গণভোট ও সিলেটের বাংলায় প্রত্যাবর্তন : অধ্যাপক সুবীর করের ‘শেষবিচার’
অধ্যাপক সুশান্ত কর
প্রয়াত অধ্যাপক সুবীর কর বছর তিনেক আগে তাঁর এই শেষ মূল্যবান গ্রন্থটি লিখে
গেছেন। তাঁর সবক’টি বইই অবশ্য পাঠ্য। কিন্তু ‘বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের
ইতিহাস’ বইটির মতোই এই শেষ বইটি যে বহুপাঠ্য হবে, সেই নিয়ে
সংশয় নেই। হওয়া দরকারও। শিলচরের সৃজন
গ্রাফিক্স বইটি প্রকাশ করেছিলেন ১৩২৩ বাংলাতে। দাম বেশ চড়া। আড়াইশ পৃষ্ঠার বইয়ের
মূল্য ৫০০/- শত টাকা। কিন্তু এহেন বইয়ের দাম তো আর কাগজে কালিতে ছাপাখানার পারিশ্রমিকে
নির্ধারিত হবার না। লেখকের অমানুষিক শ্রমের কথাটাও মনে রাখতে হবে। পুরো বইটির নাম
বেশ দীর্ঘ। সিলেট ও আসাম : ১৮৭৪-১৯৪৭/ গণভোট ও বাংলায় প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস। সংক্ষেপে প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সারির যে
কোনো একটি থাকলেও চলত।
বলা হয়ে থাকে, যে সিলেটের
চা-শ্রমিকের ভোটাধিকার বঞ্চিত করেই সিলেটের পাকিস্তানভুক্তি সম্ভব করা গেছিল। এই
নিয়ে অসম সরকার বা কংগ্রেস দলও বিশেষ তদ্বির করেনি। তিনি স্পষ্টই লিখেছেন,“ ১৯৪৬ সালের
নির্বাচনে একমাত্র শ্রীমঙ্গল আসনটি ছিল শ্রমিকদের জন্য সংরক্ষিত এবং ভোটারদের
সংখ্যা ছিল সর্বমোট ১১ হাজার ৪ শত ৪৯। এই আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন শ্রমিক নেতা জীবন
সাঁওতাল। সুতরাং তাদের সবগুলি ভোট আসামের পক্ষে গেলেও ফলাফলের কোনো হেরফের ঘটতো
না। তাছাড়া বাগানের সব ভোটই যে ‘হিন্দু কংগ্রেসি’দের পক্ষে যেতো তারও কোনো
নিশ্চয়তা ছিল না, কেননা শ্রমিকের সবাই হিন্দুও ছিল না” (পৃঃ ২৪০) ফলে হিন্দু
বা ‘অসম পক্ষে’র পরাজয় প্রায় নিশ্চিতই ছিল। এটি বোঝা যায়। কোন
পক্ষে কত ভোট পড়েছিল তারও একটি হিসেব দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, পুববাংলার
পক্ষে পড়েছে মুসলমান ভোটের ৭৬.৮৭ %। কিন্তু শতাংশের হিসেবে বিপক্ষে তথা অসম ভুক্তির পক্ষে পড়েছে হিন্দু এবং অন্যান্য-ভোটের বেশিটাই--- ৭৮.০৫%। তারপরেও পুববাংলা পক্ষ ৫৫
হাজারের বেশি ভোটে বিজয়ী হয়। তারমানে এই গণভোটে অসম পক্ষের পরাজয় একরকম
পূর্বনির্ধারিত ছিল। কোন পক্ষে সক্রিয়তা বেশি ছিল, কোন পক্ষে
প্রচার বেশি ছিল, কোন পক্ষে কতটা বাধা দিয়েছিল—এই সব বৃত্তান্ত তিনি বিস্তৃত
দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর তথ্যেই বোঝা যায়--- অসম ভুক্তির পক্ষে এর সব
পদ্ধতিকে কাজে লাগালেও কিছু বিশেষ হবার ছিল না। তায় যাদের বিশেষ শিক্ষা ছিল না, যারা খাজনা
দিতেন না সেরকম লোকের দুপক্ষেই ভোটাধিকার বলে কিছু ছিলই না। তাঁরা তাঁদের থেকে
সম্পন্নদের কর্মফলই এখনো ভোগ করছেন। বস্তুত এই সম্পন্নরাও অসম বাংলা-ভূগোলের তথা সর্বভারতীয় শাসক শ্রেণির বাকিদের রাজনীতির তোড়ে ভেসেই গেছিলেন বললে ভুল বলা হবে না। যেন নিয়তি
তাঁদের যেদিকে টেনে নিয়ে গেছে, তাঁরা সেদিকেই গেছেন। আর প্রবঞ্চনাটি বাকিদের ভেবে, এক বিষাদ-মিশ্রিত আত্মপ্রসাদ লাভ
করেছেন। এই সম্পন্ন শ্রেণিটিরই উত্তরসূরি লেখক স্বয়ং। ফলে তাঁরও বইটি কোনো ভবিষ্যৎ দৃষ্টি ছাড়াই শেষ হয়েছে ‘নিয়তি’র সামনে এক দীর্ঘশ্বাসে। শেষ কথাগুলো এরকম,“এবার চলছে লক্ষ লক্ষ বাঙালির নাগরিকত্ব হরণের
চূড়ান্ত আয়োজন। সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভাজিত বাঙালি এই পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম
কি না, আগামী ইতিহাসের কাছে গচ্ছিত রয়েছে সেই শেষ বিচারের নিদান।” সাদামাটা ভাবে, এ অনেকটাই
ভাগ্যনির্ভর সেই ব্যক্তির মতো শুনায়, যে বলে, “আছেন উপরওয়ালা। তিনি শেষবিচার
