এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতিতে বাম-কংগ্রেস প্রাসঙ্গিক নয় কেন !!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
সিপিএমের সর্বভারতীয় তাত্ত্বিক নেতা প্রকাশ কারাত ভারতীয় মার্ক্সবাদকে কফিনে শুইয়েছিলেন সেদিন-ই যেদিন তিনি ১০০% শতাংশ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলার প্রবাদপ্রতিম সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেন নি এবং যা ভারতীয় বাম রাজনীতিতে ‘ঐতিহাসিক ভূল’ হিসেবে চিহ্নিত হযে আছে। কফিনের শেষ পেরেকটিও মেরেছিলেন ঐ প্রকাশ কারাত-ই পরমাণু চুক্তিকে ইস্যু করে ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে সরকারের পাশ থেকে সরে এসে। তারপর থেকেই গোটা ভারত সহ যে তিনটি রাজ্যে লালবাতি জ্বলছিল সেইসব রাজ্যেও সিপিএমের অবক্ষয় শুরু হতে হতে আজ তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে--যেটুকু যা কাগজে-কলমে দলীয় অস্তিত্ব টিকে আছে তা কিছু তথাকথিত তাত্ত্বিক নেতাদের বোলচালেই সীমাবদ্ধ।
এ রাজ্যে জ্যোতি বসু’র অবসরের পর থেকে ধীরে ধীরে যে জনবিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছিল তার কারণ অনুসন্ধানে সিপিএম ভাবনা চিন্তা করার বদলে তাদের ক্ষমতায় থাকাটাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ধরে নিয়ে ঔদ্ধত্য-উন্নাসিকতায় স্বজন পোষণের পাশাপাশি পুলিশ ও আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতায় বিরোধী শূন্য রাজনীতি কায়েমের দিকেই ভীষণভাবে তৎপরতা বাড়িয়ে যাচ্ছিল। যুব সমাজ যে তাদের পাশ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে--পুলিশ-আমলাতন্ত্রও যে প্রতিনিয়ত অপমানজনক দাসত্বের হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল--প্রবল আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মতুষ্ট সিপিএম টের পায় নি। যখন পেল তখন সরাসরি তাদের জায়গা হলো ভেন্টিলেশনে। পরিবর্তনের সুনামিতে ভেসে গেল চোখের পলকেই বলতে গেলে!
২০১৪ সালে কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার তথা কংগ্রেসকেও প্রায় ভেন্টিলেশনেই ঢুকিয়ে দিল বিজেপি। বাংলায় ছত্রভঙ্গ বলে একটা শব্দ আছে--বিজেপি সেই শব্দটার ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের চূড়ান্ত দক্ষতা দেখিয়ে বিরোধীদের এমনভাবে ছত্রভঙ্গ করে দিল যে তাদের আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাই থাকল না। এ রাজ্যেও ঢাল-তলোয়ার না থাকলেও বিজপি এখন প্রবল প্রতাপান্বিত তৃণমূলের প্রধান (প্রায় একমাত্র) প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো! এ রাজ্যে সঙ্ঘাশ্রয়ী বিজেপি’র উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। তাদের শুধু প্রাসঙ্গিক করে তোলাই নয়--রাজ্যরাজনীতিতে তাদের রীতিমতো প্রধান বিরোধীপক্ষ করে তুললো তৃণমূল কংগ্রেস। যে কংগ্রেস বিচ্ছিন্নতার ফল স্বরূপ তৃণমূলের জন্ম--সেই তৃণমূলের প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজন ছিল সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্ব তুলে ধরে রাজ্যে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের জন্যে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন অটলবিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন বিজেপি’র সমর্থন। তৃণমূল নেত্রী সেটা পুরো মাত্রায় পেয়ে গিয়েছিলেন, তখন বিজেপিরও প্রয়োজন ছিল এ রাজ্যে পায়ের নিচে কিছুটা হলেও শক্ত মাটি। সেটা তারা পেয়েওছিল। একবার নয়--তৃণমূল নেত্রী দু’বার এনডিএ সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে, আমার যা আজও মনে হয়, জর্জ ফার্ণাণ্ডেজ ইস্যুতে তিনি মারাত্মক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সে সময়ে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সেই যে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তৈরি হলো এবং ‘আনপ্রেডিক্টেবল্’ ইমেজ তৈরি হলো তা আজও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর বিরোধী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সেই নিরঙ্কুশ গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলতে পারছে না। ২০১৪ বা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
