পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন- ‘‘আলো ক্রমে নয়, স্পষ্ট আসিতেছে’’
বাসব রায়ঃ গুয়াহাটি
আলো ক্রমে নয়, স্পষ্ট আসিতেছে
ঠিক এক বছর আগে আজকের দিনে কংগ্রেস দল ঘোষণা করেছিল তাদের পরবর্তী সভাপতির নাম। সেই তখন, যখন গোটা দেশে কংগ্রেসকে কেউ পাত্তাই দিত না। প্রায় সাড়ে পাঁচশো আসনের লোকসভায় ৪৪টা আসন পেলে কেউ পাত্তা দেয়ও না। এপর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু তারপর ভারতের মানুষ যা আশা করেননি, বা হয়তো বড্ড বেশি আশা করেছিলেন, কমলকুমার মজুমদারের ‘আলো ক্রমে আসিতেছে নয়’, ক্রমশ আলো স্পষ্ট হচ্ছে।
দিল্লি-বিহার-পাঞ্জাবে বিজেপি পর্যুদস্ত হওয়ার পরও আমরা, ভারতের সাধারণ মানুষ, সংকেতটা ধরতে পারিনি। কেননা উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফলাফলকে এত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল যে, প্রদীপের নীচের অন্ধকার চোখে পড়েনি, আমাদের। এবং আজকের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে তার ইঙ্গিত অত্যন্ত জোরালোভাবে কিন্তু দিয়েছিল গুজরাট। হ্যাঁ, গুজরাট।
গুজরাট ছিল এমন এক রাজ্য যেখানে বিজেপি বলার মতো ইস্যু পায়নি। এমনিতে ভদ্র-সজ্জন-জ্ঞানী মণিশংকর আয়ার ভুলভাল কথা না বললে আরো কয়েকটা আসন বেশি পেত কংগ্রেস জোট, সেখানে। ওই নির্বাচনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমরা বলতে শুনেছি, ‘দেখো আমায় গালি দিয়েছে, আমি গুজরাটি, মানে গুজরাটের মানুষকে গালি দিয়েছে, আমাদের সম্মানহানি হয়েছে’ ইত্যাদি। তো সেই নির্বাচনে বিজেপি ১১৫ থেকে কমে আসে ৯৯-এ। কংগ্রেস জোট ৬১ থেকে উঠে ৮১-তে গিয়ে থামে। জিগনেশ মেহবাণী, অল্পেশ ঠাকুর, হার্দিক প্যাটেলের সঙ্গে আরো ছয় মাস আগে কংগ্রেসের জোট হলে গুজরাটের ফলাফল অন্যরকম হতেই পারত।
তো আজ কথা এটা নয়, কথা হল হিন্দি বলয়ের তিনটে রাজ্যে বিজেপির ধ্বস নেমেছে। মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালে হিন্দি বলয়ের ২০৪ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৯২-টা। এবং রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের ৬৫টা লোকসভা আসনের মধ্যে এখনও বিজেপির সাংসদ ৬২। আজকের ফলাফলের পর একেবারে চোখ বুজে বলা যায়, ২০১৯ লোকসভায় বিজেপি এই ৬৫-তে ৩০টা আসনও পাবে না। হিন্দি বলয়ের তিনটি রাজ্যে বিজেপি-বিরোধীরা ভালো ফল করার পর এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে হিন্দি বলয়ে বিজেপি-বিরোধীরাই বেশি আসন পাবে।
আজ প্রশ্ন তো একটাই বিজেপি কেন হারল। যদিও আমি প্রশ্নটাকে এভাবে মোটেও দেখছি না, বরং দেখছি, বিজেপি কেন জিতেছিল? কংগ্রেসের নীতিপঙ্গুত্ব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে মানুষ একজন শক্তিশালী নেতা খুঁজছিলেন। খুব দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে তার আঁচ ছিল নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির মধ্যে। তো ভারতের জনগণ, বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের মানুষ ঢেলে ভোট দিয়েছিল তাঁকে।
আজ সেই মোদি হাওয়া অস্তমিত। তাঁর কথায় মানুষ আর বিশ্বাস করে না। সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিন, বিজেপির ঘোষিত অভিভাবক আরএসএস এখন মোদিকে এখন তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর আর ভাবছে না, নতুন মুখ উঠে এসেছেন আদিত্যনাথ যোগী। যে পাঁচটি রাজ্যের আজ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হল তাতে যোগীই সবচেয়ে বেশি জনসভা করেছেন।
বিজেপি বকলমে মোদি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন তা পূরণ হয়নি, এটা সবাই জানে। সে তো কংগ্রেসও আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, পূরণ করতে পারেনি। তারপরও বিজেপি হারছে কেন?
হারছে এবং হারবে এজন্যই যে ভারতের মতো বহুমত, বহু সংস্কৃতি, বহু খাদ্যরুচি, বহু ভাষাভাষীর দেশ চালানোর জন্য যে যোগ্যতা দরকার কোনো সরকারের, তা বিজেপি সরকারের নেই, হ্যাঁ, যোগ্যতা নেই দেশ চালানোর। হিন্দুত্ব দিয়ে, বলো ভাই বল্লভভাইয়ের মূর্তি দিয়ে, রামমন্দিরের ধুয়ো তুলে দেশ চলে না।
- ২ কোটি বেকারের চাকরির কী হল?