করবেন!” ‘সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভাজিত বাঙালি’ যে ‘এই পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ’ হবে না---এই
স্বীকৃতিটুকু শেষে আছে। বস্তুত আদিঅন্ত বইটিতে সেই স্বর এবং সুর দেবার প্রয়াস
আছে। মোটা দাগে আমরা তাঁকে চিরদিনই
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী শিবিরের লোক ভেবে এবং জেনে এসেছি। বছর দুই আগে শিলচরে
রাজ্যপাল তথাগত রায়ের একটি বই উন্মোচনী সভাতে, হিন্দু বাঙালির জন্যে তাঁর হাহাকার শুনে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? এমন করে ভাবলে কি খুব অন্যায় হবে যে এই বইটি সহ
আগেকার লেখালেখিতেও যে ‘সাম্প্রদায়িক’তা তাঁর মনে চাপা ছিল, ঘটনাচক্রে
তথাগত রায়ের বই উন্মোচনী সভাতে তা প্রকাশ্যে এসে গেছিল? না, আমরা
ব্যক্তি সুবীর করের কথা লিখছি না। আমরা অসমিয়া লেখক বুদ্ধিজীবীদের ‘উগ্রজাতীয়তাবাদে’র কথা বলি তো? মুসলমান
লেখক বুদ্ধিজীবীদের কথাও বলি। এই বইতেই আছে, তাঁরা কেমন সিলেটের পাকিস্তান
ভুক্তির পক্ষে সরব ছিলেন। তাদের কথা তো সগোত্রীয়রাও বলেন, দরকারি
সমালোচনাও করেন। অসমে অসমিয়ারা করেন, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে
মুসলমানেরা করেন। পশ্চিম বাংলাতেও দেখেছি, সগোত্রীয়দের
দ্বারা সমালোচিত হতে। জয়া চ্যাটার্জি যেভাবে বাঙালি ‘ভদ্রলোক সংস্কৃতি’র ব্যাখ্যা করেছেন, ‘ভদ্রলোকে’দের সাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যা
নথি সহ করেছেন, বা করেছেন বহু আগেই বিনয় ঘোষেরাও-- সেসব অসমেও করবার জন্যেই করা
নয়, নিয়তির অভিশাপ থেকে বেরোবার জন্যেও দরকার বলেই আমাদের মনে হয় । স্বয়ং তথা স্বজাতির আত্মসমালোচনা ছাড়া শুদ্ধির পথ কী, যদি
সিদ্ধিতে পৌছুতে হয়? কিন্তু এহেন আত্মসমালোচনাকে বহু ‘উদারপন্থীরা’ও নাম দেন-- পর-সম্প্রদায়কে খুশ করবার রাজনীতি— সংক্ষেপে খাটো করেন ‘তোষামোদ’ নামে।
সুবীর কর রিচার্ড ঈটন পড়েছেন। (পৃঃ১০) সবটা স্বীকার করেছেন বলে মনে
হলো না। করলে ‘হয় কোরাণ গ্রহণ করো, নয় তো
মৃত্যু বরণ করো’ ধরণের
ইতিহাসকে বিশেষ প্রশ্রয় দিতেন না। (পৃঃ ৯) অচ্যুতচরণ
চৌধুরীর সিলেটের ইতিবৃত্তের সাম্প্রতিক ‘কথা’ সংস্করণে
অধ্যাপক সুবীর করের কিছু স্পর্শ আছে। সেই বইতে অচ্যুতচরণ চৌধুরীকেও দেখিনি সেরকম
কোনো তত্ত্ব যোগাতে। আর জয়া চ্যাটার্জি
পড়লে তো রিজলে অনুসরণ করে, এমনটা লিখতেও দু’বার ভাবতেন। কারণ সচেতন হয়ে
যেতেন আধুনিক বাঙালির ‘ভদ্রলোক সংস্কৃতি’র সম্পর্কে। তাঁকে আমরা মোটের
উপরে ‘বামপন্থী’ই জেনে এসেছি। এই বইতেও কমিউনিস্টদের ভূমিকার
উজ্জ্বল সব নথি যুগিয়েছেন। কেবল এক জায়গাতে লিখেছেন, ক্যাবিনেট
মিশনের সামনে,“...কম্যুনিস্ট পার্টি লিগের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে
স্বাধীন স্বতন্ত্র পাকিস্তানের দাবির পক্ষে ওকালতি করল।” বিপরীতে
শ্যামাপ্রসাদের এবং সুভাষ বসুর নাম পরপর বেশ সপ্রশংস উল্লেখিত হয়েছে, অবিভাজিত
ভারতের পক্ষে। আমাদের কাছে এর পালটা তথ্য
আছে, কম্যুনিস্ট পার্টি গ্রুপিং ব্যবস্থার সমর্থন জানিয়ে, গ্রুপ
সংখ্যা বাড়াবার প্রস্তাব করেছিল। অমলেন্দু গুহের ‘প্লেন্টার্স রাজ টু স্বরাজ’ বইতে
স্মারকপত্রটিই তুলে দেওয়া আছে। আর গ্রুপিং ব্যবস্থার কে বা না সমর্থন করেছিল? বাংলা
কংগ্রেস থেকেও বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে করেছিল সিলেট কংগ্রেস—এই তথ্য সুবীর করই
যুগিয়েছেন। (পৃঃ ১৪৩) অধ্যাপক
সুবীর করের ডানে বামে দুই নৌকাতে পা রাখবার ভালো নজির এই কথাগুলো, “ কলকাতা
নোয়াখালির দাঙ্গার আগে পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দেশভাগের
