Header Ads

ভাষা আন্দোলনের কালপঞ্জি !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ : তমদ্দুন মজলিশ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু? " নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী করা হয় । উল্লেখ্য সেই সময়ে সরকারী কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজিতে লেখা থাকতো ।

পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা হিসাবে অভিহিত করে এবং তারা পূর্ব-পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে "পাকিস্তানীকরণ", যেটি উর্দু এবং তাদের ভাষায় ইসলামিক, করার চেষ্টা চালাতে থাকে । তমদ্দুন মজলিশের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহবান করেন । সেই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশের অন্য সকল আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগারও তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
নভেম্বর ১৯৪৭ : পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত "পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে" পূর্ব - পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবী জানান ।
৭ নভেম্বর ১৯৪৭ : পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত।
১৭ নভেম্বর ১৯৪৭: পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে ঘোষণা দেওয়ার জন্য শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ।
ডিসেম্বর ১৯৪৭: শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগের বিপক্ষে ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ এবং মিছিল হয়। ৮ ডিসেম্বর একটি সমাবেশ হতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবী উত্থাপিত হয় । ডিসেম্বরের শেষের দিকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং তমদ্দুন মজলিশের আহবায়ক অধ্যাপক নুরুল হক ভুইয়া এর আহবায়ক নিযুক্ত হন।
১৯৪৮
জানুয়ারি ১৯৪৮ : পূর্ব পাকিস্তান স্টুডেন্টস লিগের জন্ম । এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান । পূর্ব পাকিস্তান ষ্টুডেন্টস লীগে ডান ও বামধারার ছাত্রনেতাদের একটি সম্মিলন হয় । উল্লেখ্য প্রতিষ্ঠাতাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম ছাত্রনেতা । এটি গঠনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগ সরকারের এন্টি বেঙ্গলী পলিসির বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা । স্টুডেন্টস লীগের উদ্যোগে জানুয়ারিতে ঢাকায় ৭ দিন ব্যাপী একটি ওয়ার্কার্স ক্যাম্প করা হয় যাতে মুসলিম লীগের বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি এবং বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা এবং সেই সুবাদে উর্দু অপেক্ষা নিচুস্তরের প্রমাণ করার জন্যে ধর্মের আড়ালে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছিল তার বিপক্ষে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ার কৌশল আলোচিত
হয় ।
২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ : কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত বাঙালি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পার্লামেন্টে প্রথমবারের মত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার জন্য একটি বিল আনেন । মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন । পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে এবং তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয় । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে না যেয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনী সহ বিলটি পুনরায় উত্থাপন করেন কিন্তু প্রতিবারই তা একই ভাগ্যবরণ করে।
৪-৭ মার্চ ১৯৪৮ : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠাকে সামনে রেখে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির শীর্ষমুখদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি। এই ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করে। ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে ১১ মার্চ ১৯৪৮ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
১১ মার্চ ১৯৪৮ : এইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবীতে একটি বড় সমাবেশ আয়োজন করা হয় । সমাবেশ শেষে বের হওয়া মিছিলে মুসলিম লীগ সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী হামলা চালায় এবং মিছিল থেকে শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, অলি আহাদ সহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৫ মার্চ ১৯৪৮ : মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান সফরের প্রাক্কালে বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি মোকাবেলায় খাজা নাজিমুদ্দিন ষ্টুডেন্টস একশন কমিটির সাথে একটি বৈঠকে বসেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার একটি অঙ্গীকারনামা সই করেন। পরবর্তীতে জিন্নাহ এই অঙ্গীকারনামা বাতিল করেন এবং উর্দু (যা ছিল ৫% মানুষের মাতৃভাষা) কে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। উপেক্ষিত হয় পাকিস্তানের প্রায় ৫০% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা।
২১ মার্চ - ১৯৪৮ : রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পূর্ব পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা"। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতার একাংশ সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে ওঠে। জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন।
২৪ মার্চ ১৯৪৮ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ "ষ্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং" শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি ক্যাটেগরিক্যালী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে বলেন "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে। তার মুল বক্তৃতা থেকে "The State language therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this sub-continent, a language understood throughout the length and breadth of Pakistan and above all a language which, more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries."
