল! বাংলার শিক্ষিকা হয়ে সবুজকালি দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত খাতায় সাবাস লিখে দেওয়াটাই হয়তো নবম বর্ষীয়ার রোলমডেল ছিলো সেদিন। সে যাই হোক! ফলস্বরূপ তারপর থেকে মেয়েটির হোমওয়ার্কের খাতায় রোজ একটা করে সবুজ কালির স্কেচ বা ছবি আঁকা থাকত। মেয়েটির কাজ ছিলো প্রতিদিন বাড়ি গিয়ে ওই স্কেচের সঙ্গে মিলিয়ে একটা কবিতা লেখা। সেই কবিতার ওপর সবুজ কালিতে সাবাস লেখা দেখতে দেখতে মেয়েটি ভেসে বেড়াতো কল্পনার রাজ্যে। প্রথম প্রথম বাড়ির কেউ টেরও পায় নি শিক্ষক ছাত্রীর সেই আঁকা লেখা খেলা - তারপর যখন মায়ের ডায়রির পাতা, দেয়াল লিখনে হিজিবিজির বদলে কবিতা স্থান নিল মা স্তম্ভিত! কী অনির্বচনীয় এই শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া- অভিনব অথচ কি অনায়াসলব্ধ! কল্পনার রাজ্যের রুদ্ধদ্বারের চাবি খুলে দিলেন সেদিনকার সেই শিক্ষক।
হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল স্কুলের সেই ষ্টেজ – নীল শাড়ি দুই বিনুনি সাদা ফিতা। মাইকের সামনে চোখ বুজে আওড়ে চলছে স্বামীজির সেই বাণীঃ
“Education is the manifestation of the perfection already in man”.
কয়েক দশক আগের কয়েক হাজার ক্রোশ দূরের সুদূর উদয়পুরের স্কুলবেলার স্মৃতি চোখ ঝাপসা করে দিল।
স্কুল মানেই একরাশ সুখ স্মৃতি হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ছোট্ট দুই বিনুনি সাদা ফিতা বাদামী চুল। মা সকাল থেকেই ব্যস্ত। বাবার সাইকেলের সামনে ছোট্ট একটা লাল সিট। বাবার সংগে পাড়ি জমায় স্বপ্নের ভেলায়। স্কুলের প্রথম দিন। ছায়া সুনিবিড় স্কুল। বিশাল ব্যাপ্তি - দেখে ছোট্ট মেয়েটির চোখ ছানাবড়া। বর্ণময় দিনগুলোর শুরু - মনুষ্যত্বের প্রথম পাঠ। সকালে প্রেয়ার মিটিং, তারপর ক্লাস, সব শেষে আদিগন্ত মাঠে খেলাধুলা। মন ভালো করে দেয়ার মতো পরিবেশ - শিশুমনের বিরাটত্বকে জানার প্রথম হাতেখড়ি।
রবীন্দ্র পরিষদে আঁকা, নাচ; আবৃত্তি তীর্থে কবিতা, বৃহস্পতিবারে গানের ক্লাস -বড্ড বোঝা ছোট্ট মেয়েটির। আঁকা আবৃত্তি গানের শিক্ষকরা উজার করে দিয়েছেন। সেই নাকে সিগনি মাখা ছোট্ট মেয়েটি আকাশে রামধনুর রং দেখে ছবি আঁকতে বসে, কখনো ইচ্ছে হলেই বৃষ্টির কনকনে ঠান্ডা পুকুর জলে এপার ওপার সাঁতরে কবিতা আওরায়, যে কখনো হোম ওয়র্কের খাতায় কবিতা লিখে বাহবা পায়, আবার কখনো ক্লাসে দুষ্টুমি করে জিংলাপোড়া বেতের বাড়িতে লাল হয়ে কান ধরে বেন্চের ওপর দাঁড়িয়ে ছিঁচ কাঁদুনি। জগন্নাথ দিঘির পারে সাইকেলে দুই বিনুনির সেই ছোট্ট মেয়েটি তেরো চোদ্দ বছর বয়সে কর্মশিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে হঠাৎ ছড়া ছবির বই লিখে ফেলে, ছেলেবেলার দিনগুলো এমনিতর খুশির ভেলায় ভরা। খেয়ালখুশির দিন, কিন্তু স্বপ্ন রঙিন। উদয়পুরের রমেশ স্কুল আমার জীবনের এবং আমার হৃদয়ের দিকশূন্যপুর আর দিকপরিপূর্ণপুর দুটোরই ঠিকানা।
স্কুল ফেরত পাড়া বেড়ানোয় মেয়েটির জুড়ি ছিল না। কখনো বুড়ির বাড়ির খড় কুটো জোগাড় করতে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ানো। আবার কখনো বন্ধুদের সঙ্গে কাবাডি গোল্লাছুট। কখনো বা পুকুরে ডুব সাঁতার দিয়ে পারাপার। পুঁই গাছের বিচি টিপে আলতা পরা পা। ঝিনুকের ধার দিয়ে আম কুচি কেটে নারকোলের খোলেতে আচার। বিচ্ছুদের দলের সর্দারনী হয়ে রাতের আঁধারে তেঁতুল গাছের ডালে উঠে বাড়ির সব্বাইকে ভয় দেখানো। স্কুলফিরতি পথে ধানশিরিষের বনে হলদে সবুজ ঘাসফড়িঙের সারির মাঝে হারিয়ে যাওয়া।