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘we were not just willing to entertain any
proposal to partition India... যখন পূর্ববাংলার মুসলমানদের জন্যে পাকিস্তান
অনিবার্য হয়ে দেখা দিল তখন পশ্চিমবাংলার হিন্দুদের স্বার্থে শ্যামাপ্রসাদ বাংলাবিভাগ মেনে নিলেন। তাছাড়া
১৯৪৬-৪৭এর সাম্প্রদায়িক ঘটনাপ্রবাহের চাপে বাধ্য হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকেও সেসময়
দেশভাগ মেনে নিতে হল।” (পৃঃ ২২৯) কম্যুনিস্টদের আহামরি সামাজিক
ভিত্তি ছিল না, ফলে তাঁদের সম্পর্কে ‘বাধ্যহয়ে’ কথাটি খাটে।
তবু প্রশ্ন -- আগে ‘ওকালতি’ শব্দের ব্যবহার কেন? কিন্তু, শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে সেই কথা
খাটে না। তাঁর অখণ্ড-ভারত চিন্তার মধ্যে হিন্দু আধিপত্যের অতিরিক্ত কোনো
ভাবনা ছিল না বলেই, ‘হিন্দুদের স্বার্থে’ অবস্থান
নিতে হয়েছিল। সাম্প্রতিক গবেষণাতে আমরা জানি, শ্যামাপ্রসাদ
সে সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করতেন সেই হিন্দু মহাসভা মুসলিম লিগেরও আগে থেকে দেশভাগের পরিকল্পনা করছিল।
এবং পরিকল্পনা এমন ছিল যেন দায়টা লিগের উপরেই বর্তায়। সেই সব কথা তো বহু আগেই
অধ্যাপক সুজিৎ চৌধুরীর বহুপঠিত প্রবন্ধ ‘ধর্ম, রাজনীতি ও
সাম্প্রদায়িকতা—উৎস ও পটভূমিতে’ই উল্লেখ ছিল। (প্রবন্ধ
একাদশ, সম্পাদনা জয়দীপ বিশ্বাস, পৃঃ ০৯) অধ্যাপক সুবীর করের সেই সব
পড়া -- আমরা নিশ্চিত হয়েই দাবি করতে পারি। আর সাম্প্রতিক জয়া চ্যাটার্জি, শেখর
বন্দ্যোপাধ্যায়দের গবেষণাগুলোর কথা উল্লেখ করাই বাহুল্য। আর হিন্দু মহাসভার
প্রতিপত্তি এতোটাই ছিল যে বসুভাইদের কংগ্রেস থেকে বিদায়ের পরে , বাংলা
কংগ্রেসের যে নেতাদের ভূমিকার কথা বিশেষ হয় না, তাদের
অধিকাংশ ভারত-ছাড়ো আন্দোলনের দিনগুলোতে পুলিশের মার থেকে
আত্মরক্ষার জন্যে ব্রিটিশের যুদ্ধ-সহযোগী হিন্দু মহাসভাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যুদ্ধ
যেতেই ফিরে এসেছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ কেবল আসেননি, এই মাত্র।
ফলে শ্যামাপ্রসাদ যা করলেন একার কৃতিত্বে করেন নি। গোটা দেশীয় শাসকশ্রেণি তাঁর
সঙ্গে ছিল।
আমরা তাঁর ‘নিয়তির সামনে এক দীর্ঘশ্বাসে’র কথা লিখছিলাম। সিলেটের অসম
ভুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে যারা গণভোটে কাজ করেছিলেন তিনি তাঁদের কিছু
নামের এক তালিকা দিয়েছেন। (পৃঃ ২০৬) পক্ষে যাদের নাম দিয়েছেন, দেখা যাবে
কিছু মুসলমান এবং চা-শ্রমিক বা দেশওয়ালি নাম বাদ দিলে যেসব বাঙালি হিন্দু
নাম রয়েছে, অধিকাংশই বাঙালি বর্ণহিন্দু –সেন, কর, ঘোষ, দত্ত, দাশ, ভট্টাচার্য ইত্যাদি। তপশীলিদের অধিকাংশকেও যে এরা সঙ্গে টানতে পারেন নি, এখন সবার
জানা। সারা বাংলাতেই যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এবং অনুসারীরা পাকিস্তান সমর্থন করাতে
বর্ণবাদীদের কাছে ‘বেইমান’ আখ্যা পেয়েছিলেন। সুবীর কর
কিন্তু সহানুভূতির সঙ্গে তাঁদের সমস্যাটি ধরেছেন। কী লিখেছেন, আমরা ভূমিকার
থেকে পুরোটাই তুলে দিচ্ছি, “লিগের সঙ্গে তপশিলী সম্প্রদায়ের যোগ আর যোগেন্দ্রনাথ
মণ্ডলের নেতৃত্বে দল বেঁধে সবাই পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়ে হিন্দু জাতির প্রতি
তাঁরা বেইমানি করেছেন, এই ব্যাপক প্রচারের মধ্যে সত্যিই কোনো যুক্তিসঙ্গত
কারণ ছিল কি না, তার প্রতি একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। মনে রাখা প্রয়োজন
যে, এই প্রচারটির মূলে ছিল বর্ণবাদী ও সুবিধাভোগী মধ্যবর্গীয় হিন্দু সমাজ, যাদের হাতে
ছিল ক্ষমতার চাবিকাঠি আর সামাজিক চাবুক। বিশিষ্ট গান্ধীপন্থী নেত্রী সুহাসিনী
দাসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়, গণভোটকালে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয়দের
রাজনৈতিক অপর পাঠটি ছিল এরকম, ‘আমরা তপশিলী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতের পক্ষে
দাঁড়ানোর জন্যে অনেকভাবে মিলিত হয়েছি, কিন্তু তাঁদের সম্মতি আদায়
করতে ব্যর্থ হয়েছি।’ এর কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, “শতাব্দীর পর
শতাব্দী ধরে বর্ণহিন্দুদের দৌরাত্ম্য ও অত্যাচারের ফল হিসেবেই তাঁরা বর্ণবাদী
হিন্দু কংগ্রেসীর আহ্বানে সাড়া দেয় নি। ... শুধু তাই নয়, সুনামগঞ্জে
তপশিলী সম্প্রদায়ের লোকদের সপক্ষে টেনে আনবার জন্য শেষ পর্যন্ত, উচ্চবর্ণের
হিন্দুরা স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য, শুচি-অশুচিভেদে সামাজিকভাবে এক
ভোজসভার আয়োজন করেন। সবাই যখন পাত পেতে আহার গ্রহণে বসেছেন তখন তপশিলীদের নেতা
দ্বারিকানাথ বারৈ সেখানে উপস্থিত হয়ে সবাইকে ভোজ বয়কটের আহ্বান জানিয়ে বললেন, এ খাদ্য নয়, এ বিষ। কেউ তা গ্রহণ করবে না।
---ভেস্তে গেল আয়োজন।”(পৃঃ৩৭) এই ‘যাদের হাতে ছিল ক্ষমতার
চাবিকাঠি আর সামাজিক চাবুক’ ‘তাদেরই দৌরাত্ম্য ও অত্যাচারের ফল হিসেবেই’ যে
মুসলমানেরাও খুব বেশি সাড়া দেন নি, সিলেট আলগা করে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে চাইলেন ভাবতে
কি কোনো অসুবিধে আছে? এমন ভাবনা কি আমরা কখনো ভাবলাম? একেবারেই ভাবেন নি, নয়। ঐতিহাসিকের স্বীকারোক্তিটি আছে। (পৃঃ ১৩৬) কিন্তু
সুবীর করের ভাষা মূলত এরকম, “ ইতিহাসের কালচক্রে দেশভাগের সঙ্গে অনিবার্য হয়ে দেখা
দিল সিলেট –গণভোট। সিলেটের বাংলায় প্রত্যাবর্তন, না কি আসামে স্থিতি? এর মীমাংসায়
উত্তাল জেলাজুড়ে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার মধ্যে মসজিদে মসজিদে জেগে উঠল ধর্মের নামে
জিগির আর হিন্দুদের মধ্যে ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে সংকীর্তন, মন্দিরে
মন্দিরে আরাধনা ও প্রার্থনা।” (পৃঃ ১৮৪) দাঁড়ালো কী? ‘ধর্মের নামে
জিগির’টা হিন্দু তরফে নয়,ওটা মুসলমানের দায়। সেই হিন্দু, যাদের হাতে
ছিল ‘‘যাদের হাতে ছিল ক্ষমতার চাবিকাঠি আর সামাজিক চাবুক।” সেই চাবুক
এখনো রয়েছে বলেই এদের প্রসঙ্গে লেখা যাবে না ‘ধর্মের নামে জিগির’---যদি আমরা
লিখি, খুব কি অন্যায় লেখা হবে? আরো আছে।
করিমগঞ্জ জেলার দিন দুই পরে ভারতে প্রবেশ নিশ্চিত হয়েছিল। সেই দুইদিনে পাকপন্থী
কিছু মুসলমান প্রায় হিন্দু তাড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সব তিনি
হয়তো সঠিকভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু যখন লেখেন, “ বিস্ময়কর
ব্যাপার হল, করিমগঞ্জকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করবার দাবিতে একটি আন্দোলনের ধারা
সাম্প্রতিককালেও বহমান আছে।” (পৃঃ ২৪২) এর সপক্ষে কিন্তু তিনি কোনো
তথ্য যোগাননি। এমন একটি বাগধারা করিমগঞ্জ
শহুরে বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্তের একাংশের মুখে বহুদিন ধরে প্রচলিত আছে। প্রয়াত সুজিৎ
চৌধুরীর বাকি পরিবার যখন করিমগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে চলে যান, তখনো
পরিবারের এক সদস্য কাগজে প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার সার কথা এই যে একদিনে
অসমিয়া জাতীয়তাবাদী আর দিকে মুসলমান মৌলবাদীদের দাপটে করিমগঞ্জ তথা বরাক-উপত্যকা আর বাসযোগ্য হয়ে
থাকেনি। এহেন বাগধারা নিয়ে কোনো তর্কই বৃথা। কিন্তু ইতিহাসের বইতেও ঠাই পেলে, বই এবং লেখকের
সঙ্গে একই সামাজিক শ্রেণি তথা গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে আমাদের লজ্জা রাখবার ঠাই থাকে না।
