Header Ads

অথঃ নেহরু-চরিতম্

ফাইল ছবি
ড. প্রশান্ত চক্রবর্তী
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কটন বিশ্ববিদ্যালয়

তৈয়বউল্লা। অসমের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯২১ থেকে গুয়াহাটির জেলা কংগ্রেস সম্পাদক, পরে সভাপতি। ১৯২৬ থেকে অসম প্রদেশ কংগ্রেসের প্রধান সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহ সভাপতি, শেষে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ অব্দি সভাপতি। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য। স্বাধীনতার পর অসমের মন্ত্রী। গান্ধিবাদী। ঘোর মুসলিম লিগ বিরোধী। 
    ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ অব্দি রাজবন্দি থাকাকালীন জেলখানা থেকে নিজের দুই মেয়ে(বড় মেয়েকে ৪০টি, ছোটটিকে ১টি) ও স্ত্রী-কে(৯)টি মোট ৫০টি চিঠি লিখেছিলেন। এইসব চিঠি 'তুমি কেমন আছ, আমি ভালো আছি' জাতীয় নয়। ওই সময়ের রাজনৈতিক জীবনের ধারাটি অতি প্রাঞ্জল ভাষায় লিখে গেছেন তৈয়বউল্লা সাহেব। সেই চিঠির সংকলনটির নাম "কাৰাগাৰৰ চিঠি" বা 'কারাগারের চিঠি'। ১৯৬২-তে অসম প্রকাশন পরিষদ থেকে প্রকাশিত।
    অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। কটন কলেজ থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এনট্রান্সে সারা অসমে প্রথম স্থান দখল করেন। বিজ্ঞানের ছাত্র। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র,  আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, নোবেল বিজয়ী সি.ভি. রমন তাঁর শিক্ষাগুরু । 
    •••
কংগ্রেসের এরকম বড় একজন ব্যক্তিত্ব নেহরু-পরিবার ও জওহরলাল নেহরুর উত্থান খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এবং অত্যন্ত নির্মোহভাবে সেই চিত্র কারাগারে বসে লিখে গেছেন। দু-একটি তথ্য দিই। তৈয়বউল্লা অসমিয়া মুসলমান। বইটি অসমিয়াতে লেখা। আমরা সবার সুবিধার্থে নির্বাচিত অংশের বাংলা অনুবাদ এখানে গেঁথে দেব।
•••
   এক সময় কংগ্রেসে 'নেহরু' বলতে মতিলাল নেহরুকেই বুঝত সকলে। তৈয়বউল্লা লিখেছেন১৯২৬-এর পাণ্ডু কংগ্রেসের পর জওহরলালের আচমকা আবির্ভাব। তাঁর ভাষায়
    "মতিলাল নেহরুর পুত্র~Crown Prince; Harrow-র ছাত্র, কেমব্রিজ-পাশ; যুবা সত্যাগ্রহী-ব্যারিস্টার;ব্যক্তিত্ব ততটা প্রকাশ পায়নি তখনও।" অথচ তিনি রাতারাতি কংগ্রেসের প্রধান সম্পাদক হয়ে গেলেন!
       তৈয়বউল্লা লিখছেন : "কংগ্রেস মহলে গুঞ্জন উঠেছিল যে, মতিলালের ছেলে বলেই জওহরলাল এত তাড়াতাড়ি কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি হতে পেরেছেন!(জওহরলাল নেহরুর কংগ্রেস সভাপতিত্বের দিনে, নেহরু-পরিবারের প্রিয়, স্যার আম্বালাল সারাভাইর মেয়ে কুমারী মৃদুলা সারাভাইকে ঠিক যেভাবে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন স্বয়ং নেহরু, সেইরকম!)।" (পৃ.২১৯-২০)
    এবার বুঝুন, ভাবুন~ সেই ট্র্যাডিশন কবে থেকে চলছে!