যে সিপিএমের বিরুদ্ধে অল-আউট যুদ্ধ করে তৃণমূলের বিপুল জয়--ক্ষমতায় বসেই সেই সিপিএমের পঞ্চায়েত-পুরসভা থেকে সিপিএমেরই হার্মাদ সদস্যদের ভয় দেখিয়ে--নানারকম টোপ দিয়ে তৃণমূল দল ‘বাড়ানোর রাজনীতি’ শুরু করে দিল। অসংখ্য অপকর্ম করে যারা ভবিষ্যতের জন্যে ভীত আতঙ্কিত ছিল তারাও দলে দলে তৃণমূলের শোভা ও সম্পদ হয়ে তৃণমূল স্তরে একেবারে সামনের মুখ হয়ে উঠলো। পেছনে চলে গেল রক্ত-ঘাম ঝরানো প্রকৃত তৃণমূলীরা। ধীরে ধীরে সবাই দেখতে থাকলো--সিপিএমের ছেড়ে যাওয়া চটি-জুতোয় পা গলিয়ে তৃণমূল আরও দ্রুত ছুটতে চাইছে! ফলে সিপিএম তথা বামেদের ঝাণ্ডা ধরে এ রাজ্যে পথে নামার লোকজন গ্রাম-শহরে আর দেখাই গেল না। ২০১১’র পর থেকে আয়োজিত নির্বাচনগুলিতে বামপন্থীরা দ্রুত লুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হতে থাকলেন। শেষের দিকে রাজনৈতিক পুঁজি বা সম্বল বলতে বামেদের ছিল পুলিশ আর আমলা। সেই পুঁজিও প্রায় নিঃশেষে তুলে নিল তৃণমূল। পুলিশ ও আমলাতন্ত্রে নিঃশর্ত ক্রীতদাস প্রথা চালুর যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সিপিএম রীতিমতো গবেষণা চালিয়ে তৈরি করেছিল--সেই রাজনৈতিক প্রথার উন্নততর সংস্কৃতি নিজেদের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে ফেলতে দেরি করে নি। যতক্ষণ ক্রীতদাস সংষ্কৃতি বজায় থাকবে ততদিন ক্ষমতাও হাতে থাকবে এ বিশ্বাস থেকেই বামপন্থীদের পতন সুনিশ্চিত হয়ে উঠলেও বাম নেতারা তা মানতে চান নি। ফলে তাঁরা আজ আক্ষরিক অর্থেই সর্বহারা হয়ে পড়েছেন। বিশেষ কেউ পোঁছেও না--খোঁজ খবরও নেয় না। নির্বাচনের দিনগুলিতে দেওয়াল লেখার জন্যে বা পোস্টার সাঁটার জন্যেও এখন কমরেডদের মধ্যে হুড়োহুড়ি তো দূরের কথা তাদের পাত্তাই পাওয়া যায় না। ফলে সিপিএম তথা বামনেতাদের এখন ফাঁকা বাগাড়ম্বর বা বুলি সর্বস্বতার মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণার চেষ্টা করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। সুতরাং রাজ্যরাজনীতিতে বামেদের এই স্রেফ বুলিসর্বস্বতার কারণে একটা বড়সড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে--যার অনেকটাই গিলে নিতে পারছে বিজেপি।
অন্যদিকে সাতের দশকের কংগ্রেস রাজনীতিতে যে দাপট প্রিয়-সুব্রত-নুরুল-মমতার ছিল সিদ্ধার্থ জমানার পর বামপন্থীদের প্রবল উত্থানের পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে কংগ্রেস হাইকমাণ্ড তথা সনিয়া-রাজীবের একটা পারস্পরিক নির্ভরতার রাজনীতি শুরু হয়। প্রকাশ্যে একে অপরকে দুরমুশ করার রাজনীতি চালিয়ে গেলেও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ছল-কপটতাকে সামনে রেখে দলীয় স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি চলতে থাকায় এ রাজ্যে বামেদের দাপট দিন দিন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে প্রদেশ কংগ্রেস তত নাবালকত্বতেই আটকে থাকার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রদেশ কংগ্রেসের এই নাবাকত্বের প্রতিবাদেই মমতাকে কংগ্রেস ছেড়ে অল-আউট সিপিএম বিরোধিতার পালে হাওয়া তুলতে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম দিলেন। তাঁকেও অনেক রক্ত-ঘাম ঝরাতে হয়েছে--শেষপর্যন্ত তিনি সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে ভেন্টিলেশনে পাঠাতে পেরেছেন। জ্যোতি বসুর কাল থেকে কংগ্রেস সেই যে আন্দোলনহীনতার প্রায় নিষ্ক্রিয় রাজনীতিতে ঢুকে গেল তা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারলো না। কংগ্রেসও তাদের