এসএসসি ম্যাজিক কাহিনী সম্পর্কে দু’চার কথা !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
প্রথমেই বলা রাখা ভাল এ প্রতিবেদন যুক্তি-তর্ক-বোধহীন অন্ধ মোসাহেবদের জন্যে নয়--এ প্রতিবেদন সেইসব মেধাসম্পন্নদের ভেবে দেখার জন্য যারা শিক্ষকতার চাকরি প্রার্থী, পাশাপাশি সেইসব শিক্ষক ও শিক্ষক নেতা এবং অন্যান্য ‘জনসেবক’ রাজনৈতিক নেতাদেরও ভেবে দেখার জন্য যারা এখনও পুরোপুরি মতি ও নীতি-আদর্শ ভ্রষ্ট হয়ে উঠতে পারেন নি। এ লেখার জন্য আমি বাধ্য হয়েছি সেইসব অসংখ্য শিক্ষক অভিভাবকদের একজন হিসেবে যাদের বিন্দুমাত্র ভরসা ও আশা নেই রাজ্য শিক্ষামন্ত্রীর ওপর।
প্রথমেই বলা রাখা ভাল এ প্রতিবেদন যুক্তি-তর্ক-বোধহীন অন্ধ মোসাহেবদের জন্যে নয়--এ প্রতিবেদন সেইসব মেধাসম্পন্নদের ভেবে দেখার জন্য যারা শিক্ষকতার চাকরি প্রার্থী, পাশাপাশি সেইসব শিক্ষক ও শিক্ষক নেতা এবং অন্যান্য ‘জনসেবক’ রাজনৈতিক নেতাদেরও ভেবে দেখার জন্য যারা এখনও পুরোপুরি মতি ও নীতি-আদর্শ ভ্রষ্ট হয়ে উঠতে পারেন নি। এ লেখার জন্য আমি বাধ্য হয়েছি সেইসব অসংখ্য শিক্ষক অভিভাবকদের একজন হিসেবে যাদের বিন্দুমাত্র ভরসা ও আশা নেই রাজ্য শিক্ষামন্ত্রীর ওপর।
গতকাল টিভি-সংবাদে শুনলেও বিশ্বাস করা সম্ভব হয় নি যে, এসএসসি’র পরীক্ষায় যারা যে নম্বর পাবে সেই নম্বরের ভিত্তিতেই শিক্ষক নিয়োগ হবে এবং ঐ লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার স্কোর-মার্ক যোগ হবে না ! এতে নাকি দুর্নীতি রোধ করা যাবে ! যাবতীয় দুর্নীতির সুযোগ যে প্রার্থীদের অ্যাকাডেমিক স্কোরের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এতদিন--এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের ‘মেধা’ থেকেই মানুষের বুঝতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না যে, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং তাঁর সরকারের শিক্ষানীতি যারা তৈরি করেন তাদের ওপর বিন্দু মাত্র আস্থা রাখার কোনো জায়গাই আর নেই। প্রার্থীদের অ্যাকাডেমিক স্কোর থেকে বঞ্চিত করার অর্থই হল--উচ্চ মেধার শিক্ষার্জনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়া। ৫০% মার্কস্ পেলেই যখন এসএসসি পরীক্ষায় বসা যাবে এবং কোয়ালিফাই করলে তালিকায় নাম উঠে যাবে, তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়া বা প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো প্রয়োজনই তো থাকছে না ! ছেলেমেয়েরা কেন মাঝারি মাপের শিক্ষাজীবন কোনরকমে শেষ করে এসএসসি’র পরীক্ষায় বসার কথাই ভাববে না--এমন কী স্নাতক হয়েই এসএসসি’র পরীক্ষার জন্যে নিজেদের তৈরি করে তোলার চেষ্টায় উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষাটাই বিসর্জন দিয়ে দিতে বাধ্য হবে না? যেসব চাকরিপ্রার্থী ইতিমধ্যেই প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর-এমফিল-বিএড করেছে তারাও নিজেদের মুড়ির দরে ভবিষ্যৎ ভাসিয়ে দেবে?
এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরটাই চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করা হলে হাজার হাজার মেধাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের প্রতি মারাত্মক অবিচার করা হবে। কারণ তাৎক্ষণিক নানান কারণে কখনো কখনো মেধাবী ছেলেমেয়েদের দু’একটা পরীক্ষা ভাল নাও হতে পারে--সেক্ষেত্রে তার অ্যাকাডেমিক স্কোরকে বাদ দিয়ে তার মূল্যায়ন করাটা স্বাভাবিক এবং নীতিগত পদক্ষেপ হতে পারে না। এরকম নিয়ম যদি সত্যি সত্যি বলবৎ হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই বহু ছেলেমেয়ে আদালতে যেতেই পারেন।
আসলে এই পদক্ষেপ দুর্নীতি রোধের পদক্ষেপ নয়--নির্মমভাবে মেধা হত্যার পদক্ষেপ এবং বিশেষভাবে দুর্নীতিকে আরও ঝঞ্ঝাটমুক্ত সহজ করার পদক্ষেপ বলেই অনেকে মনে করছেন। মানুষের অভিজ্ঞতাই সেটা মনে করতে বাধ্য করছে।
অ্যাকাডেমিক স্কোর-মার্ক যুক্ত করার ফলে অগ্রিম বুকিং করে রাখা সকলের নাম তালিকায় তোলা যাচ্ছিল না বলেই সমস্যা তৈরি হচ্ছিল এত দিন--কেস-কাছাড়িও হচ্ছিল ব্যাপক হারে। এখন যদি অ্যাকাডেমিক স্কোরকে বাদ রেখে তালিকা তৈরি করা যায় তাহলে অগ্রিম বুকিং করে রাখাদের নাম বিনা ঝামেলায় তুলে দেওয়া সহজ হয়ে যাবে।
সাধারণ মানুষের আশঙ্কা এই পদক্ষেপে দুর্নীতি খুব সহজ হয়ে যাবে। নিম্নমেধার চাকরিপ্রার্থীরা খুব সহজেই নিজেদের নাম তালিকায় তুলতে পারবে। প্রশ্ন উঠতেই পারে এটা এত সহজে হবে কি করে? অভিজ্ঞ লোকেদের আশঙ্কা যথাক্রমে এইরকম--
জেলায় জেলায় অগ্রিম বুকিংয়ের দায়িত্বে যারা থাকবে তারা অগ্রিম বুকিংয়ের তালিকা তৈরি করে ‘‘অগ্রিমসহ’’ (এবারে এ ব্যাপারে আইনি সতর্কতা বিশেষভাবে খুঁটিয়ে দেখা হবে) বিশেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে। সব জেলার তালিকা থেকে টিক্ চিহ্ন দেওয়াদের নাম নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে যারা থাকবে তাদের টেবিলে টিক্ চিহ্নিতদের রোল নং অনুযায়ী উত্তরপত্র (যতদিন না অনলাইন পরীক্ষা হচ্ছে) পৌঁছে যাবে। সেখানেই সঠিক উত্তরের বৃত্ত ভরাট হবে বা টিক্ চিহ্ন পড়বে। তালিকায় তোলার মতো নম্বর পাওয়া যারা নিশ্চিত করতে চাইবে তারা খুব বেশি হলেও ১০%-এর বেশি উত্তর দেওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন উত্তরপত্র জমা দিয়ে তাদের ঘনিষ্ঠ মহলে বুকে চাপড় মেরে বলবে--আমি এবার চাকরি পাচ্ছি-ই! তালিকা প্রকাশের পর তাদের নাম দেখে তাই চরম বিস্মিত হলেও নিরর্থক জেনেই কেউ চ্যালেঞ্জ জানাবে না। এরকম ঘটনা এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে ভেতরে ভেতরে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেও কারুর বিশেষ কিছু করার থাকে না। এই ব্যাপারটাকে খুব নিশ্চিত ও সহজ করে তোলার জন্যেই প্রার্থীদের অ্যাকাডেমিক স্কোরকে যুক্ত করা হচ্ছে না।
আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানো হলেও পরীক্ষায় ‘‘ভাল’’ নম্বর পাওয়াদের উত্তরপত্র দেখানোর প্রশ্নেও এসএসসি কর্তাদের আর বিব্রত হতে হবে না ! কাজেই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যে নতুন নিয়োগ পদ্ধতি সামনে নিযে এলেন তাতে চরম আশঙ্কার মধ্যে ঢুকে গেল মেধাবী ছেলেমেয়েরা।
এই পদ্ধতির যদি পরিবর্তন অবিলম্বে না ঘটানো হয় তাহলে চাকরি প্রার্থী যুব সমাজ ও তাদের পরিবারের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুর ও বিধানসভা ভোটে। যেমনটা গত লোকসভা নির্বাচনে সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এবারে তার চেয়েও বড় প্রভাব পড়বে। কারণ, দুর্নীতি রোধের নামে মেধাবী ছেলেমেয়েদের মেধার স্বীকৃতি হরণ ও হত্যা কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে না। তা সে যতই হাস্যকর অপযুক্তি দিয়ে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করা হোক না কেন !
কোন মন্তব্য নেই