জিন্নাহর এই ব্ক্তব্য সমাবর্তন স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ছাত্ররা দাঁড়িয়ে "নো নো" বলে প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহর এই বাংলা বিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো বেশী গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
২৬ মার্চ ১৯৪৮ : জিন্নাহ ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বৈঠক করেন এবং বৈঠকে তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। সেই সাথে ১৫ই মার্চ ষ্টুডেন্টস একশন কমিটির সাথে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির অঙ্গীকারনামা বাতিল ঘোষণা করেন।
২৮ মার্চ ১৯৪৮ : ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক রেডিও ভাষণে জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করেন।
৬ এপ্রিল ১৯৪৮ : জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। উপায়ন্তর না দেখে খাজা নাজিমুদ্দিন East Bengal Legislative Assembly (EBLA) তে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা এবং ডাক টিকেট, ট্রেন টিকেট, স্কুল সহ সর্বত্র উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে একটি প্রস্তাব আনেন । যদিও এই প্রস্তাবের মুল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা তথাপি এই প্রস্তাবের ব্যাপারে তৎকালীন নেতৃবৃন্দ ইতিবাচক মনোভাব দেখান। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাবে কিছু সংশোধন প্রস্তাব করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে একটি সংশোধনী প্রস্তাব করেন। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী বাতিল করে খাজা নাজিমুদ্দিনের মূল প্রস্তাবটি প্রাদেশিক গণপরিষদে গৃহীত হয়।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ : মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন। এর পরপরই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং বাঙালি সংসদ সদস্যরা East Bengal Legislative Assembly (EBLA) তে গৃহীত প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য নাজিমুদ্দিনের কাছে দাবী জানান। নাজিমুদ্দিন পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পুনরায় তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন এবং ক্ষমতার স্বার্থে রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।
২৭ নভেম্বর ১৯৪৮ : পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পুনরায় দানা বাধে। লিয়াকত আলীর আগমন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি সমাবেশ আয়োজন করা হয় । সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যান্য দাবী দাওয়ার পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করা ও East Bengal Legislative Assembly (EBLA) তে গৃহীত প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন করার দাবীতে একটি দাবীনামা প্রস্তত করা হয় । দাবীনামাটি তৈরি করেন আব্দুর রহমান চৌধুরী (পরবর্তীতে বিচারপতি)। দাবীনামাটি পাঠ করার দায়িত্বটি ডাকসুর তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্টের উপর ন্যস্ত হলেও তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় স্টুডেন্টস একশন কমিটির নেতারা "বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা" হিসাবে প্রচার করার পাকিস্তানী চেষ্টার কারণে দাবীনামাটি পাঠের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন জি এস গোলাম আজমকে। দাবীনামা প্রস্তুতির সাথে জড়িত ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুবসহ স্টুডেন্টস একশন কমিটির নেতৃবৃন্দ । এই দাবীনামা প্রস্ততিতে গোলাম আজমের কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
উল্লেখ্য তৎকালীন সময়ে ডাকসুর ভিপি এবং জি এস সরকার কর্তৃক মনোনীত হতো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলির ছাত্র সংসদের ভিপি এবং জি এসরা এই দায়িত্ব পর্যায়ক্রমিকভাবে পালন করতো। গোলাম আজম ফজলুল হক মুসলিম হলের জি এস হিসাবে মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক ডাকসুর জি এস পদে মনোনয়ন লাভ করেন।
গোলাম আজম সমাবেশে দাবীনামাটি পাঠ করেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত দাবীটি এড়িয়ে যেয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত কয়েকটি দাবী মেনে নেন। রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত দাবীটি এড়িয়ে যাওয়ায় সমাবেশস্থলে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
গোলাম আজম রাজনৈতিক ভাবে মুসলিম লীগ সরকারের নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন । রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতে ডাকসুর জি এস পদের কারণে সমাবেশে দাবীনামা পাঠের মধ্যে দিয়েই গোলাম আজমের ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার অবসান হয় । এরপর থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত কোন আন্দোলনে গোলাম আজমের অংশগ্রহণ বা কোন ভূমিকা রাখার কথা কোথাও জানা যায়না।
১৯৪৯
৯ মার্চ ১৯৪৯ : পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে সরকারী কর্মকান্ড ও শিক্ষার একমাত্র ভাষা এবং সেই সাথে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার অব্যাহত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিনের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে আরবি হরফে প্রচলন করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুয়ানী বাংলা হরফ থেকে বাংলাকে মুক্ত করে ইসলামী ভাবাদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রচলন করা। এই লক্ষ্যে ৯ মার্চ ১৯৪৯ মৌলানা আকরাম খানকে চেয়ারম্যান করে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এই লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার একটি বড় আকারের তহবিল গঠন করে এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্লামেন্টে এর সপক্ষে বলেন "“The board is of the opinion that in the interest of national unity and solidarity and the rapid advancement of general education in Pakistan, it is necessary to have all the regional languages of Pakistan written in the same script; the Arabic script was most useful for this purpose…"
