Header Ads

এন আর সি নবায়ন কি নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত? প্রশ্ন উঠল নাগরিক সম্মেলনে


“…৩০ জুলাই ২০১৮ এক ধাক্কায় রাষ্ট্রহীন হলেন ৪০ লক্ষ মানুষ।  ব্রহ্মপুত্র থেকে বরাক উপত্যকায় তাই এখন মরিয়া ‘জোট বাঁধো, তৈরি হও’ মনোভাব। প্রধান সড়কে, অভিবর্তনে, রাজধানী দিসপুরের লাস্টগেট-এ যা আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।” বরপেটা রোড ও গুয়াহাটি থেকে ফিরে জানাচ্ছেন দেবাশিস আইচ।

১৯৯৪ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়। তৎকালীন বরপেটা জেলার (বর্তমান বাক্সা) শালবাড়ি থেকে এলাঙ্গাবাড়ি, প্রায় কুড়িটা গ্রামের মানুষ জেনে গেলেন তাঁরা যে কোনও সময় আক্রান্ত হতে পারেন। গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে চললেন তাঁরা। নিরাপদ আশ্রয় বলতে বাহাবাড়ি রেঞ্জ অফিসের একটি মাঠ। আর একটি স্কুল বাড়ি। আর সেখানে রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি বা ক্যাম্প। ক্যাম্প ইনচার্জ সহ গোটা ২৪ পুলিশ কর্মী। মাঠেই পড়ে রইলেন প্রায় হাজার দশেক মানুষ। শ’পাঁচেক মহিলা,শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার স্থান হল এম ই স্কুলে।

১৯ জুলাই অন্ধকার নামতেই এলাকা ঘিরে ফেলল বোড়ো জঙ্গিরা। অভিযোগ, অতিরিক্ত ফোর্স পাঠানোর জন্য ক্যাম্প ইনচার্জের যাবতীয় বার্তা পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছিল জেলা পুলিশ-প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তারা। অজুহাত, পাঠানোর মতো যথেষ্ট বাহিনী মজুত নেই। রাত দশটা পুলিশ বাহিনীকে গুলির লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়ে এলাকার দখল নিল জঙ্গিরা। স্কুলের তিনটি দরজা বেঁধে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। তার পর মাঠ লক্ষ করে খালি করে দেয় স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ম্যাগাজিন।

মৃত? আহত? সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। তবে, তৎকালীন হিতেশ্বর শইকিয়া সরকার ১৬০ জন মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। প্রায় দু’দিন বাদে ২২ জুলাই সরকার তৎপর হয়। সেদিন শুধু মাত্র ট্রাক ভর্তি করে লাশ সরিয়ে আনা হয় বরপেটা মেডিক্যাল কলেজে। এমনই এক লাশের গাড়িতে বাবা-মা’কে নিয়ে একরকম জোর করেই বাহাবাড়ি ছেড়েছিলেন সদ্য যুবক আবুল কালাম আজাদ। অনেকের মতোই তিনি বা তাঁর পরিবার আর ফিরে যাননি। পিছনে পড়ে রইল তিন পুরুষের গ্রাম এলেঙ্গাবাড়ি, বাস্তুভিটে, খেতের জমি। ত্রাণের ১৪টি টিন আর পাঁচ হাজার টাকা সম্বল করে, কিছুদিন ত্রাণ শিবিরে কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কালামের পরিবার। কিন্তু, ফের নিজ দেশে ‘বিদেশি’ অপবাদ মুছতে দ্বারস্থ হতে হয়েছে এনআরসি কর্তৃপক্ষের দরবারে। নিজে এ-যাত্রা সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেও বড়ো দাদা আবদুল হালিম পড়ে গিয়েছেন ৪০ লক্ষের ফাঁদে। নামনি, উজান ও বরাক অসমের প্রায় সর্বত্র এমন অসংখ্য কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে। যে কাহিনি ভারত কখনও মনোযোগ দিয়ে শুনতে চায়নি। প্রান্তিক রাজ্যের কাহিনি অবহেলার প্রান্তকথাই হয়ে রয়ে গিয়েছে। আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের ‘জাতি মাটি ভেত্তি’ এক আইনি ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভেসে যেতে বসেছে।

হ্যাঁ, এই ‘জাতি মাটি ভেত্তি’র স্লোগান তুলেই ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি-অগপ জোট। সমাজতাত্ত্বিকরা বলেছিলেন,  জাতিগত নিরাপত্তা, জমি-জোতের নিরাপত্তা আর সুখী গৃহের স্বপ্ন ধরা দিয়েছিল এই স্লোগানে। সে স্লোগানের রেশ কাটতে না কাটতে ৩০ জুলাই ২০১৮ এক ধাক্কায় রাষ্ট্রহীন হলেন ৪০ লক্ষ মানুষ। আক্রান্ত এই সব জাতি-জনজাতির  মানুষের কাছে সেই স্লোগান যেন এক নির্দয় ঠাট্টা হিসেবে হাজির হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র থেকে বরাক উপত্যকায় তাই এখন মরিয়া ‘জোট বাঁধো, তৈরি হও’ মনোভাব। প্রধান সড়কে, অভিবর্তনে, রাজধানী দিসপুরের লাস্টগেট’এ যা আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।

