নববার্তা প্রসঙ্গের ব্যবস্থাপনায় পদ্মশ্রী ডাক্তারের সংবর্ধনা সভায় গুণীজনদের হাট
লাইফস্টাইল ঠিক
হলেই ষাট থেকে সত্তর শতাংশ ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব : ডা. রবি
কান্নান
মৃণাল সরকার, করিমগঞ্জ, ২৮ ফেব্রুয়ারি : ব্যক্তি বা নাগরিকের স্বাস্থ্যকর জীবনের উপর
রাষ্ট্রের প্রগতি যে কতটা নির্ভরশীল সেটা নিজের ভাষণেই বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
আমরা উন্নতশীল দেশের
নাগরিক, নিজেদের লাইফস্টাইলকে পাল্টে স্বাস্থ্যকর ব্যক্তিত্ব হতে পারলেই দেশটা উন্নত
রাষ্ট্র হয়ে উঠতে বেশিদিন লাগবে না, নিজের বক্তব্যে সেটাই বুঝিয়ে দিলেন সম্প্রতি
পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত ডা রবি কান্নান। কাছাড় ক্যান্সার হাসপাতালের অন্যতম রূপকার
ডা রবি কান্নান নিজেকে শুধু ডাক্তারি পেশাতেই সীমিত করে রাখেননি। তার অবিরত
তামাক বিরোধী অভিযান তাকে
বরাকের অন্যতম সমাজসংস্কারক
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলস্বরূপ আজ তিনি
পদ্মশ্রী। তাঁকে সম্মান
জানাতেই আজ প্রফুল্ল চন্দ্র দে গেস্ট হাউসে অর্থাৎ ডিএসএ কমপ্লেক্সের উপরতলায়
সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে
দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ এবং এতে সহয়োগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রেস ক্লাব করিমগঞ্জ।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ তথা
করিমগঞ্জ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তীর পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত
সভায় মুখ্য বক্তা ডা. রবি কান্নান তাঁর ভাষণে ক্যান্সার রোগের মূল কারণ এবং এর প্রতিকারের
বিভিন্ন উপায়ও বাতলে দেন। বলেন, তামাক, সুপারি গুটকা, মদ এসবই ক্যান্সারের উৎস। ভারতে একশো বছর
আগে যে ক্যান্সার রোগী শনাক্ত করা হয়েছে সেই ব্যক্তির ক্যান্সার হয়েছে তামাক থেকেই।
তামাক ভারতের খাদ্য তালিকায়
কোনোদিন ছিলনা, সেটা পর্তুগালরা চারশো বছর আগে ভারতে নিয়ে আসে। আজ অনেকেই এই নেশায় আক্রান্ত। উত্তরপূর্বঞ্চলে
ক্যান্সারের প্রবণতা ভারতের অন্যান্য স্থান থেকে বেশি। এর জন্য মোটেই জলবায়ু দায়ী নয়, দায়ী এখানকার
লাইফস্টাইল। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেন, ক্যান্সার হচ্ছে লাইফস্টাইল ডিজিজ এবং এটাও
ঠিক এই রোগ দুরারোগ্য নয়। ক্যান্সার রোগী ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে
যদিও ডায়বেটিস হাইপারটেনশন এসব রোগ একবার হলে আর রক্ষে নেই। কিন্তু মানুষ ক্যান্সারকে বেশি ভয় করে,
ডায়বেটিস বা হাইপারটেনশন এসবকে তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না। তামাক গুটকা, মদ এবং ফাস্টফুড এসবে অভ্যস্ত লোকের
ক্যন্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে তাই এসব নেশা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে সমাজের
প্রত্যেককে সচেতনতামূলক অভিযান চালানোর পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, বেশি করে লবণ খাওয়াও ঠিক নয়, আগে
চেন্নাইয়ে স্টমাক ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রচুর ছিল এমনকি জাপানেও স্টমাক বা
পেটের রোগী খুব বেশি থাকায় সেখানকার ডাক্তাররা গবেষণা করে কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন যে
এসবের মূলে লবণ। তাই যত কম
পরিমাণে লবণ খাওয়া দরকার। মেয়েদের স্তন ক্যান্সার খুব বেশি হয়, এমনকি আজকাল দেখা
যায় আট দশ বছরের শিশুকন্যারও মাসিক ধর্ম দেখা দেয়। এর মূল কারণ হচ্ছে খাদ্যাভাস। আজকাল ছোট ছোট বাচ্চারা ভারতীয় ট্রেডিশনাল
