কি আছে বামপন্থীদের? কতটুকু ক্ষমতা?
সুশোভন পাত্ৰ
কি আছে বামপন্থীদের? কতটুকু ক্ষমতা? ঐ তো মরু রাজ্যের দুটো আসন। মেরেকেটে ৫রাজ্যে ৭.৮২ লক্ষ ভোট। গোটা দেশে ৪%। ২০টা সাংসদ নেই। দেড়শটা বিধায়ক নেই। কেরালা ছাড়া একটা রাজ্যেও সরকার নেই। সরকার গঠনে নির্ণায়ক কোন ভূমিকা নেই। ভোটের পরে কেনা-বেচার ২-৪টা ডাগর ঘোড়া নেই। রুদ্ধশ্বাস ক্যাবিনেট মিটিং’-এ ফটো ফিনিশেরও চান্স নেই।
কি আছে বামপন্থীদের? রাস্তায় বেরোলে ১৫ ফুট হোর্ডিং-এ নেতাদের সদা হাস্য মুখ নেই। পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন নেই। পার্টি ফান্ডে আম্বানি-আদানি’দের পয়সা নেই। সেলেব একটা ব্র্যান্ড-অ্যাম্বেসেডার নেই। চার্টার্ড বিমান চেপে নির্বাচনী প্রচার নেই। ভোটের মুখে রাম নাম নেই। পেট ভরে দু-মুঠো ঘুষ খাওয়ার স্টিং অপারেশন নেই। একটা তাগড়া আইটি সেল? ধুর ছাই, সেটাও নেই।
কি আছে বামপন্থীদের? তৃণমূলের ৩৪টা সাংসদ, ২১জনই কোটিপতি। ৬জন ফ্লিমস্টার। তাছাড়াও সরকারী প্রসাদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা আছেন। লেজুড়বৃত্তি করার লেখক-কবিরা আছেন। মঞ্চ আলো করে নায়ক-নায়িকারা আছেন। গৃহপালিত মিডিয়া আছে। ক্লাবে পোষা গুণ্ডা আছে। সিভিক-পুলিশ-প্রশাসন-সিআইডি-কমিশন, সব আছে।
কি আছে বামপন্থীদের? বিজেপির ২৭২জন সাংসদ, ২৩৭জনই কোটিপতি। দিল্লির দীনদয়াল মার্গে ১.৭০লক্ষ বর্গফুটের অট্টালিকায় পার্টি অফিস আছে। বার্ষিক ১,০৩৪কোটি আয় আছে। ৫৩২কোটির কর্পোরেট ডোনেশেন আছে। আশোকা রোডে দু-তলা বাড়িতে সাজানো মিডিয়া সেল আছে। হিন্দু ধর্মের উপর নাকি বাপের জমিদারি আছে। ‘স্বয়ং সেবক’দের লেলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। গুজরাট-মুজ্জাফরনগর কে নরক বানানোর গোলিয়াথরা আছে। কিন্তু মুশকিল হল, ইতিহাসে কোনদিন শেষ অবধি এই গোলিয়াথরা জেতেনি। জিতেছে ডেভিডরাই। ৫রাজ্যে ভোটের ফলের সংশ্লেষ বলছে, গ্রাম ভারতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে বিজেপি। মধ্যপ্রদেশের গ্রামে দখলে থাকা ৭৫টির বেশি বিধানসভা খুইয়েছে বিজেপি। রাজস্থানের প্রায় ৪০। ছত্তিসগড়ে ৩০। দেশে ৬২% মানুষ কৃষিজীবী। নাসিক থেকে মুম্বাইয়ের ‘কিষান ‘লং মার্চ’ কিম্বা দিল্লির সংসদ মার্গে ‘কিষান মুক্তি মার্চ’ –গত দু’তিন বছরে চাষিরা যখন বারবার ফসলের ন্যায্য দাম চেয়ে পথে নেমেছেন, চাষিরা যখন ঋণ মকুবের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তখন নিরভ মোদীর সঙ্গে দাভোসে গিয়ে ফটো সেশেন করেছেন। ৫রাজ্যের ভোটে কৃষক অসন্তোষের যে ট্রেলর গোলিয়াথরা আজ দেখছেন, সেদিন সেই কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ঐ ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
বছরে ২কোটি বেকারের চাকরি হয়নি। দেশ জুড়ে যখন বিভিন্ন মাঝারি শিল্পে ২৯লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তখন বেকারদের পোকোড়া ভাজতে উপদেশ দিয়েছেন। শেষ ২০বছরের সমস্ত রেকর্ড টপকে ৬.৯% হারে দেশের বেকারত্ব যখন সর্বোচ্চ বেড়েছে, গোলিয়াথরা তখন ৩হাজার কোটির সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বানিয়েছে। ৫রাজ্যের ভোটে বেকার’দের পেটের জ্বালার যে ট্রেলর গোলিয়াথরা আজ দেখছেন, সেই বেকার’দের কাজের দাবিতেই প্রতিদিন রাস্তায় থেকেছে ঐ ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবে ‘কালো টাকা’ ফেরত আসেনি। আপনার-আমার অ্যাকাউন্টে ১৫লাখ জমা পড়েনি। জাল নোটের রমরমা কমেনি। সন্ত্রাসবাদেরও মেরুদণ্ড ভাঙ্গা যায়নি। বরং এটিএম’র লাইনে দাঁড়িয়ে যখন প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক সাধারণ মানুষ, তখন বিজেপির বার্ষিক আয় বেড়েছে ৮৫%। পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন কাজ হারিয়ে দিশেহারা, তখন ১৬,০০০ গুন মাল কামিয়েছে অমিত শাহ’র পুত্ররা। ৫রাজ্যের ভোটে নোট বাতিলের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের অসন্তোষের যে ট্রেলর আজ গোলিয়াথরা দেখছেন, সেই নোট বাতিলের আপাদমস্তক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিল ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