বরপেটা রোড, ২ অক্টোবর  ২০১৮। মাত্র বিশ দিনের প্রচেষ্টায় গঠিত ‘জনগোষ্ঠীয় যৌথ সংগ্রামী মঞ্চ’ এক ‘গণ অভিবর্তন’-এ তিন মাসের মধ্যে  ডিটেনশন ক্যাম্প তুলে দেওয়ার এবং একই সময়ের মধ্যে ডি-ভোটার সমস্যার সমাধান করার দাবি জানাল।  না-হলে রাজ্য জুড়ে গণ আন্দোলনেরও ডাক দিল তারা। বরপেটা রোডের ‘সাহিত্য সভা ভবন’-এ আয়োজিত ‘নাগরিকত্ব, গণতন্ত্র আর উন্নয়ন’ শীর্ষক এই গণ অভিবর্তন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বক্তা এন আর সি নবায়ন কর্মকাণ্ড বিষয়ে তাদের যাবতীয় ক্ষোভ উগরে দিলেন। জানা গেল,
মঞ্চের প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, “অসমের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের স্বার্থে শুদ্ধ এন আর সি চাই কিন্তু নবায়নের নামে নাগরিকদের উৎপীড়ন করা যাবে না।”

অভিবর্তনের অন্যতম প্রধান দাবিগুলি ছিল এরকম (ক) এখনই ডি-ভোটার সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সমস্ত ডিটেনশন ক্যাম্প তুলে দিতে হবে। (খ) চূড়ান্ত খসড়ায় বাদ পড়া ৪০ লক্ষ আবেদনকারীর ক্ষেত্রে নিয়ম পরিবর্তন করা যাবে না। ১৫টি দলিলই গ্রহণ করতে হবে। (গ) মিথ্যা অভিযোগকারীকে শাস্তি দিতে হবে। (ঘ) ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে গ্রহণযোগ্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কেননা, ১৯৯৭ সালের ভোটার তালিকা ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে তৈরি হয়েছিল। তারই সংশোধিত রূপ ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা। (ঙ)বিদেশি ন্যায়াধিকরণ বন্ধ করতে হবে।(চ) ডি-ভোটার সমস্যা নাগরিকত্ব সেবা কেন্দ্র (এনএসকে)-তেই সমাধান করা। (ছ) সাম্প্রদায়িকতা তথা উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধীতা এবং গণতন্ত্র-উন্নয়ন-নিপীড়িতের অধিকার সাব্যস্ত করণ। এবং অন্যতম গুরুত্ববহ দাবি (জ) অসমের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া।

কারা এই অভিবর্তনের উদ্যোক্তা? নিম্ন অসমের বরপেটা, বাক্সা, শালবাড়ি জেলার বিভিন্ন ছাত্র-যুবদের সংগঠন। যেমন, কোচ-রাজবংশী ছাত্র সংগঠন’আক্রাসু’, মুসলিম ছাত্র সংগঠন ‘আমসু’, ও ‘এবিএমসু’, বাঙালি ছাত্র সংগঠন ‘বঙালী যুব ছাত্র ফেডারেশন’, ভোজপুরী ছাত্র সংগঠন এবং আসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ রাইট, ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি এবং ‘বসুন্ধরা — নতুন দিনের বারে’র মতো গণ সংগঠন।

অভিবর্তনে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক দেবব্রত শর্মা, গৌহাটি কমার্স কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এবং গৌহাটি হাইকোর্টের বর্তমান আইনজীবী ড. ঘনশ্যাম নাথ, প্রবীণ সমাজকর্মী হর কুমার গোস্বামী’র মতো অসমিয়া বিদ্বজ্জনরা। অধ্যাপক শর্মা মনেই করেন, বর্তমানে “গোটা পরিস্থিতি দুই সম্প্রদায়ের বিভাজন এবং এক সাম্প্রদায়িক – ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনাধীনে সাম্প্রদায়িক ভাবে অগ্নিগর্ভ।” তাঁর মতে, সুপ্রিম কোর্টের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নাগরিক পঞ্জির কাজ শুরু হলেও, “…ভুলে গেলে চলবে না যে কাজটা করছে এক অপদার্থ আমলাতন্ত্র।” ইতিমধ্যেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর ভাষায়, “একটা মৌলিক প্রশ্ন হল বামপন্থীরা কি নিরপেক্ষ ভাবে নাগরিক পঞ্জি তৈরির কাজটা করার ব্যাপারে রাষ্ট্র বিশেষত আধা-ঔপনিবেশিক / নয়া ঔপনিবেশিক যুগের এক সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে পারবেন? আরও বাস্তব প্রশ্নটা হল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মধ্য দিয়ে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া, অক্ষরবঞ্চিত ও দরিদ্র এক জন সমুদায়ের প্রতি এই আমলাতন্ত্র সুবিচার করবে, এমন ভরসা কি রাখা চলে?” (শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, কলকাতা।)