একই স্বর একষট্টির ভাষা আন্দোলনেও ছিল, এর সমর্থন তত্ত্ব তাঁর বই ‘বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের
ইতিহাস’ -তেও আছে। সমস্যা হচ্ছে, সেই বইখানারও স্বর ছিল একই। আমরা আপাতত এর পক্ষে তথ্য দিয়ে এই লেখাকে ভারি
করতে চাইছি না। যে কেউ আমাদের প্রত্যাহ্বানও জানাতে পারেন, প্রতিবাদও
করতে পারেন। কিন্তু তাতে করে ‘সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজিত বাঙালি এই পরীক্ষাতে
উত্তীর্ণ হতে’ পারবে না। কেবল স্বর পাল্টালেই পারবে আমরা তাও বলি
না। সিলেট বিভাজনের হাহাকারটিই ছাড়তে হবে। সেটি ‘অনিবার্য ছিল’, ‘অপ্রতিরোধ্য’ ছিল –সেসব কথা তিনি বারে বারে
লিখেছেন। কিন্তু যা লেখেননি, বিকল্পটি কী ছিল, যা পরেও
ভাবা যেতে পারত, এখনো পারা যায়। দায়বদ্ধ এক ঐতিহাসিকের থেকে আমরা
সেটি আশা করি।
আজকের অসমে বাঙালির দুর্বিপাকের জন্যে জন্যে মুসলমান প্রধান ভূমিকা এর জন্যে
পালন করে না যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রাদেশিক স্তরেও তাঁদের হাতে নেই। দেশীয়
স্তরে তো প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং মুসলমানের জন্যে সিলেট ভাগ হলো বলে কারো বিরুদ্ধে
লড়বার কিছু নেই। লড়ে বাস্তবতা পাল্টাবারও নেই। ‘নাগরিক বিল’ কেন্দ্রীক
রাজনীতিতে সম্ভবত সেটি স্পষ্ট হলো। সিলেট বিভাজন যদি অসমে কারো ক্ষমতার ভিতকে
শক্তিশালী করেছে, তবে সে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শাসক শ্রেণি। তাঁদের
বিরুদ্ধেও আক্ষেপ প্রকাশের জন্যে সিলেট বিভাজনের ব্যথাকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিন্তু তাতেও প্রতিপক্ষ হারবার নয়। স্বপক্ষের ভাগ্যবদলেরও এভাবে সম্ভাবনা নেই। লেখকের মতো ‘শেষবিচারের নিদান’ তথা
কেয়ামতের বিচারের জন্যে বসে থাকতেই তো হবে।
সিলেট বিভাজন ছিল শেষ বিকল্প। এবং খুব দ্রুত নেওয়া সিদ্ধান্ত। তার আগে অব্দি
কোনো সিলেটিই অসমে থাকতে চাইছিলেন না। কাছাড়িরাও। অবৈরি হলেও সিলেটি-কাছাড়ি দ্বন্দ্বের কথাও
বইটিতেই আছে। মুসলমানের একাংশ যদিও বা থাকতে চাইছিলেন, বর্ণহিন্দু
তো মোটেও না। তাঁরা বাংলাতেই ফিরে যেতে চাইছিলেন। সেই ফিরে যাবার প্রয়াসের দীর্ঘ
ইতিহাস আছে। পাকিস্তান প্রয়াসের সময়েও প্রয়াসটি জারি ছিল। আমরা লিখেছি, সিলেট
কংগ্রেসে ক্যাবিনেট মিশন, এবং সেটিও ব্যর্থ হলে অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবের
পক্ষেও কেউ কেউ দাঁড়িয়েছিলেন। ভূমিকাতেই সুবীর কর ঠিক এই ভাষাতেই তথ্যটি হাজির
করেছেন, “ ...সিলেটের যেসব হিন্দু নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় বাংলায় সংযুক্তির দাবি নিয়ে প্রায়
সত্তর বছর ধরে আন্দোলন করে এসেছেন, তাঁরা ও তাঁদের উত্তরসূরিরা এবং প্রাদেশিক মুসলিম
লিগ অনড় হয়ে থাকল খ-বিভাগে (জিন্নাহ প্রস্তাবিত
পূর্বপাকিস্তানে) যুক্ত হবার জন্যে। সিলেট জেলা কংগ্রেস মিশন
পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে ভাষা এবং সংস্কৃতিগত ঐক্যভিত্তিকে (territorial
re-distribution on linguistic basis) সামনে রেখে অবিভক্ত বাংলায় যোগদানের প্রস্তাব গ্রহণ করে সিলেটের সঙ্গে কাছাড় ও
গোয়ালপাড়ার ভাগ্য নির্ধারণেও সিদ্ধান্ত নিলেন। সিলেটের এই অবস্থানের বিরোধিতা
করলেন কাছাড়ের কংগ্রেসি সদস্যরা...।” পরের সত্তর বছরে যেখানে অসমিয়া
আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দু মুসলমান ঐক্য একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা
হিসেবে রয়েছে, নাগরিকত্ব প্রশ্নেও এক হতে পারছে না---সেখানে ‘কী এমন যাদু ছিল মিশন
পরিকল্পনা’-তে আরেকবার কি ভাবতে নেই? সেটি ব্যর্থ হলে, তবেই তো পাকিস্তান, তবেই তো
সিলেট বিভাজন!