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ সকল ভাষাতত্ত্ববিদ আরবি হরফে বাংলা লেখার এই উদ্ভট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন কিন্তু তদসত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার তাদের মনোভাবের ব্যাপারে অনড় থাকে।
২৩ জুন ১৯৪৯ : পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গী, বিভিন্ন ন্যায্য দাবী দাওয়া পূরনে অস্বীকৃতি এবং ভাষার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ সরকারের নীতির বিরোধিতায় মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক (টাঙ্গাইল), শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও পীর মানকি শরীফ এর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই দুই দল একীভূত হয়ে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর আহবায়ক নিযুক্ত হন। ভাসানী ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ৮ বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন। পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আওয়ামী মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং রাজপথের আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি পার্লামেন্টেও রাষ্ট্রভাষা ভাষার দাবীতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।
১৯৫০
১১ মার্চ ১৯৫০ : কমিউনিষ্ট ভাবধারার ছাত্র নেতা আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় Dhaka University State Language Movement Committee। এই কমিটি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এপ্রিল ১৯৫০ : পার্লামেন্টে আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন দানা বেধে ওঠে।
সেপ্টেম্বর ১৯৫০ : পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের উপায় নির্ধারণের লক্ষ্যে গঠিত The Basic Principle Committee (BPC) of the National Constitutional Assembly পার্লামেন্টে রিপোর্ট প্রদান করে। এই রিপোর্টে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয় । বিপিসি এর এই রিপোর্ট পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আওয়ামী মুসলিম লীগ BPC রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পাশাপাশি অন্যান্য দাবী দাওয়ার রূপরেখা প্রণয়নের জন্য Grand National Convention (GNC) আহবান করেন।
১৪ নভেম্বর ১৯৫০ : পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবিদের সমন্বয়ে গঠিত Committee of Action for Democratic Federation ১৪ই নভেম্বর ১৯৫০ ঢাকায় আয়োজন করে Grand National Convention। GNC থেকে বাঙালিদের মুল দাবীগুলির পাশাপাশি উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
৭ ডিসেম্বর ১৯৫০ : মৌলানা আকরম খান এর নেতৃত্বে গঠিত ১৬ সদস্যবিশিষ্ট East Bengal Language Committee আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং উদ্ভট হিসাবে আখ্যায়িত করে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করে। এই কমিটি রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালত ও শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বতোভাবে বাংলা ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করে।
১০ ডিসেম্বর ১৯৫০ : মজলুম জননেতা ভাসানী জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পরপরই ভাসানী বিপিসি রিপোর্ট (যাতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল) প্রত্যাখ্যান করেন এবং Grand National Convention এ গৃহীত প্রস্তাবগুলি অবিলম্বে মেনে নেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারকে আহবান জানান।
১৯৫১
ফেব্রুয়ারী ১৯৫১ : পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের জন্ম। এই যুবলীগ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পাশাপাশি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া মুসলিম সংস্কৃতির পরিবর্তে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি যেমন পহেলা বৈশাখ, নবান্ন ইত্যাদি চর্চার ব্যাপারে উচ্চকন্ঠ ছিলো । যুবলীগ মুলত পাকিস্তানের প‌্যান-ইসলামিক মতবাদ থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ব-বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রে একটি কন্ঠস্বর হিসাবে নিজেদের পরিচিত করে।
১১ মার্চ ১৯৫১ : The Dhaka University State Language Movement Committee পূর্ব-বাংলার সকল পত্র পত্রিকায় এবং গণ পরিষদের সদস্যদের মাঝে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবীতে একটি স্মারকলিপি পাঠায় ।
২৭ মার্চ ১৯৫১ : পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী পুনরায় গণপরিষদেতে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবটি পেশ করে । এখানে উল্লেখ্য যে মৌলানা আকরম খান এর নেতৃত্বে গঠিত ১৬ সদস্যবিশিষ্ট East Bengal Language Committee আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং উদ্ভট হিসাবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করলেও সেই রিপোর্টকে সাধারণ জনগনের সামনে প্রকাশ করেনি পাকিস্তান সরকার । ততদিনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের এদেশীয় সদস্যদের মধ্যেও অনেকে বাংলার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছেন । এরকমই একজন হাবিবুল্লাহ বাহার এ্যাসেম্বলীতে এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন । হাবিবুল্লাহ বাহারের সাথে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাবকে পূর্ব-বাংলার জনগণকে শিক্ষা ক্ষেত্রে পঙ্গু করার জন্য একটি দূরভিসন্ধি হিসাবে অভিহিত করে এই প্রস্তাব বাতিল করার দাবী জানান । পূর্ব বাংলার সংসদ সদস্যদের একাংশের তীব্র বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি প্রত্যাহারে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার ।