শুধু বরপেটা নয়। ওই একই দিনে বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে প্রায় হাজার খানেক মানুষের প্রতিবাদী মশাল মিছিল হয়। বরাকের তিন জেলার প্রায় ৩৫টি সাংস্কৃতিক, ছাত্র-যুব এবং গণ সংগঠন আয়োজিত এই মিছিলের কেন্দ্রীয় স্লোগান ছিল ‘সবার জন্য সবার মিছিল’। পরদিন উপত্যকার বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রে শিরোনাম ছিল এই রকম।

মূলত যে চারটি দাবি উদ্যোক্তারা সামনে নিয়ে এসেছেন, সেগুলি হল — (ক) পাঁচ নথির মান্যতার পাশাপাশি যে কোনও প্রামাণ্য নথি গ্রহণ করা। (খ) ১০ শতাংশ নাগরিকের পুনঃপরীক্ষা বাতিল করা। (গ) নথি সংক্রান্ত চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত প্রপত্র পূরণ স্থগিত রাখা এবং এন আর সি ছুটদের প্রপত্র পরীক্ষণ ন্যায়িক প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে তরুণ গগৈ সরকার এন আর সি নবায়নের ‘পাইলট প্রজেক্ট’ শুরু করলে কোন কোন নথি গ্রাহ্য হবে এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ওই প্রক্রিয়ায় নানান খামতি দূর করার দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিতে চার জন আমসু সমর্থক নিহত হন। পরবর্তীতে ১৫টি নথি নাগরিকত্ব প্রমাণের গ্রহণযোগ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত হয়। কিন্তু,  চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পর এন আর সি’র রাজ্য সমন্বয়কারী প্রতীক হাজেলা সুপ্রিম কোর্টে পাঁচটি নথি বাতিলের সুপারিশ করেন এবং তা গৃহীত হয়। এই পাঁচটি নথি হল, (১) এন আর সি, ১৯৫১’র নির্বাচিত অংশ (২) ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভোটার তালিকা, (৩) নাগরিকত্বের শংসাপত্র, (৪) শরণার্থী শংসাপত্র, (৫) রেশন কার্ড।

‘বরাক বুলেটিন’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শিলচর মিছিলের অন্যতম উদ্যোক্তা কমল চক্রবর্তী জানান, “দলমত নির্বিশেষে অসংখ্য ব্যক্তি, সংগঠন এই মিছিলে যোগদান করেছে।… পাঁচটি নথি বাদ দেওয়ার ফলে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগদান করেছে, তাই আমরা আমাদের এই প্রয়াস সম্পূর্ণ সফল বলে মনে করছি।… ইচ্ছে ছিল মানুষকে ঘর থেকে বার করে আনা, তা সম্পূর্ণ সফল।”

৪ অক্টোবর ‘দৈনিক জনমভূমি’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, এন আর সি-তে নাম অন্তর্ভূক্ত করার জন্য দিসপুরে অসম সচিবালয়ের সামনে লাস্ট গেট-এ ধরনায় বসেছেন গারো, হাজং, কোচ, লালুং, ভালু, বানাই এবং অন্যান্য জনজাতিগোষ্ঠীর একাংশ মানুষ। তাদের দাবি, ১৯২৪ সালে তারা পূর্ববঙ্গ থেকে অসমে এসেছেন কিন্তু তাদের ৯০ শতাংশের নাম এন আর সি তালিকায় নেই। কারণ, তারা যে নথি — ‘রিলিফ এলিজিবিলিটি সার্টিফিকেট’ বা আর ই সি —পেশ করেছিলেন তা এন আর সি কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিয়েছে। অর্থাৎ, এই জনজাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে এমন অংশ রয়েছে যারা এক সময় পূর্ববঙ্গ থেকে প্রব্রজন করেছে।

এখন প্রশ্ন হল, প্রায় ২০১০ থেকেই অসমের সব জাতি-জনজাতির মানুষ যখন এক রকম এন আর সি নবায়নকে মেনেই নিয়েছিলেন এবং রাজ্যের ৩ কোটি ২৯ লক্ষ বাসিন্দা নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দলিল দস্তাবেজ জমা দিতে উৎসাহ দেখিয়েছেন, তারা আজ এত ক্ষুব্ধ কেন? তার আগেও যে প্রশ্নটি জানা জরুরি এন আর সি নবায়ন মেনে নেওয়ার প্রণোদন তাঁরা কোথায় পেলেন?