মিশন পরিকল্পনা তিনি সংক্ষেপে দিয়েছেন। (পৃঃ ১৫৪)যে কোনো ইতিহাসের বইতে এটি
সহজলভ্য, আমরা সেখান থেকে পুরোটাই উদ্ধার করতে পারি। দরকার নেই। আমরা যেখানে জোর দিতে
পারি, সেটি হলো এতে যে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল, তাতে
ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের কথা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকত সুরক্ষা, যোগাযোগ ও
বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়াদি। তার মানে বাকি সবই থাকত প্রস্তাবিত ক, খ, গ বিভাগের (গ্রুপ) হাতে।
বিভাগগুলোকে আর ভাষাতে বলা চলে প্রদেশগুচ্ছ। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের কথা ছিল, সংবিধান
রচিত না হওয়া অব্দি, সব রাজনৈতিক দল নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা
ছিল। এহ বাহ্য! যেটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা এই যে প্রদেশগুলো
দরকার বোধ করলে নিজেদের ইচ্ছেমতো সংবিধান তৈরি করতে পারত। এর চাইতে বেশি
গণতান্ত্রিক পরিকল্পনা তো নেপাল বাদে গোটা
ভারতীয় উপমহাদেশে এর আগে বা পরে ভাবা হয় নি। আগে না হয় ভাববার সুযোগ এবং শিক্ষা
ছিল না। পরে কেন কার স্বার্থে ভাবা হলো না, সেই প্রশ্ন করা যাবে না? অতি
সম্প্রতি যেভাবে দীর্ঘ আলোচনার পরে গণভোটে নেপাল নিজেদের সংবিধান তৈরি করল, আমরা তো
সেরকম করতে পারতাম? তখন পারিনি, পরেও তো কথাটি তুলতে পারতাম---যখন
হিন্দুস্তান-পাকিস্তান বিতর্ক শেষ হতেই---ওদিকে পুব- পশ্চিম পাকিস্তানের তর্ক
প্রবল হলো, কিংবা এদিকে ভাষা ভিত্তিক প্রদেশ নিয়ে এতো বিরোধ তৈরি হলো যে ব্রিটিষের ছেড়ে
যাওয়া অসম ভেঙে খানখান হলো । সেই বিরোধ, সেই
প্রক্রিয়া এখনো বহমান। তখন না হয় তিনটি গ্রুপের কথাই হয়েছিল---পরে গ্রুপ
সংখ্যা দরকারে ত্রিশখানাতে নিয়ে যেতে আমাদের আটকাতো কে? যদি জনতার
স্বার্থে সিদ্ধান্ত হতে থাকত। আমরা দেশীয় শাসকশ্রেণির স্বার্থে কেন্দ্রীভূত
রাষ্ট্রের ধারণাতে এতো অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যে কাশ্মীরের স্বতন্ত্র
সংবিধান আছে জানলেও আমাদের ‘দেশপ্রেমে’ ঘা লাগে। অথচ, ক্যাবিনেট
মিশন পরিকল্পনার বিস্তার ঘটালে, অসমেরও একখানা স্বতন্ত্র সংবিধান থাকত, আলফার
দরকারই পড়ত না। কে জানে, এদ্দিনে
সিলেটেরও একখানা থাকত হয়তো বা। অথবা, বাংলার। এখনো তো এমন এক বিকেন্দ্রীভূত
ভারত তথা অসমের কথা ভাবাই যায়। এখনো সব দ্বন্দ্বের মূলে তো সেই শ্রেণি এবং
জনগোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই। এমন কি সাম্প্রতিক হাইলাকান্দির
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনারও। আমরা ‘দেশভাগে’র সাম্প্রদায়কতাকে মেনে নিয়েছি, ক্যাবিনেট
মিশনের ‘অখণ্ডভারতে’র ‘সাম্প্রদায়িকতা’কে বর্জনই করিনি, দেশভাগের
রাজনীতিরই এখনো বিস্তার ঘটিয়ে চলেছি। তা নাহলে বাংলাতেও এন আর সি-র কথা উঠছে কেন?
ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব ব্যর্থ হলে অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব সামনে আসে। বহু বাংলাদেশীরা আজও দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধ এরই ধারাবাহিকতা। এর বীজ কিছু রোপণ
করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৩এর বাংলা চুক্তিতে। সেখানেও জনসংখ্যানুপাতে হিন্দু মুসলমান, তপশিলীজাতি
এবং বর্ণহিন্দুর জন্যে আসন সংরক্ষণ, সম্প্রদায়ভিত্তিক পৃথক নির্বাচন মণ্ডলীর কথা ছিল।
কথা ছিল হিন্দু মুসলমান সমান প্রতিনিধিত্ব নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের। মুখ্যমন্ত্রী হবেন মুসলমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
হবেন হিন্দু। ১৬ জন মুসলমান, ১৪জন হিন্দু সদস্য নিয়ে তৈরি হবে সংবিধান পরিষদ। সেনা এবং পুলিশে হিন্দু মুসলমানের সমান নিয়োগের
কথা ছিল। দুই চারটি ‘উগ্রজাতীয়তাবাদী’ অবস্থান ছিল---যেমন সরকারি
চাকরিতে কেবল বাঙালিদের নিয়োগ করা হবে। মনে হয় ‘অসমিয়া’দের মতো ভেবে নেওয়া হয়েছিল, বাংলার
বাসিন্দা মাত্রেই বাঙালি, মণিপুরি , চাকমারাও। এই মানসিকতা নিয়ে কি
ব্রিটিশ অসমের গোয়ালপাড়াকে বাংলাতে নেওয়া যায়? যায় নি, তবু
ত্রুটিটি পরে শুধরে নেওয়া যেতে পারত।
তখন না হয় অস্বাভাবিক রাজনৈতিক দ্রুতিতে এসবের কিছুই হয়ে উঠল না। সুবীর কর
লিখেছেন, “অখণ্ড বাংলার “এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সুরমা উপত্যকায় যেমন কৌতূহল
ছিল তেমনি বিভ্রান্তিও ছিল” (পৃঃ ১৭৫) এই ‘কৌতূহল’ এবং ‘বিভ্রান্তি’র তখন বাস্তবতাও ছিল। কিন্তু
এরপরে যা হলো তার কিছুই কি ভালো হলো? অসমে এবং
পুবপাকিস্তানে দেশভাগের পরে পরেই শুরু হলো গণহত্যার রাজনীতি। ৫০ ইংরাজিতে অসম এবং
পুব পাকিস্তান দুইই আহত হলো রাষ্ট্র প্ররোচিত ব্যাপক জাতিদাঙ্গাতে। মুক্তিযুদ্ধ
পরবর্তী বাংলাদেশ থেকেও সংখ্যালঘু তাড়ানো চলছে কি না—এই নিয়ে এখনো চলছে বিতর্ক। কিন্তু
অসমে ‘বাংলাদেশী’ তাড়ানো চলছে আইনি এবং বেআইনি দুই প্রক্রিয়াতেই। এই নিয়ে বাংলাদেশের মতো কোনো বিতর্ক করবারও অবকাশ নেই। স্বদেশীদের বিদেশী করে
ফললেও প্রশ্ন করবার সাহস করতে পারছেন না বাঙালি, প্রতিরোধ তো
দূরেই থাক। কিন্তু এখনো সেই বিভ্রান্তি
গেল না। এখনো মনে করা হয় এই সব সম্প্রদায় ভিত্তিক সংরক্ষণ, পৃথক
নির্বাচক মণ্ডলী ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক ভাবনা। সাম্প্রদায়িকতার শিকার বাঙালিই এমনটা
ভাবেন, অন্যে কী কথা? অসমে বাঙালি তাড়া খায়, না দেখে
কিছু হিন্দুত্ববাঙালির রাতে ঘুম হয় না এই ভেবে—যে বাংলাদেশে কত হিন্দু তাড়া
খাচ্ছে! স্বাভাবিকভাবেই ‘শেষবিচারের নিদান’ ছাড়া ভরসা করবার থাকে বা কী?
অথচ খুব সম্প্রতি, এই পথে ভেবেই দীর্ঘ প্রায় এক দশকের তর্ক বিতর্কের
পরে এই সেদিন রাজতন্ত্রের থেকে মুক্ত নেপাল তৈরি করেছে একটি সংবিধান। আমাদের
ভারতীয় মন নেপালকে উপনিবেশ ভেবে এসেছে বলেই সম্ভবত তার দিকে আমাদের নজর প্রায়
পড়েনি বললেই চলে। বরং হিন্দু রাষ্ট্র রইল না
বলে আক্ষেপ করবার অসমের হিন্দু দেখা যাবে অনেক। ভারতীয় উপমহাদেশে একটি নজির
বিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে নেপাল। কে বা কবে দেখেছে, সংবিধান
একটি তৈরির জন্যে দেশের মানুষ এক দশক ধরে সংসদের ভেতরে বাইরে তর্ক করেছে, আলোচনা
করেছে। ভোট দিয়েছে। তবে গিয়ে সংবিধান স্বীকৃত হয়েছে। সেসব কিছু না করেই ‘দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বলে গৌরবে আমাদের মাটিতে পা
পড়ে না। ‘উন্নতর গণতন্ত্র’ নিয়ে ভাববার অবসরই মেলে না। সংক্ষেপে লিখলে, এই সংবিধানে ৭টি প্রদেশভিত্তিক একটি ফেডারেল শাসন
কাঠামোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ এবং প্রদেশে এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের
ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্রের দুই কক্ষের একটি প্রতিনিধি পরিষদ এবং অপরটি জাতীয় পরিষদ।
জাতীয় পরিষদের মোট ৫৯ সদস্যের মধ্যে ৭ প্রদেশ থেকে ৫৬ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন ,
৩জন হবেন রাষ্ট্রপতি মনোনীত। অন্যদিকে অপরদিকে মিশ্র নির্বাচন ব্যবস্থায় ২৭৫ আসনের
প্রতিনিধি পরিষদ গঠিত হবে। এরমধ্যে ১৬৫ আসনে সরাসরি ভোট হবে। আর ১১০ জন সদস্য
নির্বাচিত হবেন বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। সংবিধানে ঘোষণা করে বলা হয়েছে নেপাল হবে বহুজাতির, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের এবং বহু ভাষার রাষ্ট্র। তাঁরা সবাই