   নেহরুর পর ইন্দিরা, ইন্দিরার পর সঞ্জয়-রাজীব, সোনিয়া-রাহুল-প্রিয়াংকা...!
   সোনিয়া কীভাবে এত্ত এত্ত সিনিয়র লিডার থাকার পরও সভাপতির মতো গুরুদায়িত্ব অপক্ব পুত্রকে সপে দিলেন~সেটা তো চোখের সামনে দেখা গেছে। ধস বাঁচাতে মেয়ে প্রিয়াংকাকেও রাতারাতি "সাধারণ সম্পাদক" করা হলো এবার। তাও তো মনে হয় শেষরক্ষা হচ্ছে না।
•••
তৈয়বউল্লা একটি ঘটনা লিখেছেন। কংগ্রেস নেতা চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী হঠাৎ ইসলামি সাম্প্রদায়িক "মুসলিম লিগ"-এর সাথে আঁতাত করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তাব পেশ করলেন। এটাই কুখ্যাত C. R. Formula নামে পরিচিত। এই আঁতাতের বিরুদ্ধে আলোড়ন উঠল।  C. R. এলাহাবাদ স্টেশনে নামতেই কালো পতাকা নিয়ে হিন্দু মহাসভার ভলান্টিয়াররা দলে দলে শ্লোগান দিতে শুরু করল"রাজাগোপালাচারী ওলট যাইয়ে", "কংগ্রেস ধ্বংস হোগা" ইত্যাদি। প্ল্যাটফর্ম গরম। এর পরের অংশ তৈয়বউল্লার ভাষায়
     "ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে নেহরু আর কন্যা ইন্দিরা C. R.কে স্বাগত জানালেন, অভ্যর্থনা সমিতির হয়ে। হিন্দু মহাসভার  Black Flag প্রদর্শন আর বিক্ষোভ-ধ্বনি নেহরুর মেজাজ দিল বিগড়ে। আর যায় কোথায়? কালো পতাকা নিজে কাড়তে লাগলেন। আর রাগে অগ্নিশর্মা, উত্তাল, অধীর, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মেয়ে ইন্দিরাও, বাপের দেখাদেখি, না-ভেবে, না-চিন্তে দু-তিনটে ঝান্ডা হিন্দু মহাসভার সেবকদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নেহরুকে reinforce করলেন! C. R. কাণ্ড দেখে থতমত! নেহরু C. R.কে নিয়ে প্রস্থান।"(পৃ.৩০০-০১)
   রাতে AICC-র মিটিং। নেহরু উঠলেন। দিনের ঘটনা না-বললেও চলত। গর্ব করে বললেন~
     "ম্যঁই ওয়াকত কুছ জংলি বন জাতা হুঁ...আজ সুবাহ্ ইস্টিশন মেঁ জো ওয়াকিয়াত হো গ্যয়া..."ইত্যাদি।(পৃ.৩০১)
•••
     তৈয়বউল্লা প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি অসম প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। খুব কাছে থেকে দেখেছেন নেহরুকে। সঙ্গে নিয়ে সারা অসমে ঘুরেছেন। নেহরু নাকি ভ্রমণের সময় "chain-smoker, একটার পর একটা টেনেই চলছেন!" কিন্তু কেন? চাপে?! তৈউবউল্লা জানাচ্ছেন~"বাহ্যিক হিসাবে, দেখতে নেহরু অহংকারী, ভীষণ রাগী, অস্থির প্রকৃতির, সব কিছুতেই তাড়াহুড়ো স্বভাবের।"(পৃ. ৩০৩)। আবার অন্য সময়ে উল্টো। আন্তরিক, মহত্বপূর্ণ। 