যে সরকার একের পর এক গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি উলটে অভিযুক্তদের দাবি মোতাবেক এন আর সি নবায়নের চুক্তি করল, সেই নবায়ন মেনে নেওয়া হল কেন? আবুল কালাম আজাদ যে উত্তর দিয়েছিলেন তা বোধহয় অনেকেরই মনের কথা। কালাম বলেছিলেন, “বিদেশি শুনে শুনে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি। এই হয়রানি থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিল মানুষ। একবার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারলে আর কেউ বিদেশি বলতে পারবে না। সমান অধিকার পাব।” কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কী দেখা গেল? বরপেটা গণ অভিবর্তন-এর প্রচারপত্র জানাচ্ছে, “রাজ্যের ৩ কোটি ২৯ লক্ষ মানুষ দলিল দস্তাবেজ সহ আবেদন করতেই শুরু হল নতুন খেলা। এন আর সি কর্তৃপক্ষ ডি-ভোটার এবং তাদের আত্মীয়দের নবায়ন প্রক্রিয়ার আওতার বাইরে রাখার ফরমান জারি করল। নিয়মের পিছনে নিয়ম জারি করে এন আর সি-তে নাম নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া জটিল থেকে জটিলতর করে তুলল। জনসাধারণের হয়রানি বাড়ল এবং এন আর সি’র আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিল। এই জটিলতাকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে সরকার আইনগত ভাবে অর্থহীন নাগরিকত্ব বিল নিয়ে এল। এই বিলকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক, উগ্রজাতীয়তাবাদী তথা জাত্যাভিমানী শিবির চারদিকে বিভাজনের কুচকাওয়াজ শুরু করল। যে এন আর সি উন্নতিকরণের ফলে বিদেশি সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে বলে আশার সঞ্চার ঘটেছিল, সেটাই হয়ে পড়ল বিভাজনকামী রাজনীতির পুরনো খেলার অস্ত্র।

“ঘোষিত উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, রাজ্যবাসীর মনে শঙ্কার সৃষ্টি হল। সরকার এবং এন আর সি কর্তৃপক্ষ মিলে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত করেনি তো? পুঁজিপতি গোষ্ঠীর স্বার্থে জল-জমি-জঙ্গল কেড়ে নেওয়ার জন্য পাশাপাশি অধিকারহীন সস্তার শ্রমিক বানাবার জন্য এ-জাতীয় নাগরিকদের নাগরিকত্বহীন করে দেওয়ার বিচার বিবেচনা করেনি তো?” ( মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদ লেখকের)।

প্রায় নিয়মিত বিভিন্ন জেলা থেকে বিক্ষোভ, সভার খবর পাওয়া যাচ্ছে। যে বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে বিভিন্ন সংগঠন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ শুরু করেছে তা হল বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে একের পরর এক ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর ঘটনা। ডিটেনশন ক্যাম্পে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও নবায়নের অভিঘাতে আত্মহত্যা কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা দু’অঙ্ক ছুঁয়েছে। এই মৃত্যুর সুবিচারের দাবিতে ‘জনগোষ্ঠীয় যৌথ সংগ্রামী মঞ্চ’ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তেমনি বরাক উপত্যকাতেও একই দাবি নিয়ে গণ সংগঠনগুলি আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। লিংক দেখুন।

শাসক অবশ্য বসে নেই। বর্তমানে অসমের বিজেপি নেতৃত্ব জোর গলায় দাবি করছে, আগামী শীতকালীন অধিবেশনেই নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পেশ করা হবে। যদিও, অসমের কট্টরা হিন্দু বাঙালি সংগঠনও এই দাবি খুব একটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। শেষ করা যাক অধ্যাপক শর্মা’র বক্তব্য দিয়েই, “সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জাত্যাহংকার — অভিন্ন দেহ এই যমজের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধজয়ের সংগ্রামে আমাদের অবতীর্ণ হতেই হবে।…ঘন মেঘে আচ্ছন্ন, প্রায়ান্ধকার এই কালে আশার কথা এই যে অসমিয়া লোকসমুদায় জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বিষয়ে হিংসার যাবতীয় প্ররোচনায় সাড়া দিতে অস্বীকার করেছেন। সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি।”
লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী। ছবিঃ লেখক।


লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী। ছবিঃ লেখক
গ্ৰাউণ্ড জিরোর সৌজন্যে


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.