তামাম দুনিয়ার সংগ্রামী ইতিহাস সাক্ষী, ডেভিডরা হারেনি। সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে তুরুপের তাস হয়ে উঠতে না পারলেও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার যন্ত্রণটার শীতলপাটি হওয়ার ক্ষমতা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। জান কবুল মান কবুল লড়াই’র হিম্মতটা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। তাই যারা বিদ্রূপ করে জিজ্ঞেস করেন, ‘৫রাজ্যে বামপন্থীরা কটা আসন পেল?’, কিম্বা ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করেন ‘১৯টি রাজ্যে আমরা ক্ষমতায়', তোরা কটায়?’, কিম্বা ব্যাঙ্গ করে বলেন ‘মধ্যপ্রদেশে বিজেপি হারলে কম্যুনিস্টদের কি লাভ?’ -তাঁদের বলি, লাভ বামপন্থীদের একটা আছে। যতই হোক, পাড়ার পাগল কুকুর তো, মরলে গোটা পাড়ারই লাভ আছে।
আসলে মেহনতি মানুষের পক্ষ নিতে কম্যুনিস্টদের কোনদিন ভুল হয়নি। হিটলার-মুসোলিনি-ফ্র্যাঙ্কো কিম্বা আজকের নরেন্দ্র মোদী –ফ্যাসিস্টদের ম্যাসকট’দের চিনতে কম্যুনিস্টদের কোনদিন ভুল হয়নি। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কম্যুনিস্টরা কোনদিন কসুর রাখেনি। আর রাইখস্ট্যাগের মাথায় লালপতাকা উড়িয়ে দেওয়ার আগে অবধি কম্যুনিস্টদের সেই লড়াই থামেনি। ১১৫২ খ্রিস্ট পূর্বের মিশরে ফেরাও’র বিরুদ্ধে রেশনের দাবি তে শ্রমিক ধর্মঘটই হোক কিম্বা ১৯৫৯’র সালে পুঁজিবাদের আঁতুড় ঘর আমেরিকার রাস্তায় ৫লাখ ইস্পাত শিল্পের শ্রমিক’দের মিছিল। ৭৪’র ইন্দিরার সরকারের বিরুদ্ধে রেল ধর্মঘটই হোক কিম্বা মার্গারেট থ্যাচারের দেশে খনি শ্রমিকদের অনশন, এই সেদিনের ৫০হাজার কৃষকের সিঙ্গুর থেকে রাজভবন অভিযানই হোক কিম্বা আজকের প্যারিসে পেট্রো-পণ্যের মূল্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ -পৃথিবীর যে প্রান্তে, যে কোণায় যখনই মেহনতি মানুষরা শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে, সেই লড়াইয়ে নেতৃত্বে কম্যুনিস্টরাই থেকেছে।
তাই ঐ সব ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপে মুচকি হাসুন। আর বিনয়ের সাথে, ওঁদের কাঁধে হাত রেখে, মনে করিয়ে দিন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মহাদেশের, প্রত্যেকটা দেশের, প্রত্যেকটা শহরের, প্রত্যেকটা গ্রামের, প্রত্যেকটা জনপদে; হয়ত কোন ফ্যাক্টরির গেটের সামনে, কিম্বা হয়ত কৃষকের এক ফালি জমির মাঝে, হয়ত কংক্রিটের মিছিলে বেকারের কাঁধে, কিম্বা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মেহনতির প্রতিবাদের ভাষায়, কখনও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে উদ্ধত শ্লোগানে সেজে, কখনও যুদ্ধবিরোধী মিছিলে শান্তির পতাকা হয়ে কেস্তা-হাতুড়ি আঁকা ঐ একটুকরো লাল কাপড় কিন্তু ঠিক উড়ছে। আর উড়ছে, অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার দাবি তে নয়, মহম্মদ আর রামের নামে মানুষ ক্ষ্যাপাতে নয়, উৎসব আর মেলায় মাতিয়ে রাখতে নয়। হক আদায়ের লড়াই করতে। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ কে আগলে রাখতে। শোষণ-বঞ্চনাহীন নতুন ভোরের স্বপ্নটাকে সাচ্চা করতে।
কোন মন্তব্য নেই