হাইকমাণ্ডের সৌজন্যে এবং শাসনে বুলিসর্বস্ব একটি রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়ে গেল। এ রাজ্যে কংগ্রেসও যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকলো ততই তাদের অসংখ্য কর্মী ও নেতাদের একাংশের মনে হতে লাগলো এ রাজ্যে কংগ্রেসের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ফলে তারাও দল ছেড়ে দলে দলে নানান প্রলোভনের শিকার হয়ে তৃণমূল শিবিরে ঢুকে গেল। রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের তৈরি করা শূন্যস্থানে বেশ হিসেব কষেই বিজেপি ঢুকে যেতে পেরেছে। প্রকৃতিতে শূন্যস্থান বলে কিছু থাকে না। রাজ্যরাজনীতিতেও শুধুমাত্র তৃণমূল থাকবে--বাকিটা ইচ্ছেমতো যেমন খুশি কসরতের জন্যে ফাঁকা পড়ে থাকবে তা তো হওয়ার নয়--সুতরাং বিজেপি দ্রুত শেকড় ছড়াতে দেরি করে নি। তৃণমূলের সব কিছু গিলে খাওয়ার আগ্রাসী রাজনীতির দৌলতেই সিপিএম-কংগ্রেস কোমায় চলে যাওয়ার সুযোগে বিজেপি বিপুল ক্ষমতায় কেন্দ্রে গুছিয়ে বসতে না বসতেই এ রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের শূন্যস্থান এতটাই ভরাট হয়ে গেল যে, তৃণমূল নেত্রীকেও নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে কর্পোরেট ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে ডাকতে হলো অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য! প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শেই মনোনীত হবে দলের প্রার্থী--পালিত হবে রাজনৈতিক আচার আচরণ। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে--তৃণমূলের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে অনেকটাই উদ্বেগজনক। তার একটা বিশেষ কারণ
হলো--বাম-কংগ্রেস জোট। এ জোট শেষপর্যন্ত যদি ফলপ্রসূ হয় তাহলে বহু ক্ষেত্রেই ৫০-১০০ ভোট কেটে নেওয়ার কারণেই সমস্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছেই। তবু কি বিজেপি তৃণমূলকে বড়সড় ধাক্কা দিতে পারবে? আমার তা মনে হয় না। কেন মনে হয় না সেটাও বিশ্লেষণ করবো নিশ্চয়ই!
সিপিএমের সর্বভারতীয় তাত্ত্বিক নেতা প্রকাশ কারাত ভারতীয় মার্ক্সবাদকে কফিনে শুইয়েছিলেন সেদিন-ই যেদিন তিনি ১০০% শতাংশ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলার প্রবাদপ্রতিম সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেন নি এবং যা ভারতীয় বাম রাজনীতিতে ‘ঐতিহাসিক ভূল’ হিসেবে চিহ্নিত হযে আছে। কফিনের শেষ পেরেকটিও মেরেছিলেন ঐ প্রকাশ কারাত-ই পরমাণু চুক্তিকে ইস্যু করে ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে সরকারের পাশ থেকে সরে এসে। তারপর থেকেই গোটা ভারত সহ যে তিনটি রাজ্যে লালবাতি জ্বলছিল সেইসব রাজ্যেও সিপিএমের অবক্ষয় শুরু হতে হতে আজ তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে--যেটুকু যা কাগজে-কলমে দলীয় অস্তিত্ব টিকে আছে তা কিছু তথাকথিত তাত্ত্বিক নেতাদের বোলচালেই সীমাবদ্ধ।
এ রাজ্যে জ্যোতি বসু’র অবসরের পর থেকে ধীরে ধীরে যে জনবিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছিল তার কারণ অনুসন্ধানে সিপিএম ভাবনা চিন্তা করার বদলে তাদের ক্ষমতায় থাকাটাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ধরে নিয়ে ঔদ্ধত্য-উন্নাসিকতায় স্বজন পোষণের পাশাপাশি পুলিশ ও আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতায় বিরোধী শূন্য রাজনীতি কায়েমের দিকেই ভীষণভাবে তৎপরতা বাড়িয়ে যাচ্ছিল। যুব সমাজ যে তাদের পাশ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে--পুলিশ-আমলাতন্ত্রও যে প্রতিনিয়ত অপমানজনক দাসত্বের হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল--প্রবল আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মতুষ্ট সিপিএম টের পায় নি। যখন পেল তখন সরাসরি তাদের জায়গা হলো ভেন্টিলেশনে। পরিবর্তনের সুনামিতে ভেসে গেল চোখের পলকেই বলতে গেলে!
