এনআরসি ও ভাষার রাজনীতি
লিখেছেন অরূপ বৈশ্য
এনআরসি প্রক্রিয়ার দীর্ঘকালীন যাত্রা আসামের সমাজ-অর্থনীতির প্রভূত ক্ষতি সাধন করে চলেছে। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর অপূরণীয় ও গভীর ক্ষতি সবার চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। প্রথমত, সমাজে যে বিষয় নিয়ে মত বিনিয়মের প্রাবল্য থাকে সেই বিষয় রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় প্রভাব বিস্তার করে। সঙ্গতকারণেই অসমের সমাজ জীবনে যারা জনমত তৈরি করতে পারেন তাদের প্রায় সবাই এনআরসিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পক্ষে বিভাজিত হয়ে পড়েছেন এবং তাতেই আবদ্ধ হয়ে আছেন। সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্যান্য বিষয় হয়ে পড়েছে গৌণ। অর্থাৎ এনআরসি ডিসকোর্সে সমাজকে ব্যস্ত রেখে রাষ্ট্র ও সরকার অন্যান্য সমস্ত প্রশ্নে সবার চোখের আড়ালে ও গণ-বিতর্ক এড়িয়ে যা খুশী তাই করে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, একজন অর্থনীতিবিদ বলছিলেন যে এই নির্বাচন সমাজ-অর্থনীতিতে লিক্যুইডিটি ক্রাইসিস খানিকটা শিথিল করেছে, কারণ যাদের কাছে নগদ অর্থ জমা ছিল তারা এই নির্বাচনে বিতরণ করেছেন এবং তাতে সাধারণ পণ্যের কিছুটা হলেও চাহিদা বাড়বে, এনআরসি প্রক্রিয়া ঠিক তার বিপরীত – এখানে আইনী দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে জনগণের নগদ অর্থ মুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের হাতে ক্রামাগত কুক্ষিগত হচ্ছে – এনআরসি’র দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া অসাম্য বৃদ্ধিতে মদত দিয়ে চলেছে। তৃতীয়ত, এনআরসি প্রক্রিয়ার দীর্ঘকালীন হয়রানির ফলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এক ভাষিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়া মূলত সংখ্যাতত্বের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতা ও আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার বাসনা থেকে উদ্ভূত। এই প্রতিক্রিয়া একাধিক ক্ষমতা-কেন্দ্র সৃষ্টির এক উপায় হতে পারে, কিন্তু প্রতিটি কেন্দ্রই যে সর্বভারতীয় ও গ্লোব্যাল সাম্রাজ্যবাদী শাসন ব্যবস্থার দাসত্বের অধীনে চলে যাবে সেটা নিশ্চিত। ভাষাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতার আসল প্রাণশক্তি যদি গণশিক্ষা ও প্রশাসনিক নমনীয়তা না হয়, তাহলে শোষণমূলক ও আধিপত্যবাদী শাসন থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব এবং এতে গুরুত্ত্ব না দিলে অসমবাসীর সামূহিক ধ্বংস অনিবার্য। গণিতশাস্ত্রের প্রাথমিক সংখ্যা ও সংখ্যার হিসাবের জ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান হিসেবে মানবদেহের প্রাথমিক জ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র হিসেবে জল-বায়ু- মাটির রাসায়নিক জ্ঞান ইত্যাদি সকল বিষয়ে একেবারে প্রাথমিক স্তরের জ্ঞান কেন মুখের বুলিতে শেখানোর ব্যবস্থা করা যাবে না যাতে চা-বাগান, চর অঞ্চলের মত পিছিয়ে পড়া এলাকার কচিকাঁচারা কিছু শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠে – আর এই গণশিক্ষাই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রকে গণদেবতার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রাথমিক সোপান। ভাষাকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক রাজনীতি শ্রেণি রাজনীতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কোনো শাসক শ্রেণিই চাইবে না আধিপত্যের এই হাতিয়ারটি তাদের হাতছাড়া হোক, হাতছাড়া হোক জ্ঞানের উপর শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ ও একাধিপত্য। অভ্যন্তরিণ এই আধিপত্যের রাজনীতি অসমে সর্বভারতীয় শাসক শ্রেণির আধিপত্যের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য সুনিশ্চিত করে চলেছে এবং অসমবাসীর চরম সংকট ও ধ্বংস ডেকে আনছে। যদি এই ধ্বংস থেকে বাঁচতে হয় তাহলে এনআরসি প্রশ্নের আশু গণতান্ত্রিক সমাধান প্রয়োজন এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বশেষে শোষিত শ্রেণির শ্রেণি ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। ‘ভোটাররাই নাগরিক’ সভ্যতার এই যুক্তি মেনে নিয়ে নাগরিকত্ব প্রশ্নের আশু সমাধানের পথ নিশ্চয়ই বের করা যায়, প্রয়োজন জনমত সৃষ্টিকারীদের সদিচ্ছা।
কোন মন্তব্য নেই