কেন, ওই যে স্ট্যাচু অব লিবার্টি বানিয়েছি।
- ১৫ লক্ষ টাকা অ্যাকাউন্টে কবে ঢুকবে?
- ওটা তো জুমলা ছিল।
- কৃষকরা রোজ আত্মহত্যা করছে, কী ভাবছে সরকার?
- রামমন্দির ওখানেই হবে।
বিজেপিকে প্রশ্ন করুন, এরকমই জবাব পাবেন। হিন্দুত্ব, রামমন্দির, গরু, ইসলামি নাম পরিবর্তন, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, চীন শত্রু, পাকিস্তান শত্রু, দেশপ্রেম এরকম গোলগোল কথাবার্তা শুনবেন। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন করুন, জবাব সেই এক - মুসলমানরা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে, তখন কী হবে?
এভাবে একটা বা দুটো নির্বাচন জেতা যায়, যা বিজেপি জিতে গেছে। অটলবিহারী বাজপেয়ি এবং নরেন্দ্র মোদি সরকার। বারবার এভাবে মানুষকে ঠকানো যায় না। ভারতের মানুষ বড্ড শান্তিপ্রিয়, সহিষ্ণু। আখলাখ আহমেদকে পিটিয়ে মারা ভারতের মানুষ পছন্দ করে না। গরু ব্যবসায়ীদের মধ্যযুগের অপরাধীদের মতো পিটিয়ে মারা ভারতের মানুষ পছন্দ করে না। নোটবন্দির মতো বিষয় ভারতের মানুষ পছন্দ করে না। জিএসটি-র মতো গোলমেলে ব্যাপার ভারতের মানুষ পছন্দ করে না। মুসলমান-বিরোধিতা ভারতের সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না।
এটা ঠিকই যে ভারতে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু আরএসএস এবং বিজেপি যে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী তা বর্ণহিন্দুর হিন্দুত্ব। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বী আছেন যাঁরা বাড়িতে কোনো পুজোই করেন না। তাঁদের কাছে রাম বা শ্যামের কোনো তাৎপর্য নেই। ধর্ম ধুয়ে আমরা জল খাব না, খেলেও পেট ভরবে না। আমরা চাই কাজের পরিকাঠামো, শান্তিপূর্ণ সমাজ, চাঙা অর্থনীতি। আমরা ধর্ম নিয়ে ভাবিত নই, না রামমন্দির নিয়েও ভাবিত নই।
একটু আগে, সন্ধেবেলায়, রাহুল গান্ধীর সাংবাদিক সম্মেলন শুনছিলাম। কী সুন্দর বললেন, ‘আপনাদের একটা কথা বলি, গত রাতে মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁকে বললাম, প্রকৃতপক্ষে আমি রাজনীতি শিখেছি ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে। সেখানে আমরা হেরেছি বটে, কিন্তু শিখেছি অনেক। শিখেছি কী করা উচিত নয়। যে কোনো রাজনীতিকের সবচেয়ে বড় শিক্ষক জনগণ। তাঁদের কথা শুনতে হয়, মূল্য দিতে হয়। খুব দুর্ভাগ্যজনক সত্য হল, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কারো কথা শোনেন না। তিনি উদ্ধত।’
আজ এক বছর হল কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন রাহুল গান্ধী। আজ নিশ্চিন্ত মনে লেখা যায়, ‘গুড মর্নিং রাহুল গান্ধী, ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়ান পলিটিক্স।’
আমাকে যাঁরা চেনেন, জানেন যে আমি আনখশির বামপন্থী। তো আজ বিজেপি-র হারে আমার এত উল্লাসের কারণ কী? সন্ধেবেলায় হালকা ছলেই পোস্টে লিখেছিলাম, ‘আজ সৌরভের মতো শার্ট খুলে নাচছি, ২০১৯ লোকসভা ভোটের পর প্যান্ট খুলে নাচব।’ তো কেন এত উল্লাস?
যাঁরা শুধুই ভোটের ফলাফল দেখছেন, ইন ফ্যাক্ট তাঁরা কিছুই দেখছেন না। কংগ্রেসের এই জয় যে মূলত বামপন্থার জয় এটা সম্ভবত খেয়াল করছেন না অনেকেই। হাসবেন না, পরের লাইনটা পড়ুন। এই নির্বাচনে কংগ্রেসের যে কয়েকটি ইস্যুতে জোর দিয়েছিল যেমন কৃষকদের সমস্যার সমাধান, বেকারদের চাকরি, দুর্নীতি দূরীকরণ... এসবই বামপন্থীরা প্রায় একশো বছর ধরে বলে আসছেন। কংগ্রেস কখনো বামপন্থী দল হতে পারবে না, কংগ্রেসের শ্রেণিচরিত্রই তা হতে দেবে না। কথা সেটা নয়, কথা হল, কংগ্রেস যে ইস্যুগুলো নিয়ে এই নির্বাচনে লড়েছে সবই বামপন্থীদের কমন ইস্যু। হয়তো বামপন্থীরা এখন ঠিকভাবে ঠিক জায়গায় এসব বলতে পারছে না। কিন্তু তাতে বামপন্থা বিপর্যস্ত বা বিপন্ন হয় না। নতুনভাবে তা গড়ে ওঠে।
আর তাই সেই কথাটাই শেষপর্যন্ত সত্যি হয়ে যায় যে
বামপন্থাই ভবিষ্যৎ...
কোন মন্তব্য নেই