জুলাই - ডিসেম্বর ১৯৫১ : এই সময়কালীন ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলো আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন The Dhaka University State Language Movement Committee । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পৃথক পৃথক সমাবেশ করে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবী জানানো হয় । এই সময়ের সমাবেশগুলিতে কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, গাজীউল হক প্রমুখ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ।
১৯৫২
২৬ জানুয়ারি ১৯৫২ : The Basic Principles Committee of the Constituent Assembly of Pakistan পুনরায় উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে এ্যাসেম্বলীতে চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করে ।
২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ : ঢাকা সফররত পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । সাথে সাথে সমাবেশস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শ্লোগান ওঠে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" । এই বক্তব্য সমগ্র পূর্ব - পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।
২৮ জানুয়ারি ১৯৫২ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে । এই সমাবেশ থেকে নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীপরিষদকে পশ্চিম পাকস্তানের হাতের পুতুল হিসাবে অভিহিত করা হয় ।
৩০ জানুয়ারি ১৯৫২ : খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য ভাষা আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দান করে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইদিন সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় ।
একই দিন মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় ভাসানীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি আওয়ামী মুসলিম লীগের সরাসরি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
৩১শে জানুয়ারি ১৯৫২ : ভাসানীর সভপতিত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলন থেকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় । সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে ।
৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : ছাত্রদের ডাকে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বত:স্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয় । ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবীতে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় একটি মিছিল নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে ।
১৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারী ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।
২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর উদ্যোগে আবুল হাশিম এর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ১৪৪ ধারা ভংগ করার ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সভার একটি বড় অংশ ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে মত দিলেও অনেকেই এতে সহিংসতার আশঙ্কায় বিপক্ষে মত দেন ।
২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সকাল ৯টা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত
শুরু ।
সকাল ১১ টা : কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু । সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় । আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করেন[। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন ।
বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা : উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন । এ অবস্থায় উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয় । এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে । গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মৃত্যু বরণ করেন । পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন মৃত্যু বরণ করেন । অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা
যায় । পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয় ।
বেলা ৪টা : ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে । গুলিবর্ষনের সংবাদ আইন পরিষদে পৌছালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ছয়জন আইন পরিষদ সদস্য আইন পরিষদ সভা মুলতবী করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্য মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে অনুরোধ করেন । সরকারী দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকন্ঠ হন কিন্তু নুরুল আমিন সকল দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন । রাতের বেলা ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটি মসজিদে ও ক্লাবে পরদিন সকালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হবার আহবান সম্বলিত লিফলেট বিলি করা হয় ।
২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : হাজার হাজার ছাত্র জনতা সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জড়ো হতে থাকে । উপস্থিত ছাত্র-জনতা ২১ ফেব্রুয়ারী নিহতদের স্মরণে কার্জন হল এলাকায় একটি জানাজা নামাজ আদায় করে এবং একটি শোকমিছিল বের করে । শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে শফিউর রহমানসহ চারজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করেন । উত্তেজিত জনতা রথখোলায় অবস্থিত সরকারপক্ষীয় পত্রিকা "দি মর্নিং নিউজ " এর অফিসে আগুণ ধরিয়ে দেয় । নুরুল আমিন পুলিশের পাশাপাশি আর্মি নামিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে । আর্মি ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা ভিক্টোরিয়া পার্ক (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক) এ জমায়েত হয় এবং সেখানে অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব ব্ক্তব্য রাখেন ।