খাদ্য ছেড়ে ফাস্ট ফুডের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। শরীরচর্চার বদলে মোবাইল কম্পিউটর এসবে সময়
কাটায় বেশি, ফলে ইস্টজেন এর প্রভাবে মেনোপজ খুব তাড়াতাড়ি দেখা দেয়। এইধরনের লাইফস্টাইল পাল্টাতে না পারলেই বিপদ
আসন্ন বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি উপস্থিত সবাইকে ভারতীয় খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত হওয়ার পরামর্শ
দেওয়ার পাশাপাশি তামাক বিরোধী অভিযানে সকলের সহয়োগিতা কামনা করেন। উত্তর
করিমগঞ্জের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ তাঁর ভাষণে ডা রবি কান্নানকে পদ্মশ্রী
সম্মানলাভের জন্য সাধুবাদ জানান এবং বলেন, এই সম্মান প্রাপ্তি তাঁর দায়িত্বকে আরো
বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা কেউ ভাগ্য
বদলাতে পারিনা কিন্তু অভ্যেস তো বদলাতে পারি এবং অভ্যেস বদলাতে পারবে ভবিষ্যৎ
নিসন্দেহে ভালো হবে বলে মন্তব্য করেন বিধায়ক। সভার শুরুতে স্বাগতভাষণে আবিদুর
রহমান চৌধুরী ডা রবি কান্নানের সমাজ সংস্কারক ভূমিকার বেশ কটি উদাহরণ তুলে ধরে
বলেন, এই ব্যক্তির প্রেরণায় আজ অনেকেই নেশার কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। বিশিষ্ট
আইনজীবী আব্দুর রশিদ নিজেই একজন ক্যান্সার রোগী। আজ তিনি সভায় এসে তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধির কথাও তুলে
ধরলেন। করিমগঞ্জ জেলা
বিজেপির সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য তাঁর ভাষণে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানানোর
পাশাপাশি ডা রবি কান্নানের
বরাক উপত্যকার চিকিৎসাসেবায় অবদান এবং প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। এআইইউডিএফ-এর করিমগঞ্জ জেলা সভাপতি আজিজুর
রহমান তালুকদার সভায় ডা. রবি কান্নানকে চাদর দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বলেন, এরকম
আদর্শ চিকিৎসক আমাদের সমাজে দুর্লভ। আগামীদিনের চিকিৎসাসেবায় তিনি প্রেরণা হয়ে
থাকবেন। নিলামবাজার
কলেজের আসন্ন বার্ষিক উৎসবে বিশেষ অতিথি হিসেবে তিনি ডা. রবি কান্নানকে আমন্ত্রণও
জানান। জেলা কংগ্রেস
সভাপতি সতু রায় তার ভাষণে ডা. রবি কান্নানের দিকে বেশি কিছু প্রশ্ন করেন, এসব
প্রশ্নের সারমর্ম ছিল তামাক মদ এসব না খেলেও কেন ক্যান্সার হয়। এসব প্রশ্নের উত্তর নিজের ভাষণে উল্লেখ করেন
ডা. রবি কান্নান। প্রাসঙ্গিক
বক্তব্য রাখেন বার সংস্থার সভাপতি বলাই চক্রবর্তী, বিশিষ্ট সমাজসেবী শিক্ষিকা
লোপামুদ্রা চৌধুরী, প্রাক্তন বিধায়ক নিশীথ রঞ্জন দাস, ডা. মুস্তফা আহমদ, দীনদয়াল কলেজের
অধ্যক্ষা জয়শ্রী গোস্বামী, প্রেস ক্লাব করিমগঞ্জের সভাপতি মিহির দেবনাথ, সমাজসেবী
অপর্ণা দেব প্রমুখ। সভার সভাপতি
রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তী তাঁর বক্তব্যে ডা. রবি কান্নানের পরামর্শে লাইফস্টাইল
পাল্টে কিকরে সুস্থ্যজীবনযাপন করা যায় সেদিকে সবাইকে যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানান।
এদিনের সভায় খুদে শিল্পী প্রিয়াঙ্কা চৌধুরীর দুটি গান দর্শকদের মুগ্ধ করে তোলে।
শেষে ধন্যবাদসূচক বক্তব্য রাখেন মুজিবুর রহমান চৌধুরী। গোটা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা
করেন দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গের
সম্পাদক হবিবুর রহমান চৌধুরী। উল্লেখ্য, এদিন দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গের পক্ষ থেকে
ডা. রবি কান্নানকে সম্মানস্বরূপ একটি স্মারক, ফুলের তোড়া, চাদর এবং উপহার তুলে দেওয়া হয়। বিধায়ক কমলাক্ষ
দে পুরকায়স্থ ও প্রাক্তন পুরপতি কৃষ্ণ দাসও পৃথক পৃথকভাবে চাদর দিয়ে ডা. রবি
কান্নানকে সম্মান জানান।
কোন মন্তব্য নেই