    উজান অসমের গোলাঘাটের একটি ঘটনা। তখনও তেমনভাবে মাইক আসেনি। সবে দুই এক জায়গায় মাইকের চল শুরু হয়েছে। মঞ্চে নেহরু। সভাপতি তৈয়বউল্লা। সভাপতি নেহরুকে স্বাগত জানালেন এবং ভাষণ দিতে অনুরোধ করলেন। একটা মাইক। সেটিতে একটি স্থানীয় অসমিয়া মেয়ে উদ্বোধনী সংগীত গাইছিল। গান শেষ হতে তো দেবেন!? না, তার আগেই নেহরু মেয়েটির সামনে থেকে মাইকের ঘেঁটি ধরে ভাষণ শুরুই করে দিলেন"ভাইওঁ আউর বহেনোঁ...!"(মোদি কি ওখান থেকেই আইডিয়াটা নিয়েছেন!!😄)। গেল মাইক বিগড়ে। কথা ছিল মেয়েটি গান শেষ করে নেহরুর গলায় মালা পরাবে। তৈয়বউল্লা লিখছেন"নেহরু সভাসমিতিতে মালা পরতে খুব  পছন্দ করতেন।"  মাইক নষ্ট হতেই নেহরুর সেই আদিম রূপ, ক্রোধে দুর্বাসা। মাইকের লোকটিকে যা তা বলছেন"আপকা মালিক কো কহ্ দিজিয়ে উনকি পেশা বদল লে..!" এদিকে ওদিকে আগুনচোখে তাকাচ্ছেন। হা পা ছুঁড়ে বকেই চলেছেন। মালা হাতে মেয়েটি হতভম্ভ। শেষে শিখিয়ে দেয়া মতে মালা পরাতে এগিয়ে গেল। এর পরের ঘটনাটা তৈয়বউল্লার ভাষায়
     "নেহরু অন্য সময় মালা দেখলেই একটা দৈবিক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে নিজেই মাথাটা এগিয়ে দেন। আজ কী কুক্ষণে, সকালে কার মুখ দেখেছিল মেয়েটি...! কোথায় পরাবে...মালাধারী নেহরু চিলের মতো ছোঁ মেরে মালা কেড়ে নিয়ে বীরবিক্রমে নিক্ষেপ করলেন মঞ্চের মধ্যিখানে~এত্ত জোরে যে, মালাটা ছিটকে গিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে স্টেজের বাইরে মঞ্চের নীচে মাটিতে গিয়ে পড়ল। মেয়েটি তখন গতিহীন পাথরের মতো দাঁড়ানো।"(পৃ. ৩০৪-০৫)
   কিছুক্ষণ পর মাইক ঠিক হলো। নেহরু  ভাষণ দিয়ে নামলেন যেন কিছুই হয়নি। মঞ্চ ছেড়ে নামার আগেই চারপাশে পাড়ভাঙা সাধারণ মানুষের ঢল। ঘিরে ধরেছে। কেউ হাতজোর, কেউ পা পায়ে প্রণাম। অসমিয়া পরম্পরা। দেরগাঁওয়ের সত্যাগ্রহী, মুখিয়াল, বৃদ্ধ বর শইকিয়া অতি ভক্তিভাব নিয়ে নেহরুর পায়ে লম্বা হয়ে পড়লেন। তৈয়বউল্লা লিখছেন
    " গ্রামের সরল, সোজা ৭০বছরের বরশইকিয়া নেহরুর উর্দু বক্তৃতার শেষ অংশটুুকু কোথা থেকে বুঝবেন নেহরু শেষে জনতাকে সতর্ক করে বলেছিলেন ম্যেঁই তো কোই সাধু-সন্ন্যাসী নেহি হুঁ, কোই ধরমগুরু saint ভি নেহি। আগর কোই পাও পকড়ে, মুঝে রঞ্জ হোতা হ্যয়, ইয়ে বিলকুল না মাকুল বাক হ্যয়...! নেহরু আবার হয়ে পড়লেন পুরো জংলি।" (পৃ. ৩০৫)। 
     বেচারা বয়োবৃদ্ধ বর শইকিয়াকে শুধু হাতে পিটে সিধে করাটাই বাকি ছিল নেহরুর।
   কিমঅধিকম্ ইতি...!😊
•••


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.