২০১৪ সালে কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার তথা কংগ্রেসকেও প্রায় ভেন্টিলেশনেই ঢুকিয়ে দিল বিজেপি। বাংলায় ছত্রভঙ্গ বলে একটা শব্দ আছে--বিজেপি সেই শব্দটার ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের চূড়ান্ত দক্ষতা দেখিয়ে বিরোধীদের এমনভাবে ছত্রভঙ্গ করে দিল যে তাদের আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাই থাকল না। এ রাজ্যেও ঢাল-তলোয়ার না থাকলেও বিজপি এখন প্রবল প্রতাপান্বিত তৃণমূলের প্রধান (প্রায় একমাত্র) প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো! এ রাজ্যে সঙ্ঘাশ্রয়ী বিজেপি’র উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। তাদের শুধু প্রাসঙ্গিক করে তোলাই নয়--রাজ্যরাজনীতিতে তাদের রীতিমতো প্রধান বিরোধীপক্ষ করে তুললো তৃণমূল কংগ্রেস। যে কংগ্রেস বিচ্ছিন্নতার ফল স্বরূপ তৃণমূলের জন্ম--সেই তৃণমূলের প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজন ছিল সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্ব তুলে ধরে রাজ্যে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের জন্যে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন অটলবিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন বিজেপি’র সমর্থন। তৃণমূল নেত্রী সেটা পুরো মাত্রায় পেয়ে গিয়েছিলেন, তখন বিজেপিরও প্রয়োজন ছিল এ রাজ্যে পায়ের নিচে কিছুটা হলেও শক্ত মাটি। সেটা তারা পেয়েওছিল। একবার নয়--তৃণমূল নেত্রী দু’বার এনডিএ সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে, আমার যা আজও মনে হয়, জর্জ ফার্ণাণ্ডেজ ইস্যুতে তিনি মারাত্মক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন সে সময়ে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সেই যে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব তৈরি হলো এবং ‘আনপ্রেডিক্টেবল্’ ইমেজ তৈরি হলো তা আজও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর বিরোধী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সেই নিরঙ্কুশ গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলতে পারছে না। ২০১৪ বা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
যে সিপিএমের বিরুদ্ধে অল-আউট যুদ্ধ করে তৃণমূলের বিপুল জয়--ক্ষমতায় বসেই সেই সিপিএমের পঞ্চায়েত-পুরসভা থেকে সিপিএমেরই হার্মাদ সদস্যদের ভয় দেখিয়ে--নানারকম টোপ দিয়ে তৃণমূল দল ‘বাড়ানোর রাজনীতি’ শুরু করে দিল। অসংখ্য অপকর্ম করে যারা ভবিষ্যতের জন্যে ভীত আতঙ্কিত ছিল তারাও দলে দলে তৃণমূলের শোভা ও সম্পদ হয়ে তৃণমূল স্তরে একেবারে সামনের মুখ হয়ে উঠলো। পেছনে চলে গেল রক্ত-ঘাম ঝরানো প্রকৃত তৃণমূলীরা। ধীরে ধীরে সবাই দেখতে থাকলো--সিপিএমের ছেড়ে যাওয়া চটি-জুতোয় পা গলিয়ে তৃণমূল আরও দ্রুত ছুটতে চাইছে! ফলে সিপিএম তথা বামেদের ঝাণ্ডা ধরে এ রাজ্যে পথে নামার লোকজন গ্রাম-শহরে আর দেখাই গেল না। ২০১১’র পর থেকে আয়োজিত নির্বাচনগুলিতে বামপন্থীরা দ্রুত লুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হতে থাকলেন। শেষের দিকে রাজনৈতিক পুঁজি বা সম্বল বলতে বামেদের ছিল পুলিশ আর আমলা। সেই পুঁজিও প্রায় নিঃশেষে তুলে নিল তৃণমূল। পুলিশ ও আমলাতন্ত্রে নিঃশর্ত ক্রীতদাস প্রথা চালুর যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সিপিএম রীতিমতো গবেষণা চালিয়ে তৈরি করেছিল--সেই রাজনৈতিক প্রথার উন্নততর সংস্কৃতি নিজেদের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে ফেলতে দেরি করে নি। যতক্ষণ ক্রীতদাস সংষ্কৃতি বজায় থাকবে ততদিন ক্ষমতাও হাতে থাকবে এ বিশ্বাস থেকেই বামপন্থীদের পতন সুনিশ্চিত হয়ে উঠলেও বাম নেতারা তা মানতে চান নি। ফলে তাঁরা আজ আক্ষরিক অর্থেই সর্বহারা হয়ে পড়েছেন। বিশেষ কেউ পোঁছেও না--খোঁজ খবরও নেয় না। নির্বাচনের দিনগুলিতে দেওয়াল লেখার জন্যে বা পোস্টার সাঁটার জন্যেও এখন কমরেডদের মধ্যে হুড়োহুড়ি তো দূরের কথা তাদের পাত্তাই পাওয়া যায় না। ফলে সিপিএম তথা বামনেতাদের এখন ফাঁকা বাগাড়ম্বর বা বুলি সর্বস্বতার মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণার চেষ্টা করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। সুতরাং রাজ্যরাজনীতিতে বামেদের এই স্রেফ বুলিসর্বস্বতার কারণে একটা বড়সড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে--যার অনেকটাই গিলে নিতে পারছে বিজেপি।
