Header Ads

‘দেহ পট সনে নট সকলি হারায়’--কিন্তু তিনি অনেক আগেই সব হারিয়েছিলেন !!

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায় 

মাত্র ৬১ বছর বয়স। ২২ বছর বয়সে তাঁর প্রথম ছবিতে (‘সাহেব’) তিনি যে চমক তৈরি করে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তা দেখে আমার মনে হয়েছিল--উত্তম-সৌমিত্রের পরে বাংলা সিনেমায় তিনিই লম্বা রেসের ঘোড়া হতে চলেছেন। প্রচুর বাণিজ্যসফল ছবি তিনি উপহার দিয়েছেন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গিয়েছিলেন। অভিনয়-ই যে তাঁর একমাত্র নিজের জায়গা--এটা হয়তো তিনি শেষপর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেন নি। পারলে তিনি রাজনীতির আলোয় নিজেকে আলোকিত করার আগে দু’বার ভাবতেন। তিনি ভাবেন নি। 


অভিনয় ছাড়া তাঁর আর কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিভা ছিল না। রাজনৈতিক প্রতিভা তো নয়-ই। অত্যন্ত নিম্ন মেধার রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি নিয়ে তিনি রাজনৈতিক মঞ্চে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতেই পারেন নি যে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তাঁর জনপ্রিয় ইমেজকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার জন্যেই তাকে রাজনৈতিক মঞ্চে তোলা হয়েছিল। জনপ্রিয়তার মধ্যগগণে তিনি রাজনৈতিক কেউকেটা হয়ে ওঠার স্বপ্নটাকেই ভয়ানকভাবে গুরুত্ব দিয়ে বসলেন। বহু ছবি হয় তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছে, না হয় তাঁর রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে প্রযোজকরাই পিছিয়ে গেছেন। ফলে ঐ সময়ে বাংলা সিনেমায় বেশ কিছু পাগলু মার্কা চকলেট বয় বাংলা সিনেমার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শকদের বাংলা ছবি বিমুখ করে তোলার সুযোগ পেয়েছেন।



ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও প্রসেনজিৎকে মহানায়ক তো দূরের কথা--তাপস পালের চেয়ে বড় অভিনেতা বলে মনে করি না। তাঁর হাতে গোাণা গোটাকয়েক ছবি ছাড়া বাকি ছবিগুলোর সঙ্গে যাত্রাপালার বিশেষ পার্থক্য আমি খুঁজে পাই নি। সুতরাং তাপস পাল রাজনৈতিক গ্যাস খেয়ে রাতারাতি যত ফুলেছেন ততই তিনি তাঁর আবাল্যের পরিচিত ঘনিষ্ঠ বলয় থেকে--এমন কী তাঁর নিজের মায়ের মমতার বৃত্ত থেকে তিনি নিজেই নিজের স্বেচ্ছা নির্বাসনকে তরান্বিত করেছেন। এক চমৎকার অভিনয় প্রতিভাকে মানুষ দ্রুত রাজনৈতিক ভাঁড় হয়ে উঠতে দেখছিল। রাজনৈতিক গ্যাস তাঁকে যতদূর সম্ভব নীতিহীন কটূভাষী এবং উদ্ধত বদমেজাজী এক ফানুস বানিয়ে তুলছিল। নিত্যনতুন নিজস্ব প্রতিভা উন্মোচনের জগত থেকে তাঁর পতন সুনিশ্চিত হচ্ছিল--কিন্তু তিনি তা অনুভবের জায়গায় ছিলেন না।
মর্মান্তিক এক পরিণতিকে তিনি যেভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন তাতে তাঁর আত্মহত্যার মানসিকতাই প্রকট হচ্ছিল প্রতিদিন। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন--এই রোগেই তাঁর মুত্যু হয়তো নির্ধারিতই ছিল--তাঁর জীবনের শেষ সময়টুকুর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাটাই প্রকট হয়েছে। কী নিদারুণ অবহেলা এবং রাজনৈতিক উপেক্ষা তাঁকে পেতে হল তা মানবিক বোধ সম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেই বুঝতে অসুবিধে হয় নি। এসব কিছুই হত না--তাঁর মৃত্যু ভীষণভাবেই সম্মানিত ও তীব্র শোকাহত হতেই পারতো--যদি না তিনি তাঁর নিজের জায়গা একেবারেই অসময়ে ছেড়ে দিয়ে রাজনৈতিক আলোয় নিজেকে মাখামাখি করার উন্মত্তায় হারিয়ে ফেলতেন!
খুবই খারাপ লাগছে তাঁর এই প্রায় নিঃশব্দ বিদায় পর্ব। কোথাও কেনো করতালি নেই--চোখের এক ফোঁটা জলও নেই--‘ব্রাভো ব্রাদার!’--এই উচ্চকিত উচ্চারণও নেই! সবকিছু হারালেন নিজেরই নির্বুদ্ধিতায়--কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বপ্ন তাড়নার কারণেই।--সাহেব, দাদার কীর্তি, ভালোবাসা ভালোবাসা, গুরুদক্ষিণা সহ বাংলা ছবির এক একটা মাইলস্টোনে নিজের নাম লিখে গেলেও নিজেকে নিন্দিত করে যাওয়ারও এক আশ্চর্য্য খাতায় স্বাক্ষর রেখে গেলেন--যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। তবু, এত কিছুর পরেও বাংলা ছবির সুস্থ দর্শক মানসে তিনি কোথাও না কোথাও থেকেই যাবেন!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.