মেয়েটির সেই ছোটোবেলার সোনামুড়া পাড়ার গোলাপী রঙের বাড়ি, সেই বারান্দায় মাধবীলতার গুচ্ছ, দশ পয়সার লাল বরফের আইসক্রিম (মা বলত ওটা ড্রেনের জলে বানানো), সেই এপার ওপার সাঁতরে দাপাদাপির পুকুর, সেই ঠাকুমার পূজোর ঘর, সেই সকাল সন্ধ্যা সারা পাড়া শুনিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে সুর করে পড়ার ঘর, পুতুলের সংসার, পুতুল খেলার সাথী, এক্কাদোক্কার ঘর কাটা উঠোন, কাকভোরে উঠে গলা সাধার হারমোনিয়াম, তুলসিতলা, দুপুরবেলার পুকুর পাড়ে রোদ পোহানো ঢোড়া সাপটা, মায়ের হাতে লাগানো আম, কাঁঠাল, সুপুরি গাছ - অনেক কিছুই আজ আর নেই- তবুও নীল ফ্রক দুইবিনুনির অনেক কিছু বয়ে বেড়াচ্ছে এখনো সেই উদয়পুরের গোলাপী বাড়িটা আর প্রিয় রমেশ স্কুল। প্রাণের প্রাচুর্য্যের ছোঁয়া সর্বত্র। এই প্রবাসে চোখবুজলেই সেই নীল ফ্রক আর দুই বিনুনির হৃদয়ের পান্ডুলিপি।
প্রায়ই কাজের ফাঁকে আমার আমিকে খুঁজে ফিরি: জাবর কাটি: পুরোনো দিনগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসে।
ঘুরে এলেম ছেলেবেলার স্কুলের বাড়ি মনে মনে।
ইচ্ছে ফানুস উড়িয়ে দিয়ে রাঙামাটির পথের কোণে।।
স্কুলের ভেতর ওই দেখা যায়, দুই বিনুনি উঁকি ঝুঁকি।
লুচি পায়েস মিষ্টি বোঁদে প্রসাদ হাতে ছোট্ট খুকি।।
হঠাৎ কখন সেই খুকিটি কিশোরী প্রায় তাঁতের শাড়ী
অঞ্জলিতে ফুলের ডালি হাতের ছোঁয়া সেই ছেলেটি।
আকাশ জুড়ে মেঘ ভাসি ঐ বৃষ্টি যেন চোখাচোখি-
সাইকেল আর হাঁটা পথে ত্রস্ত পায়ে স্কুলের মোড়ে।।
এ রূপকথা বড্ড চেনা তোমার আমার খসড়া পাতায়,
রূপকথা নয়, রোমন্থনের সাপলুডোতে জীবন কথা।
সেই অবাধ উচ্ছাসময় স্কুলবেলা একটা দিনের জন্যে ধার করতে আজ বড়ো ইচ্ছে হয়।
মনে পড়ে দিল্লির লেডী হার্ডিঞ্জে তখন সদ্য এসেছি – কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া বিছানো কনাটপ্লেসের রাস্তা- হাঁটতে হাঁটতে কত সন্ধ্যায় ফিরে যেতাম কিশোরীবেলার উদয়পুরে- নীল শাড়ি সাইকেল বাহিনীর সলজ্জ কিশোরী আভা। স্কুল ফেরত ছোট্ট চিরকুট হাতে গুঁজে কোন কিশোরের দৌড়ে পালানো! সেই লাজুক কিশোরীর স্বপ্নময় চোখ- কলেজগামিনীর হৃদয়ে তখনও যেন লেপ্টে আছে আধচেনা ব্যাথা।
স্কুলের বিস্তৃতি- শুধু পড়াশোনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না জীবন- আবৃত্তি, গান, নাচ, আঁকা, বিতর্ক, মক পার্লিয়ামেন্ট, গল্প কবিতা লেখা – পাখির মত ডানা মেলে নিজেকে মেলে ধরার জীবন – সেই স্কুল বালিকার পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় করে নেয়ার সংকল্প।
আজও হৃদয় নিংড়ে চোখ ছাপিয়ে জল – মনে পড়ে সেই নীল শাড়ি, দুই বিনুনি সাদা ফিতা, আর স্বপ্নময় চোখ – রমেশ স্কুলের সেই তরুনীর চোখে আজ মধ্যাহ্নে পৃথিবীকে দেখতে বড় শখ হয়।
কয়েক দশক আগের দুই বিনুনি সাদা ফিতার হৃদয়ের পান্ডুলিপির হলদেটে পাতাগুলো দিলো হঠাৎ নাড়িতে হেঁচকা টান।
চেতনার গভীরে
ডুব সাঁতার-
হঠাৎ নাড়িতে হেঁচকা টান।
সভ্যতার বন্ধন-
ছিন্ন করে প্রবাসী মন
ধায় ছুটে আপন মৃত্তিকায়।
ভেসে ওঠে অগুনতি
ভালোবাসার অবয়ব-
হাতড়াই বেঞ্চিতে চেনা মুখ।
মাধুকরী হৃদয় তোলপাড়-
ক্লাসঘর অলিগলি-
মিলে মিশে সব একাকার।।
উল্লেখ (রেফারেন্স) -
১)
‘অ আ ক খ’র মেলা।
ছড়ায় ছবিতে খেলা।’
জ্ঞান বিচিত্র প্রকাশনী।
বুক ওয়ার্ল্ড। হরি গঙ্গা বসাক রোড।
আগরতলা। ৭৯৯০০১।
২) “The Test of Time" by Diptarko Bandyopadhyaya.
Amazon Kindle edition:
https://amzn.in/eGGCnUT
[লেখিকা পরিচিতি: ডা. বর্ণালি দাশ। কনসালটেন্ট, ল্যাবরেটরি মেডিসিন, কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতাল , মুম্বাই।]
কোন মন্তব্য নেই