সংখ্যানুপাতে সংসদে নির্বাচিত হবে। এজন্য সংবিধানে আরও বলা হয়েছে অনগ্রসর, জাতিগত সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর
প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এমন আইন দ্বারা নির্দিষ্ট শর্তে দল ও সংসদ গঠন করতে হবে।
তেমনি বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক কোন প্রতিবন্ধকতা যাতে না থাকে তাই নেপালে উচ্চারিত সকল মাতৃভাষা জাতীয় ভাষা
হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে এই সংবিধানে
ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমকামী, উভকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যা এই অঞ্চলে সম্পূর্ণ
ব্যতিক্রম। বলা হয়েছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে এবং প্রাচীন
যুগ থেকে প্রচলিত ধর্ম, সংস্কৃতি সুরক্ষা দেয়া হবে। দল
ও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। যে
১১০ জন সদস্য বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে নির্বাচিত হবেন তার এক
তৃতীয়াংশ হতে হবে নারী সদস্য।
সাম্প্রদায়িকতার প্রতিযোগিতা না করে, কোন সাম্প্রদায়িকতার বিপদ বেশি
সেই সব তর্ক না করে আমরা কি সেরকম কিছু এখনো ভাবতে পারি না? বস্তুত পারি
না বলেই, বরাক উপত্যকাকে স্বতন্ত্র রাজ্য করবার কথা মনে মনে ভাবলেও কার্যত কেউ আন্দোলন
টান্দোলন গড়ে তুলতে পারেন নি। আর সেরকম কিছু ভাবতে পারলে, স্বতন্ত্র
রাজ্যের দরকারও পড়ে না--- জনমত গড়ে তুলতে পারলে, বিভিন্ন
ভাষিক, নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের এবং শ্রেণি-লিঙ্গ সমূহের সঙ্গে আলোচনা করে
প্রভাবিত করে স্বাধীন অসমের চিন্তাকেও কি আমরা অবাঞ্ছিত করে ফেলতে পারি না? সম্ভবত
পারি। সেই জন্যে ‘সেনা বাহিনী বিশেষ আইনে’র মতো অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের
দরকার পড়ে না। স্পষ্টতই সেটি বাঙালি বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্তদের তরফেই শুরু হতে পারে।
এই প্রস্তাবে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। সাম্প্রদায়িকতাকে তাড়াতে গেলেও বাস্তবের
বিভাজনকে মেনে নেওয়াই ভালো। বাঙালি মুসলমান বলছি না । তাঁরা বর্ণহিন্দুকে সঙ্গ
দেবেন নিশ্চয়---নিজস্ব উদ্যোগ নেবার জন্যে তাদের সেই মধ্যবিত্তও নেই, আর ভাষিক
এবং ধর্মীয় দুই দিক থেকে সংখ্যালঘু হবার ফলে সামাজিক জোরটাও নেই। অসমিয়া
বর্ণহিন্দু বলছি না কেন, তাঁদেরো গণতান্ত্রিক মানুষ নিশ্চয় সঙ্গ দেবেন—কিন্তু মূল অংশটিই তো
প্রাদেশিক শাসক শ্রেণি। তাদের সেই তাগিদ থাকবে কেন? তাঁরা যে দিল্লির পশ্চিমা
হিন্দি বর্ণ হিন্দুর অনুগমন করেই শ্রেণি স্বার্থটি বেশি সুরক্ষিত ভাবেন সাম্প্রতিক
শাসনের ‘পরিবর্তনে’ তা স্পষ্ট। অসম আন্দোলনের নায়ক এবং বাহক সংগঠনের
ভূমিকাতেও স্পষ্ট। তাঁরা তো আধিপত্য
টিকিয়ে রাখতেই ভালোবাসেন বলেই বিরোধ যত। সেই বিরোধকে বাড়িয়ে তুলেন
বাঙালি বর্ণহিন্দুর সেই অংশ যারা হিন্দুত্বের নামে মুসলমানের উপরে আধিপত্যের স্বপ্ন
দেখেন। কিন্তু নিজেদের কোনো আধিপত্যের থেকে মুক্ত করতে পারেন না। সম্ভব হলে
পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতা বা অন্য প্রদেশে চলে যান--- যেমন যুক্তি
দেখিয়ে গেছিলেন সমরজিৎ চৌধুরীরা কাগজে ঘোষণা দিয়ে। অথবা, অধ্যাপক
সুবীর করের মতো ‘শেষবিচারের’ দিন গুণেই ইহলোক থেকে বিদায়
নেন।
এক ঐতিহাসিকের দায় বর্তায় সবার জন্যে গ্রহণ যোগ্য ‘ন্যায়বিচারে’র একটি সমাধান সূত্র প্রস্তাব
করা। সুবীর কর ‘শেষবিচারে’র বদলে সেই ‘ন্যায়বিচারে’ কথাটি তুলতে
পারতেন। কেননা, তিনি ক্যাবিনেট মিশন এবং অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবনার
মধ্য দিয়ে বৌদ্ধিক ভ্রমণ করেছেন। অখণ্ড অসমের এক ভাবনাতে সেই পথেই এগুনো চলে। আমরা
কথাটি একেবারেই কল্পনার থেকে লিখছি না। আশি নব্বুইর দশকে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ শীর্ষক এক
সর্বভারতীয় অভিবর্তন প্রক্রিয়া এরকম প্রস্তাবে শুরু হয়েছিল। অসমের সংযুক্ত বিপ্লবী
পরিষদ (আর্মকা) এমন একটি প্রস্তাব দিয়ে চেষ্টা করেছিল দিকে দিকে পৃথক রাজ্যের দাবি এবং
স্বাধীন অসম, নাগাল্যাণ্ড, মণিপুরের দাবির বিকল্প পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত
করতে। নানা কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু যা হয়েছে, তা কি একেবারেই হয়েছে। “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই
কি গেছে -- কিছুই কি নেই বাকি?”
কোন মন্তব্য নেই