অন্যদিকে সাতের দশকের কংগ্রেস রাজনীতিতে যে দাপট প্রিয়-সুব্রত-নুরুল-মমতার ছিল সিদ্ধার্থ জমানার পর বামপন্থীদের প্রবল উত্থানের পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে কংগ্রেস হাইকমাণ্ড তথা সনিয়া-রাজীবের একটা পারস্পরিক নির্ভরতার রাজনীতি শুরু হয়। প্রকাশ্যে একে অপরকে দুরমুশ করার রাজনীতি চালিয়ে গেলেও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ছল-কপটতাকে সামনে রেখে দলীয় স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি চলতে থাকায় এ রাজ্যে বামেদের দাপট দিন দিন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে প্রদেশ কংগ্রেস তত নাবালকত্বতেই আটকে থাকার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রদেশ কংগ্রেসের এই নাবাকত্বের প্রতিবাদেই মমতাকে কংগ্রেস ছেড়ে অল-আউট সিপিএম বিরোধিতার পালে হাওয়া তুলতে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম দিলেন। তাঁকেও অনেক রক্ত-ঘাম ঝরাতে হয়েছে--শেষপর্যন্ত তিনি সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে ভেন্টিলেশনে পাঠাতে পেরেছেন। জ্যোতি বসুর কাল থেকে কংগ্রেস সেই যে আন্দোলনহীনতার প্রায় নিষ্ক্রিয় রাজনীতিতে ঢুকে গেল তা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারলো না। কংগ্রেসও তাদের হাইকমাণ্ডের সৌজন্যে এবং শাসনে বুলিসর্বস্ব একটি রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়ে গেল। এ রাজ্যে কংগ্রেসও যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকলো ততই তাদের অসংখ্য কর্মী ও নেতাদের একাংশের মনে হতে লাগলো এ রাজ্যে কংগ্রেসের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ফলে তারাও দল ছেড়ে দলে দলে নানান প্রলোভনের শিকার হয়ে তৃণমূল শিবিরে ঢুকে গেল। রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের তৈরি করা শূন্যস্থানে বেশ হিসেব কষেই বিজেপি ঢুকে যেতে পেরেছে। প্রকৃতিতে শূন্যস্থান বলে কিছু থাকে না। রাজ্যরাজনীতিতেও শুধুমাত্র তৃণমূল থাকবে--বাকিটা ইচ্ছেমতো যেমন খুশি কসরতের জন্যে ফাঁকা পড়ে থাকবে তা তো হওয়ার নয়--সুতরাং বিজেপি দ্রুত শেকড় ছড়াতে দেরি করে নি। তৃণমূলের সব কিছু গিলে খাওয়ার আগ্রাসী রাজনীতির দৌলতেই সিপিএম-কংগ্রেস কোমায় চলে যাওয়ার সুযোগে বিজেপি বিপুল ক্ষমতায় কেন্দ্রে গুছিয়ে বসতে না বসতেই এ রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের শূন্যস্থান এতটাই ভরাট হয়ে গেল যে, তৃণমূল নেত্রীকেও নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে কর্পোরেট ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে ডাকতে হলো অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য! প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শেই মনোনীত হবে দলের প্রার্থী--পালিত হবে রাজনৈতিক আচার আচরণ। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে--তৃণমূলের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে অনেকটাই উদ্বেগজনক। তার একটা বিশেষ কারণ
হলো--বাম-কংগ্রেস জোট। এ জোট শেষপর্যন্ত যদি ফলপ্রসূ হয় তাহলে বহু ক্ষেত্রেই ৫০-১০০ ভোট কেটে নেওয়ার কারণেই সমস্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছেই। তবু কি বিজেপি তৃণমূলকে বড়সড় ধাক্কা দিতে পারবে? আমার তা মনে হয় না। কেন মনে হয় না সেটাও বিশ্লেষণ করবো নিশ্চয়ই!
কোন মন্তব্য নেই