উপায়ন্তর না দেখে নুরুল আমিন তড়িঘড়ি করে আইন পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়
২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে স্বত:স্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালিত হয় । এর আগের দিন আইন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব আনার পরেও নুরুল আমিনের পেটোয়া বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর দমন পীড়ন অব্যহত রাখে । সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৫ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় ।
২৩ ফেব্রুয়ারী রাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বরকত শহীদ হওয়ার স্থানে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান শুরু করে ।
২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : ভোর ৬টার সময় "শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের" নির্মানকাজ সমাপ্ত হয় এবং সকাল ১০টার দিকে শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির ফলক উন্মোচন করা হয় । নুরুল আমিনের সরকার রাজপথে সর্বত্র সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মোতায়েন করে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরিবেশ স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয় । এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেফতার করা হয় ।
২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : ছাত্র বিক্ষোভকে দমাতে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ।
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ : ২৬ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনার পুনরায় উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন[। সেই দিন বিকেলেই সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখে স্থাপিত "শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ" গুড়িয়ে দেয় । সরকারের দমন পীড়ন নীতিতে ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে কিন্তু ঢাকার বাইরে আন্দোলন দানা বাধে। এবার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পাশাপাশি বর্বর নুরুল আমিনের পদত্যাগের দাবী ওঠে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগের কাছ থেকে ।
৮ এপ্রিল ১৯৫২ : পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারীর ঘটনাকে পাকিস্তানের মুসলিম সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত করার লক্ষ্যে হিন্দু এবং কমিউনিস্টদের একটি চক্রান্ত হিসাবে অভিহিত করে । একই দিন প্রকাশিত একটি রিপোর্ট ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষনের ঘটনার কোন যুক্তিসংগত কারণ দেখাতে ব্যর্থ হয় ।
১৪ এপ্রিল ১৯৫২ : আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা ২১ ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেন এবং ২২ ফেব্রুয়ারী গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার ব্যাপারে দাবী উত্থাপন করলে আইন পরিষদে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় ।
১৬ এপ্রিল ১৯৫২ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খুলে দেয়া হয় ।
২৮ এপ্রিল ১৯৫২ : সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বার এসোসিয়েশন হলে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে বক্তারা মিছিল সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সকল বন্দীর মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণার দাবী জানান ।
১৯৫৩
২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৩ : ১৯৫২ এর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে হাজার হাজার জনতা অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে । সরকার সকল সভা সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করলেও ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ ছাত্র-জনতা খালি পায়ে স্মৃতিস্তম্ভের নিকট সমবেত হন । এই দিন পূর্ব পাকিস্তানের জনগন শোকের প্রতীক হিসাবে কালো ব্যাজ ধারণ করেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রাখা হয় ।
১৯৫৪
৩ এপ্রিল ১৯৫৪ : মাওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহণ করে । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব-বাংলার জনগণের যে জাগরণ শুরু হয় তার ফলেই প্রথমবারের মত মুসলিম লীগ বিতারিত হয় প্রাদেশিক সরকার হতে ।
৭ মে ১৯৫৪: যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে ।
১৯৫৫
৩ ডিসেম্বর ১৯৫৫ : ভাষা আন্দোলনের ছাত্র-জনতার অন্যতম দাবী বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ।
১৯৫৬
১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ : পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে তা সংবিধানের অন্তর্গত করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হয় ।
২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ : প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার কর্তৃক শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন । ১৯৬৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম কর্তৃক এই শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় ।
২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ : পাকিস্তান জাতীয় সংসদে বাংলা এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান পাশ করে ।
৩ মার্চ ১৯৫৬ : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান এইদিন থেকে কার্যকর হয় এবং ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন মজলিশের মাধ্যমে মায়ের ভাষায় কথা বলার যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল তার সাফল্য অর্জিত হয়

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.